একবার এমপি হতে পারলে আর কিছু হওয়ার দরকার ছিল না, আর কিছু চাওয়ারও ছিল না

একবার এমপি হতে পারলে আর কিছু হওয়ার দরকার ছিল না, আর কিছু চাওয়ারও ছিল না

প্রভাষ আমিন: ছেলেবেলায় আইসক্রিমওয়ালা হতে চেয়েছি, স্কুল শিক্ষক হতে চেয়েছি, একটু বড় হয়ে সাংবাদিকও হতে চেয়েছি; এখনও সেটাই হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু কখনোই এমপি হওয়ার কথা ভাবিনি। এখন মনে হচ্ছে জীবনে একবার এমপি হতে পারলে আর কিছু হওয়ার দরকার ছিল না, আর কিছু চাওয়ারও ছিল না। এমপি হওয়ার ইচ্ছাটা আমার প্রথম জেগেছিল গত বিশ্বকাপের সময়। একদিন বিকালের দিকে এমপির মেয়ে এক মহিলা আমার বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। তার নিজের বাসা মোহাম্মদপুরে, মা থাকেন এমপি হোস্টেলে। সেদিন ছিল তার প্রিয় দল ব্রাজিলের খেলা। ভেবেছিলাম আমরা একসঙ্গেই খেলা দেখবো। হুট করে সেই মেয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দিল। কেন? না আমার প্রিয় দলের খেলার এক সেকেন্ডও মিস করতে চাই না। তাই খেলাটা আম্মুর বাসায় দেখবো।

এতক্ষণে পরিস্কার হলো বিষয়টি। এমপি হোস্টেলে লোডশেডিং নেই, তাই প্রিয় দলের খেলা মিস করার কোনো শঙ্কা নেই। আহা, লোডশেডিং ফ্রি বাসা, এ যে স্বর্গের প্রায় কাছাকাছি। ওই সময়টাতেই আমি বাসা বদলানোর চেষ্টা করছিলাম। টু লেট দেখে দেখে বাসা খুঁজে বেড়াই। কিন্তু একেক এলাকার একেক সমস্যা। কোথাও লোডশেডিং বেশি, কোথাও গ্যাস থাকে না, কোথাও যানজট বেশি, কোথাও নিরাপত্তা সমস্যা, কোথাও রাস্তা ভালো না, কোথাও বৃষ্টি হলে পানি আটকে থাকে- সমস্যার অন্ত নেই। এই সমস্যাসঙ্কুল ঢাকায় এমপি হোস্টেল সত্যি স্বর্গের মতন!

গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ-নিরাপত্তা-রাস্তা-পরিবেশ, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এই স্বর্গেও দেখি কারো কারো অরুচি। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী অন্তত ৬৬ জন এমপি তাদের জন্য বরাদ্দ করা বাসায় থাকেন না। তবে তারা বাসা ছেড়েও দেননি। এমপির বাসায় থাকেন তাদের আত্মীয়-স্বজন, পিএস-এপিএস, ড্রাইভার, পিয়ন, এলাকার মাস্তানরা। আলোচিত সাংসদ গোলাম মাওলা রনির বাসায় থাকেন তার ড্রাইভার। তার মানে এই ৬৬ এমপি যেখানে থাকেন, সেটা আরো ভালো, স্বর্গের কাছাকাছি নয়, হয়তো স্বর্গই। কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর…?

এমপিরা আমাদের মাথা। তারা আমাদের জন্য আইন বানান, সংসদে গিয়ে আমাদের কথা বলেন। আমরা বর্তে যাই, কৃতজ্ঞ হই। আমরা পাঁচ বছরে একবার ভোট দেই। আর সেই এক ভোটের বিনিময়ে এমপি সাহেবরা পুরো পাঁচ বছর আমাদের দেখভাল করেন। তারা কত ভালো, মাত্র এক ভোটের বিনিময়ে এত সার্ভিস। আদর-সোহাগ তো করেনই, মাঝে মাঝে শাসনও করেন। শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে। এমপি সাহেবরা সাধারণ মানুষের গায়ে হাত তোলেন, চড়-থাপ্পর মারেন, কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখেন। তবে সাংবাদিকদের গায়ে হাত তোলার সাহস নেই তাদের।

