প্রসঙ্গঃ সঠিক সংবাদ এবং সুষ্ঠু সাংবাদিকতা

প্রসঙ্গঃ সঠিক সংবাদ এবং সুষ্ঠু সাংবাদিকতা
প্রভাষ আমিন: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২, সন্ধ্যায় অফিসে বসে আছি। আমার ঘাড়ের ওপরে ডেস্কে বসে ছিল মুন্নী সাহা। প্রণব সাহা আর শহীদুল আজমও ছিলেন আমাদের রুমে। আমরা কথা বলছিলাম, বরেণ্য সাংবাদিক আতাউস সামাদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে। উনি তখন সংকটাপন্ন অবস্থায় অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি। হঠাত্ সামনে ঝোলানো অনেকগুলো টিভি স্ক্রিনের অন্তত দুটিতে লাল রংয়ের ব্রেকিং নিউজ—বরেণ্য সাংবাদিক আতাউস সামাদ আর নেই। একটা কষ্টের দলা গলায় আটকে গেলেও অবিশ্বাস করিনি। হতেই পারে। কিন্তু তখনও আমাদের রিপোর্টার নিশ্চিত করেনি। তাই অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু তর সইছিল না আমাদের রিপোর্টারদের। কয়েকজন তো এসে রীতিমতো অভিযোগের সুরে বললেন, সবাই সামাদ ভাইয়ের খবর দিয়ে দিচ্ছে, আর আপনারা কী করছেন? আমি তাদের বললাম, সবাই দেয়নি, মাত্র দুটি চ্যানেল ওনার মৃত্যু সংবাদ দিচ্ছে। আমরা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের সোর্সের দুর্বলতা দেখে রিপোর্টাররা হতাশ হয়ে গজগজ করে ফিরে গেল। এরই মধ্যে চিফ রিপোর্টার মাশহুদ তার আদালত কানেকশনে আতাউস সামাদের ভাগ্নে অ্যাডভোকেট আনিসুল হককে ফোনে পেয়ে গেলেন। যা শুনলাম, তাতে আমার শোক পরিণত হলো ক্ষোভে। সামাদ ভাই তখনও মারা যাননি, তবে তার অবস্থা সংকটাপন্ন। কিন্তু মৃত্যুর আগেই মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হওয়ায় পরিবারের পক্ষ থেকেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন আনিসুল হক আর সবাইকে দোয়া করতে বলেন। আমি ততক্ষণে আমার ডেস্কটপে ব্রেকিং নিউজের ফাইল ওপেন করে বসে আছি। প্রতিদ্বন্দ্বী দুুটি ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল যখন মৃত্যু সংবাদ দিচ্ছে, তখন এটিএন নিউজে ব্রেকিং নিউজ ‘বিশিষ্ট সাংবাদিক আতাউস সামাদের অবস্থা সংকটাপন্ন, পরিবারের পক্ষ থেকে দোয়া কামনা।’ অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যে চ্যানেল দুটি কোনোরকম ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়াই মৃত্যু সংবাদটি নামিয়ে ফেলে। চ্যানেল দুটি যখন সামাদ ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ প্রচার করে তখন বাজছিল সাড়ে ৭টা। শেষ পর্যন্ত রাত সাড়ে ৯টায় ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

চ্যানেল দুটির কর্তৃপক্ষ কৃতিত্ব দাবি করে বলতে পারেন, আমরা তো মিথ্যা সংবাদ দিইনি, বরং সবার আগেই দিয়েছি। কিন্তু এই সত্য সংবাদ আর এগিয়ে থাকা কি সত্যিকারের সত্য আর সত্যিকারের এগিয়ে থাকা? সংকটাপন্ন, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, লাইফ সাপোর্টে, কোমায়, ডিপ কোমায় থাকা আর মৃত্যু তো এক নয়। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে বেশিরভাগ মানুষই হয়তো নিশ্চিত মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যান। কিন্তু যতক্ষণ ডাক্তার মৃত্যুর ঘোষণা না দেবেন, ততক্ষণ কাউকে মৃত বলা যাবে না। বাসায় মারা যাওয়ার পরও তো স্বজনরা রোগী নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যান। সেখানে ডাক্তার রোগীকে মৃত ঘোষণা করেন। এই যে নেলসন ম্যান্ডেলা এতদিন ধরে হাসপাতালে আছেন, লাইফ সাপোর্টে আছেন, গোটা পৃথিবী তাঁর মৃত্যু সংবাদ শোনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত; তারপরও বিশ্বের কোনো একটা সংবাদ মাধ্যমও তো তাঁর আগাম মৃত্যুর খবর প্রচার করেনি। আর আমরা ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন একজন সিনিয়র সাংবাদিকের মৃত্যুর সংবাদটি যাচাই করতে পারলাম না! আতাউস সামাদের মতো একজন সাংবাদিকের জীবন থেকে দুই ঘণ্টা সময় কেড়ে নিলাম আমরা সাংবাদিকরাই।

