রনির ‘গুন্ডামি’ নিয়ে কিছু কথা

রনির ‘গুন্ডামি’ নিয়ে কিছু কথা

শওগাত আলী সাগর: একজন নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য দুজন টেলিভিশন সাংবাদিককে নিজে পিটিয়েছেন,একজনকে হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে হয়েছে । এমপি নিজেই কেবল পেটাননি,তার সঙ্গে থাকা লোকজনও সাংবাদিক দুজনকে পিটিয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে এমপি সাহেবের অফিসের সামনে । সরকার দলীয় সাংসদ গোলাম মাওলা রনির এই গুন্ডামি নিয়ে  সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে তুমুল ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। গুন্ডামি শব্দটা সচেতনভাবেই ব্যবহার করলাম। ফেসবুকে শেয়ার হওয়া ঘটনার ভিডিওচিত্রটি দেখার পর এটিকে এমপি রনির গুন্ডামি ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি আমার কাছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে,এমপি রনির এই গুন্ডামিকে যথার্থতা এবং মহত্ব দেওয়ার লোকেরও অভাব ঘটছে না। ইতিমধ্যে একটি গ্রুপ দাড়িয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে যারা একজন আইন প্রণেতার নিজ হাতে আইন তুলে নিয়ে গুন্ডামি করাটাকেও সমর্থন দিচ্ছে। যারা রনির হয়ে খুব বেশি উচ্চকণ্ঠ তারা কিন্তু আওয়ামী লীগের লোক নয়,আবার প্রতিক্রিয়াশীল জামাত শিবিরের সমর্থকও নয়। এরা যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচার নিশ্চিত করার জন্য উচ্চকণ্ঠ, এরা শেয়ারবাজারের লুটপাট,হলমার্কের লুটপাট,পদ্মাসেতুর কথিত দুর্নীতি এমনকি ছাত্রলীগের সন্ত্রাস নিয়েও আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর। সবকিছুতে আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর যারা তারা একজন আওয়ামী এমপির গুন্ডামিকে সমর্থন করছেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর অন্তত আমার জানা নেই।

এমপি রনির সাংবাদিক পেটানো নিয়ে পাল্টাপাল্টি  দুটো মামলা হয়েছে। ইন্ডেপেনডেন্ট টেলিভিশনের পক্ষ থেকে রনির বিরুদ্ধে হত্যা প্রচেষ্টার মামলা হয়েছে। এমপি রনি নিজেও একটি মামলা করেছেন। তিনি মামলায় আসামী করেছেন সালমান রহমানকে। সালমান ঘটনাস্থলে ছিলেন না। তিনি টেলিভিশন চ্যানেলটির মালিক। রনি কৌশলে  দেশবাসীকে বুঝাতে চেয়েছেন  টিভি চ্যানেলটির মালিকের সঙ্গে দন্দ্বের জের এই ঘটনা। সালমান রহমান বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্য অঙ্গনে একটি কুখ্যাত নাম।দেশের শেয়ারবাজারের  বিপর্যয়ের সঙ্গে চিরস্থায়ীভাবে লেপ্টে গেছে  তার নাম। ছিয়ান্নব্বইর শেয়ার কেলেংকারির ঘটনার পর সালমান-সোহেল রহমান ভাতৃদ্বয়কে কাঠগড়ায় দাড়ানোর ক্ষেত্রে তিনটি পত্রিকার তিনজন রিপোর্টার  জেহাদে নেমেছিলো। তাদের মধ্যে আমারও থাকার সুযোগ হয়েছে। সালমান রহমানের সঙ্গে আমার নিজের লড়াইটা অনেক পুরনো এবং এখনো আমি নিজেকে সেই লড়াইয়েরই সৈনিক মনে করি।