একটা গল্প মনে পড়ে গেল। এক লোক তার স্ত্রীকে খুব মারধোর করেন। তো একবার সালিশ বসলো। মুরুব্বিরা বকাঝকা করে লোকটিকে বলে দিলেন আর যেন বউয়ের গায়ে হাত না তোলেন। কিন্তু সালিশের পর বউ বেচারির অবস্থা আরো খারাপ। নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়েছে। আবার বসলো সালিশ। কী ব্যাপার, তুমি আবারো বউয়ের গায়ে হাত তুলেছে। লোকটি জবাব দিল, খোদার কসম, আপনারা বলার পর থেকে আমি আর হাত তুলিনি, শুধু পা তুলি। আমাদের হয়েছে সেই দশা। সাংবাদিকের গায়ে হাত তোলার সাহস নেই। তাই এমপি রনি সাহেব কষ্ট করে পা তুলেছেন। এই বিশেষ সম্মানে আমরা কৃতজ্ঞ হই। এমপি সাহেবদের পায়ের নিচেই তো আমাদের সকল কল্যাণ। তারা যে দয়া করে সেই কল্যাণের পা দুটি আমাদের গায়ে তুলেছেন, তাতেই আমরা ধন্য। আইন যারা বানান, আইন নিজের পায়ে তুলে নেয়ার অধিকার তো তদেরই। আমরা ভোট দিয়েই তো তাদের সর্বেসর্বা বানিয়ে দেই; আমাদের গায়ে হাত তোলার, পা তোলার, আমাদের গুলি করার, আমাদের শাসন করার-শোষণ করার পূর্ণ অধিকার তো আমরাই তাদের দিয়েছি।

আপনারা কেউ ভাববেন না, মারপিট করার গুণ গোলাম মাওলা রনির একারই। তবে মানতেই হবে তার সাহস সবার চেয়ে বেশি। প্রেসক্লাবের উল্টোদিকের ভবনে দুই সাংবাদিককে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে বুকের পাটা লাগে। নিশ্চয়ই অন্যদের চেয়ে অনেক বড় মাপের বুকের পাটা তার আছে। তবে আমরা যতদূর জানি, সাংবাদিক পেটানোর ব্যাপারে তার প্র্যাকটিস আছে। এর আগেও এলাকায় সাংবাদিকদের মারধোর করেছেন রনি। অভ্যাসটা পটুয়াখালি থেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন এই যা। তবে ঢাকায় সাংবাদিক পেটানো প্রথম এমপি নন রনি। গত বছর মনিপুর স্কুলের অনিয়ম নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে এমপি কামাল মজুমদারের মার খেয়েছেন আরটিভির রিপোর্টার অপর্না সিংহ। ইটিভির নাদিয়া মোল্লাদের হাতে মার খেয়েছেন। তবে এমপির হাতে মার খাওয়া বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। অপর্ণা সত্যি সিংহ। তবে সাহসের বিবেচনায় ময়মনসিংহের এমপি গিয়াসউদ্দিনও রনীর চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে থাকবেন না। নিজের এলাকায় বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর ‘ম্যাট্রিক্স স্টাইলে’ গুলি চালিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আর ফটোকপি করতে দেরি হওয়ায় সচিবালয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মচারিকে গুলি করার হুমকি দিয়েছিলেন। তবে সে দুই কর্মচারির দুর্ভাগ্য এমপি সাহেব হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন। গুলি খাওয়ার সৌভাগ্য তাদের হয়নি।