সালমান রহমানের বিরুদ্ধে নানা কেলেংকারি দুর্নীতির অভিযোগ আছে বলেই তার  মালিকানাধীন কোনো মিডিয়ার সাংবাদিকদের যে কেউ মারধর করতে পারবে- এমন আইন কি বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে? এমপি রনি এবং তার সমর্থকরা বলার চেষ্টা করছেন,ইন্ডেপেনডেন্ট টেলিভিশনের কর্মীরা এমপি রনির ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় বিঘ্ন ঘটিয়েছেন।ধরে নিলাম ওই দুই সাংবাদিক এমপি রনির প্রাইভেসি ক্ষুন্ন করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন। ভিডিওচিত্রে রনির হামলার সূত্রপাতের মুহুর্তে ইন্ডেপেনডেন্ট কর্মীর সংলাপটুকু শোনার সুযোগ হয়েছে। এমপি রনির প্রশ্নের জবাবে একজন মিডিয়া কর্মী বলেছেন,’বসে আছি, বসে থাকা যাবে না?’ না, কারো অফিসের সামনে বিনা প্রয়োজনে কেউ বসে থাকতে পারে না। মিডিয়া কর্মীও না। সেটি তার এখতিয়ারের বাইরে। কিন্তু কেউ বসে থাকলেই তাকে মারপিট করতে হবে এই  অধিকারও রনির নেই। রনি নিশ্চিতভাবেই পুলিশ ডাকতে পারতেন। শাসকদলের এমপি তিনি, তার ডাকে পুলিশ এসে যে ব্যবস্থা নিতো না তাতো নয়। কিন্তু রনি পুলিশ না ডেকে নিজেই গুন্ডার মতো ঝাপিয়ে পড়লেন কেন?

বলা হচ্ছে  ইন্ডেপেনডেন্ট টেলিভিশনের একটি টিম চারদিন ধরে এমপি রনিকে অনুসরন করছিলো।এই অনুসরন করাটাকেও রনির প্রাইভেসি লংঘন বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন এমপি রনি এবং তার সমর্থকরা । আমি নিজে তার সাথে ভিন্নমত পোষন করি। এই প্রসঙ্গে কানাডার বৃহত্তম শহর টরন্টোর মেয়র রবাট ফোর্ড  এর  উদাহরন অপ্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে হয় না। মেয়র ফোর্ড এর সঙ্গে এক ধরনের বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকা টরন্টো স্টার। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনের সময় প্রায় সব মিডিয়াই রবার্ট ফোর্ডের বিপক্ষে ছিলো। মেয়র নির্বাচিত হবার পরও  সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। নানা ইস্যূতে রিপোর্টাররা হরহামেশাই তাকে উত্যক্ত করা শুরু করে। এক পর্যায়ে মেয়র মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দেন। অফিসে আসা  যাওয়ার পথে রিপোর্টার আর টিভি ক্রুরা এমনভাবে আগলে ধরেন যে তার হাটাচলাই কঠিন হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে মেয়র রবার্ট ফোর্ড ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগ দেন। নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ হলো রিপোর্টারদের হাত থেকে মেয়রকে আগলে রাখা।