রনি, কামাল বা গিয়াস নন, মারামারিতে প্রথম হবেন টেকনাফের এমপি বদি। গত সাড়ে চার বছরে তিনি কতজনকে মেরেছেন তার তালিকা দিতে গেলে এই লেখার আকার ভদ্রতাকে ছাড়িয়ে যাবে। ইউএনও, শিক্ষক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, বন কর্মকর্তা, নির্বাচনী কর্মকর্তা- সবাই ‘ধন্য’ হয়েছেন তার প্রহারে। তাকে দেখে দাঁড়াননি বলে এক নির্বাচনী কর্মকর্তাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন বদি। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা নেয়ায় থানার ওসিকে মারধোর করেন যশোরের এমপি আফিলউদ্দিন। পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ না দেয়ায় বরিশালের এমপি মনিরুল ইসলাম মনির মার খেয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী। একই সৌভাগ্য হয়েছে ঝিনাইদহের সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলীর। তিনি খেয়েছেন ঝিনাইদহের এমপি শফিকুল ইসলাম অপুর মার।

ট্রেনে ডিলাক্স রুমের টিকেট না পাওয়ায় পানার এমপি শামসুর রহমান শরীফ ডিলু পিটিয়েছেন স্টেশন মাস্টার ও ট্রেনের প্রহরীকে। রাস্তার উন্নয়ন চাইতে গিয়ে জামালপুরের এমপি ডা. মুরাদ হাসানের মার খেয়েছেন এক আইনজীবী। অনুষ্ঠানে অতিথি না করায় উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান লাঞ্ছিত হয়েছেন খুলনার এমপি ননী গোপাল মন্ডলের হাতে। নাম উচ্চারণে ভুল করায় শিক্ষককে মেরেছেন সিলেটের এমপি মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী। ফরিদপুরের আবদুর রহমান পিটিয়েছেন স্কুল শিক্ষককে। পছন্দের লোককে চাকরি না দেয়ায় দলবল নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজে হামলা চালিয়েছেন এমপি মকবুল শাহরিয়ার। কলেজের গাছ কাটার অপরাধে ঠাকুরগাওয়ের এমপি হাফিজউদ্দিন আহমেদের চড় খেয়েছিলেন অধ্যক্ষ। অধ্যক্ষ সবাইকে শিক্ষা দেন, আর এমপি সাহেব তাকে একটু হাতেকলমে শিক্ষা দিয়েছেন। নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের লাইসেন্স পিস্তলের গুলিতে তারই গাড়িতে মারা গিয়েছিলেন এক যুবলীগ কর্মী। এসবই পত্রিকায় ছাপা হওয়া এমপিদের গুণের বিবরণের একাংশ মাত্র। গুণধর, সাহসী এমপিদের গুণের পুরো বিবরণ দিতে গেলে আসলে জায়গায় কুলাবে না।

এমপিদের গুণ শুধু মারামারিতে সীমাবদ্ধ নয়। তাদের হরেক গুণের কথা শোনা যায়। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, কমিশনবাজি, তদ্বিরবাজি, দখলবাজি, দল বাদ দিয়ে নিজের আত্মীয়-স্বজন নিয়ে সিন্ডিকেট বানানো- এসব তো আছেই। আছে টাকা নিয়ে চাকরি না দেয়ার মত গুণও। আছে টিআর-কাবিখার টাকা মেরে দেয়ার এন্তার অভিযোগ। বীর এমপি রনি নাকি তার এলাকায় একটি কাগুজে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে বরাদ্দ এনে পুরোটাই হাপিস করে দিয়েছেন। অবশ্য তার উপায় ছিল না। কারণ যে প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা এসেছে, সে নামে কোনোদিন কোনো প্রতিষ্ঠান কোনোদিন ছিলই না। তাই টাকা তো আর জলে ফেলা যায় না। তারচেয়ে মেরে দেয়া ভালো। রনি তার এলাকায় ২ শতাংশ জমি একবছরের জন্য লিজ নিয়ে সেখানে বেআইনীভাবে দোতলা ভবন বানিয়েছেন। সমস্যা আসলে মিডিয়াওয়ালাদের। কিছু হলেই তারা হামলে পড়েন। আরে ভাই, কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এমপি হয়েছেন। পাঁচ বছরে সেই টাকা সুদে আসলে তুলে আনতে হলে একটু এধারকা মাল ওধার, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, তদ্বিরবাজি তো করতেই হবে। আর এমপি সাহেবের তো এলাকায় থাকার জন্য একটা ভদ্রস্ত বাড়ি লাগে, হোক সেটা সরকারি খাসজমির ওপর।

এমপি সাহেবদের গুণের কোনো কমতি নেই। বছরখানেক আগে এমপি হোস্টেলের ভেতর থেকে এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কঠোর নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকা এমপি হোস্টেলে এই হতভাগা নারী কোত্থেকে এলেন, কার সঙ্গে এলেন, কিভাবে মারা গেলেন কিছুই জানা যায়নি। এমপিদের মর্যাদা বলে কথা, কেউ আর এই খুনের ঘটনা নিয়ে খোড়াখুড়ি করেনি। না জানি কেচো খুড়তে গিয়ে কোন অজগর বেরিয়ে পড়ে। নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা বলেই এমপিরা সব গোপন কাজের জন্য বেছে নেন এমপি হোস্টেলকেই। সপ্তম সংসদে চাঁদপুরের সাংসদ আলী হায়দার খান তার এক ‘ভাসমান’ বান্ধবীকে নিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। বহুল আলোচিত সাংসদ গোলাম ফারুক অভি নাকি পর্নোগ্রাফির শ্যুটিং করেছিলেন এমপি হোস্টেলে নিজের রুমে। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে এমপি হোস্টেল মানে সত্যি স্বর্গের কাছাকাছি কিছু, এখানে যা ইচ্ছা তাই করা যায়, যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়ে থাকা যায়, যাকে ইচ্ছা তাকে থাকতে দেয়া যায়, যাকে ইচ্ছা তাকে মেরে ফেলা যায়। দেশের সবচেয়ে নিরাপদ আবাসিক এলাকা।

আমরা এমপি সাহেবদের ভোট দেই সংসদে গিয়ে আমাদের পক্ষে কথা বলার জন্য, আইন প্রণয়নের জন্য। কিন্তু সংসদে যাওয়ার সময়টাই তাদের সবচেয়ে কম। বিরোধী দল তো জনগণের দেয়া দায়িত্ব ভুলে গিয়ে বছরের পর বছর সংসদ বয়কট করে যান। সরকারি দলের এমপিরাও সময়মত সংসদে যেতে চান না। তাই তো কোরামের অভাবে সংসদ অধিবেশন শুরু করতে খালি দেরি হয়ে যায়। আর লাখ লাখ টাকা চলে যায় সংসদ ভবনকে ঘিড়ে থাকা সুন্দর লেকের জলে। আসলে আমরা বুঝতে চাই না সংসদ ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে রাজা উজির মারলে কি আর চলে জনপ্রতিনিধিদের। ঢাকায় থাকলে সচিবালয়, বিভিন্ন অফিসে অফিসে তদ্বির; এলাকায় থাকলে মারপিট, উপজেলা-ইউএনওদের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি-সময় কোথায় সংসদে যাওয়ার। আর যখন সবাই মিলে সংসদে যান, তখন সেটার ট্যাগ হয়ে যায় ১৮+। আমাদের সাংসদরা বিশেষ করে নারী সাংসদরা যেভাবে প্রতিযোগিতা করে খারাপ কথা বলেন, লজ্জায় আমাদের কান লাল হয়ে যায়। অত সুশীল হলে কী আর দলে অবস্থান টিকিয়ে রাখা যায়।