প্রায় প্রতিটি পত্রিকা,টেলিভিশন চ্যানেলই মেয়রের অ্যাপয়ন্টমেন্ট চেয়ে দরখাস্ত করতে থাকে।  সাক্ষাতকার চেয়ে বারবার ব্যর্থ হ্ওয়ার পর সিবিসি টেলিভিশনের  একটি টিম ভোর রাতে গিয়ে হাজির হয় মেয়রের ব্যক্তিগত বাড়ীতে। ড্রাইভওয়েতে কয়েকটি ক্যামেরা ফিট করে উৎ পেতে বসে থাকে সিবিসি ক্রুরা। মেয়র ফোর্ড ভোর বেলা  বাড়ী থেকে বেড় হয়ে ড্রাইভওয়েতে  পৌঁছুতেই সাংবাদিক চিৎকার করে ওঠে,’তোমাকে পেয়েছি মেয়র’ বলে।  হতচকিত  ক্ষুব্দ মেয়র  সঙ্গে সঙ্গে  পুলিশ ডাকেন। টরন্টোর পুলিশ আবার মেয়রেরই নিয়ন্ত্রনে। কিন্তু পুলিশ টিভি ক্রুদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে অগ্রসর হয়নি। মেয়র রবার্ট ফোর্ড তার ব্যক্তিগত বাড়ীতে ভোর রাতে টিভি ক্যামেরা নিয়ে ‘অ্যামবুশ’ করার অভিযোগ তুলেন, প্রাইভেসি লংঘনের আওয়াজ তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যক্তিগত প্রাইভেসি রক্ষায় কঠিন আইনের দেশ কানাডায়ও সিটি মেয়র পাত্তা পান নি। একজন জনপ্রতিনিধি মেয়রের কাছে মিডিয়ার পৌঁছার অধিকার আছে।সেই অধিকারেরই জয় হয়,বরং মেয়র রবার্ট ফোর্ডই সমালোচিত হন।  মিডিয়া কদ্দুর গেলে সেটা ব্যক্তির প্রাইভেসি নষ্ট  করে তা নিয়ে বোধ হয়  বিতর্ক করার অবকাশ আছে। যদি ব্যক্তিটি হন জনপ্রতিনিধি তাহলে তো আরো বিতর্ক হওয়া দরকার। কিন্তু কোনো জনপ্রতিনিধি কেন,কোনো নাগরিকই গুন্ডামিতে লিপ্ত হতে  পারেন না।

সালমানের বিরুদ্ধে যেমন শেয়ারবাজারসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তেমনি অভিযোগ আছে রনির বিরুদ্ধেও। টকশোতে রনি নিজদলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন। কিন্তু তিনি কি কখনো নিজের দুর্নীতির ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছেন? ইন্ডেপেনডেন্ট টেলিভিশন যখন তার দুর্নীতি নিয়ে খোঁজ খবর করতে শুরু করলো তখন তিনি সালমানকে টেনে এনে নিজের দুর্নীতিকে আড়াল করার চেষ্টা করলেন। অনেকটা আমারদেশের মাহমুদুর রহমানের মতো। আমার মনে হয়েছে, রনি এবং মাহমুদুর রহমানের মধ্যে চারিত্রিক একটা মিল আছে। মাহমুদুর রহমানের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে কোনো পত্রিকায়  রিপোর্ট ছাপা হলেই তিনি ওই পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে টাকা চাওয়ার অভিযোগ তুলতেন। রনিও একই প্রক্রিয়ায় মিডিয়ার অনুসন্ধানের মাঝখানে সালমানকে দাড় করিয়ে দিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন।

আমরা বরাবরই শেয়ারবাজারের কারসাজির দায়ে সালমান ও অন্যান্যদের বিচারের পক্ষে কথা বলেছি।আজও বলি। কিন্তু সংসদ সদস্য হয়ে  গোলাম মওলা রনি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে গুন্ডামি করবে সেটাকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এই ঘটনাটা রনি না ঘটিয়ে ছাত্রলীগ ঘটালে কি অবস্থা হতো? ছাত্রলীগ ঘটালে যেটা অপরাধ হয়,একই কাজ এমপি রনি করলে অপরাধ হবে না কেন? আমরা গুন্ডামির দায়ে গোলাম মাওলা রনির শাস্তি চাই।

স্নেহভাজন সাংবাদিক কাজী সাইমুল হক রনি ফেসবুকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন,“বিরোধটা চোর সালামান আর ডাকাত রনির মধ্যে না। বিরোধটা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, জনপ্রতিনিধির জবাবদিহিতা তথা গণতন্ত্রের সঙ্গে লুটেরাতন্ত্রের।”  হ্যাঁ, এটা গনমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং জনপ্রতিনিধির জবাবদিহির লড়াই-ই বটে। আর লড়াইয়ে মিডিয়ার সোচ্চার হওয়া উচিত। উচ্চকন্ঠ হওযা উচিত গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকেও। রনিরা আর যাই হউক গনতান্ত্রিক ধারার মিত্র নয় । জনপ্রতিনিধিরাও  গুন্ডা হয়ে উঠুক সেটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

[লেখক: শওগাত আলী সাগর; প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক,নতুনদেশ ডটকম]

অতিথি লেখক