আমরা দেখি যারা সংরক্ষিত আসনে বসেন তারা খারাপ কথা বলেন বেশি, ভবিষ্যতে নিজেদের আসন সংরক্ষিত রাখতেই বোধহয়। আর তাদের তো আমরা ভোট দেইনি, তাই আমাদের কানের রং নিয়ে তাদের অত ভাবনাও নেই। সংসদে একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ লাইব্রেরি আছে। একটু খোঁজ নিলেই দেখবেন সেখানে মোটা মোটা বইয়ে ধুলার স্তরও মোটা হচ্ছে। এমপিরা খুব কমই পা মারান সেদিকে। আচ্ছা শুরুতে যে বলছিলাম জীবনে একবার এমপি হলেই চলে। কেন? পাঁচ বছরের জন্য স্বর্গের কাছাকাছি একটি বাসা তো আছেই, আছে ভালো বেতন-ভাতা, বিদেশ সফর, শুল্কমুক্ত গাড়ি, আবেদন করলেই প্লট। একজীবনে আর কি চাই। উত্তরার একটি ১০ কাঠার প্লট মানেই আজীবন নিশ্চিন্তি। যদি নিজে নাও থাকেন, বেঁচে দিলেই কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকা। একটি গাড়ি মানেই অন্তত এক কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দেয়ার সুযোগ। তারমানে আপনি যদি মারামারি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, তদ্বিরবাজি, দখলবাজি নাও করেন; তাও একজীবন পার করে দেয়ার মত সঞ্চয় করা সম্ভব। তারপরও এমপি সাহেবরা এমপি হওয়ার পর যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান। নির্বাচনের সময় যার আয়কর বিবরণীতে আয় হাজার টাকার ঘরে, তিনিই এক বছরের মধ্যে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে শুল্কমুক্তির সুযোগে আড়াই কোটি টাকার গাড়ি কিনে ফেলেন। আমরা কেউ কখনো জানতেও চাই না, ওই ৫০ লাখ টাকাই আপনি পেলেন কোথায়? আপনার আয়কর ফাইলে তো এটা ছিল না।

মাননীয় সংসদ সদস্যদের কাছে এই প্রশ্ন করাটা বেয়াদবী হয়ে যাবে। এমপি সাহেবরা যে শুধু স্বর্গের কাছাকাছি বাসায় থাকেন, তা নয়, তাদের ক্ষমতাও প্রায় ঈশ্বরের কাছাকাছি। তারা যেখানেই যান, সব দরজা তাদের জন্য খোলা। তারা যা চান তাই হয়ে যায়। মানিক মিয়া এভিনিউর একপাশে সংসদ ভবন, একপাশে এমপি হোস্টেল। এমপিরা রাস্তা পেরুলেই সংসদে চলে যেতে পারেন। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশের সবচেয়ে চওড়া এই রাস্তায় পাঁচটি স্পিডব্রেকার বসানো হয়েছে এবং বিস্ময়কর হলেও সত্যি সেগুলো বসানো হয়েছে একরাতে। আগের সন্ধ্যায় সংসদে এমপিরা দাবি তুলেছেন, পরদিন সকলে উঠে দেখেন হয়ে গেছে। বললেন, হয়ে যাও, হয়ে গেল। অথচ আমাদের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে একটি স্পিডব্রেকার বসাতে শিক্ষার্থীদের দিনের পর দিন মানববন্ধন করতে হয়, মাঝে মধ্যে গাড়ি ভাঙচুরও করতে হয়।

তবে গোলাম মাওলা রনি অবশ্য সবাইকে ছাড়িয়ে উঠে গেছেন অন্য উচ্চতায়। তাকে এই উচ্চতায় তুলে আনার কৃতিত্ব অবশ্য মিডিয়ারই। প্রায় সব বিষয়ের বিশেষজ্ঞ রনি প্রায় নিয়মিতই মধ্যরাতে টিভি টক শোতে জাতিকে জ্ঞান দিতেন, লেখালেখিও করতেন নানা বিষয়ে। মিডিয়ার সৃষ্টি এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এখন লাথি মেরেছে মিডিয়াকেই। এমপি হওয়ার আগে রনি নাকি কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছেন। এখনও একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদক তিনি। তারওপর জনপ্রতিনিধি। তাই জাতিকে জ্ঞান দেয়ার, সাংবাদিকদের লাথি মারার সকল অধিকার তার আছে। তাই কেন যে সাংবাদিকরা এমন ক্ষেপে উঠলেন, বুঝি না। রনিকে গ্রেপ্তার করতে হবে, রনিকে গ্রেপ্তার করতে হবে- সাংবাদিকদের এমন ঘ্যানঘ্যানানির ঠেলায় বিরক্ত হয়েই শেষ পর্যন্ত জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তার করানো হয়েছে তাকে, পাঠানো হয়েছে কারাগারে। কিন্তু রনিকে গ্রেপ্তার করার যে কৃতিত্ব আওয়ামী লীগ দাবি করছে, তার পুরোটা তাদের দেয়া যাচ্ছে না। ঘটনার পরপরই গ্রেপ্তার করা হলে দেয়া যেতো। কিন্তু চারদিনের নানা ঘটনা, নানা নাটকীয়তায় ঘটনায় অনেক ডালপালা যুক্ত হয়েছে। ক্রিকেট খেলায় টাইমিং একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। টাইমিং ভালো হলে যে শটে ছক্কা হতে পারে, একটু গড়বড় হলে তাতেই আউট হওয়ার ঝূঁকি। কথায় বলে না সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। আওয়ামী লীগেরও খালি সবকিছুতে দেরি হয়ে যায়, টাইমিং গড়বড় হয়ে যায়। নিন্দুকেরা বলছেন, সাংবাদিক পেটানোর অপরাধে নয়, প্রভাবশালী সালমান এফ রহমানের সঙ্গে লাগতে গিয়েই বিপাকে পরেছেন রনি। তাছাড়া টক শোতে উল্টাপাল্টা বলে রনি অনেক আগেই দলের শীর্ষ নেতার বিরাগভাজন হয়েছেন। ঘটনাকে যতই রনি বনাম সালমান, রনি বনাম আওয়ামী লীগ রং দেয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন; রনি যে গণমাধ্যমের চিহ্নিত শত্রু তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দুঃখ হলো মিডিয়ারই কেউ কেউ তাকে শেল্টার দেয়া বা হিরো বানানোর চেষ্টা করছেন। আমরা খুশী হতাম অপর্ণা সিংহকে মারার অপরাধে যদি কামাল মজুমদারকে গ্রেপ্তার করা হতো, আমরা আরো খুশী হতাম যদি সাগর-রুনীর হত্যা রহস্য উদঘাটন করা হতো। তবে কামাল মজুমদারকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলেই, রনিকে করা যাবে না, এমন কোনো কথা নেই।

পাদটীকা

সব দেখেশুনে আমার কাছে মনে হয়েছে, এমপি মানে মেম্বার অব দ্য পার্লামেন্ট নয়, এমপি মানে মোস্ট পাওয়ারফুল। তবে সব এমপি সেই ক্ষমতার প্রয়োগ করেন না, কেউ কেউ জনগণের পাওয়া ভোটকে তাদের সেবা করার দায়িত্ব মনে করেন। পেশাগত কারণে দীর্ঘদিন সংসদ কাভার করেছি। এছাড়া সপ্তম ও অষ্টম সংসদের সদস্যদের জীবনীভিত্তিক ‘প্রামাণ্য সংসদ’এর প্রকাশনায় জড়িত থাকার সুবাদে অনেক এমপিকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। অতি সাধারণ জীবনযাপন করা অসাধারণ সব এমপি দেখেছি। সত্যি সত্যি তাদের অনেকের প্রজ্ঞা দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। আগে দেখতাম সিনিয়র সাংসদরা সংসদে বক্তৃতা দেয়ার সময় লাইব্রেরির একটা ছোটখাটো অংশ তুলে নিয়ে আসতেন। আগে ভালো এমপির সংখ্যা বেশি ছিল। আস্তে আস্তে সে সংখ্যা কমে আসছে। রাজনীতিবিদদের জায়গা দখল করছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এখনও ভালো এমপির সংখ্যাই বেশি। অল্পসংখ্যক মোস্ট পাওয়ারফুল এমপির কারণেই বদনাম হয় সবার। আশা করি আবার দিন বদলাবে। তরুণরা যখন নেতৃত্ব নেবে, তারা সত্যি সত্যি সংসদকে সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলবেন। সংসদ হবে সত্যি সত্যি জতির মর্যাদার প্রতীক। নির্বাচিত হওয়াকে তারা ক্ষমতা নয়, জনগণের সেবা করার সুযোগ হিসাবেই নেবেন। তবে গোলাম মাওলা রনির মত তরুণরা যত কম নির্বাচিত হবেন, ততই ভালো।

প্রভাষ আমিন, এডিটর, নিউজ এন্ড কারেন্ট এফেয়ার্স,এটিএন নিউজ।।
probhash2000@gmail.com

অতিথি লেখক