সামাদ ভাইয়ের ক্ষেত্রেই এই ঘটনাটি ঘটায় আমি আরও বেশি কষ্ট পেয়েছি। কারণ, সামাদ ভাই ছিলেন খুব খুঁতখুঁতে একজন সাংবাদিক, পুরোদস্তর রিপোর্টার। বস্তুনিষ্ঠতা আর তথ্যের নির্ভুলতার ব্যাপারে একচুল ছাড় দেননি কখনো। সারাজীবন মাঠে-ময়দানে সাংবাদিকতা করেছেন, আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে ছাত্রদের সাংবাদিকতা শিখিয়েছেনও। সবসময় তিনি বস্তুনিষ্ঠতা আর তথ্যের নির্ভুলতার কথা বলতেন। হায়, সেই তাঁকেই কিনা তাঁর মৃত্যু সংবাদ নিয়ে এমন মিথ্যার বেড়াজালে জড়াতে হলো। সেই চ্যানেল দুটি মৃত্যু সংবাদটি নামিয়ে ফেললেও, মৃত্যু ঠেকাতে পারেনি। সামাদ ভাইকে মরিয়া প্রমাণ করিতে হইয়াছে যে তিনি মরেন নাই। মৃত্যুর ওপারের জগত্ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। তবে আমি নিশ্চিত, দুই ঘণ্টা আগেই মরে গেছেন—এটা জানলে সামাদ ভাই খুবই রাগ করতেন এবং সেই টিভি চ্যানেলে ফোন করে লম্বা ঝাড়ি দিতেন।

দীর্ঘদিন রিপোর্টিং করেছেন সামাদ ভাই। কিন্তু বয়সের কারণে যখন ছাড়তেই হলো, তখন হলেন গণমাধ্যমের অনুরাগী অনুসারী। কোথাও কোনো অসঙ্গতি দেখলেই ফোন করতেন। সামাদ ভাইয়ের ফোন মানেই লম্বা আলাপ। তাই অনেক সময় পিক আওয়ারে চিফ রিপোর্টার-নিউজ এডিটররা তার ফোন এড়াতে চাইতেন। প্রথম আলোতে থাকার সময় বসদের এড়াতে চাওয়ার কারণে অনেকবারই আমার সৌভাগ্য হয়েছে সামাদ ভাইয়ের ফোন রিসিভ করার। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, সামাদ ভাইয়ের সেই ফোন ছিল আসলে কমপক্ষে ৪৫ মিনিটের একটি অতি প্রয়োজনীয় সাংবাদিকতার ক্লাস। আমি জানি, আমাদের সমসাময়িক বা সিনিয়রদের অনেকেরই এই অভিজ্ঞতা আছে। বস্তুনিষ্ঠতা আর নির্ভুল তথ্যের একরোখা অনুগামী ছিলেন বলেই দেশের সব গণমাধ্যম যখন এরশাদের স্বৈরশাসনের যাতাকলে পিষ্ট, তখন বাংলাদেশের কণ্ঠ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন বিবিসির আতাউস সামাদ। তাঁর সঙ্গে মাঠে রিপোর্টিং করার সৌভাগ্যও হয়েছে আমার। প্রথম দিকে অবশ্য তিনি ছিলেন আমাদের কাছে স্টার। সামাদ ভাই সারাজীবন মাঠে, প্রেসক্লাবে, ক্লাসরুমে এমনকি টেলিফোনিক ক্লাসেও যে নির্ভুল তথ্যের কথা বলে গেলেন, একাধিক সূত্র থেকে যাচাই করার কথা বলে গেলেন; তা থেকে আমরা কতটুকু শিখেছি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আজকের এই লেখা।

মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরেকটা দুঃখের কথা বলে নিই। পরদিন জাতীয় প্রেসক্লাবে সামাদ ভাইয়ের জানাজা এবং পরে একটি স্মরণ সভায় গিয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। দুই জায়গাতেই আওয়ামী লীগ নেতা এবং আওয়ামী লীগপন্থি সাংবাদিকদের উপস্থিতি ছিল হাতেগোনা। বাংলাদেশে মোটামুটি বিখ্যাত কেউ মারা গেলে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তার মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। কিন্তু আতাউস সামাদ সে সম্মান পাননি। কেন পাননি? কারণ তিনি সাংবাদিকদের মধ্যে বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আর শহীদ মিনারে সম্মান জানানোর বিষয়টি সমন্বয় করে আওয়ামীপন্থি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। তাই আতাউস সামাদের মতো তারকা সাংবাদিকেরও সে সম্মান জোটেনি। শহীদ মিনার কি তাহলে শুধু আওয়ামীপন্থিদের জন্য সংরক্ষিত? যারা ব্যক্তিগতভাবে সামাদ ভাইকে চিনতেন তারা জানেন, বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি কট্টর ছিলেন না, ছিলেন অনেক বেশি পেশাদার। সেই তাঁকেও মৃত্যুর পর দলীয় রাজনীতির শিকার হতে হলো। এই কষ্টটা আমার যাবে না কখনো। আমরা সাংবাদিকরা কবে যে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সত্যিকারের পেশাদার হতে পারব।

যাক ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। শুধু আতাউস সামাদই নন, প্রায়শ অনেকেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ভুল খবরের শিকার হন, দর্শকরা ভুল তথ্য দেখে বা শুনে বিভ্রান্ত হন। বাংলাদেশে টিভি চ্যানেলের বাম্পার ফলন হয়েছে এখন। কোয়ানটিটি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোয়ালিটি বাড়লে এই ফলন আমাদের মননের পুষ্টি বাড়াতে পারত। কিন্তু হয়েছে উল্টো, আমরা ভুগছি পুষ্টিহীনতায়। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে থাকতে আমরা পা দিই ভুল তথ্যে, বিভ্রান্তিকর তথ্যের ফাঁদে। সাধারণত কোনো বড় দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়ে। কিন্তু ইদানিং দেখছি মাঝে মাঝে টিভি চ্যানেলগুলোর স্ক্রলে মৃতের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কোনো যাচাই বাছাই ছাড়াই স্ক্রলে দিয়ে দিই, অমুক স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আসলে ৫ জন মারা গেছে, বাকি ৫ জন গুরুতর আহত। হয়তো পরে হাসপাতালে নেয়ার পর মারা গেছেন আরও ২ জন। তার মানে সেই দুর্ঘটনায় মোট মারা গেছেন ৭ জন। শেষ পর্যন্ত টিভি চ্যানেলগুলো মৃতের সংখ্যা কমিয়ে ৭-এ আনতে বাধ্য হয়। নিজেদের ভুল ঢাকতে আমরা মনে মনে হলেও কামনা করি, ইশ হাসপাতালে আরও ৩ জন মারা গেলেই তো আর আমাদের ভুলটা হয় না। আসলেই সত্যি স্বীকার করছি, নিজের ভুল এড়াতে অনেক সময়ই আমরা এমন অমানবিক হয়ে উঠি।

পুলিশের নির্দিষ্ট সোর্স থাকে। কিন্তু সাংবাদিকদের সোর্সের কোনো সীমা নেই। যে কেউ তথ্যের উত্স হতে পারেন। অনেকেই আমাদের জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা অত খবর পান কী করে? আসলে সত্যি আমরা জানি না। অজানা, অচেনা লোক ফোন করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের ব্যাপারে তথ্য দেন। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ভোরের কাগজে আমাদের সহকর্মী জায়েদুল আহসান পিন্টুর বাসা ছিল যাত্রাবাড়ির ধনিয়ায়। একবার যাত্রাবাড়ি থেকে বাসে করে বাংলা মোটর অফিসে আসার পথে বাসে সে আলোচনা শুনতে পেল, মিরপুর চিড়িয়াখানায় একটি বাঘ মারা গেছে। আইলসা পিন্টু নিজে না গিয়ে সুপন রায়কে পাঠিয়ে দিলেন চিড়িয়াখানায়।

পরে সেই বাঘের মৃত্যুর ঘটনা ভোরের কাগজে খুব গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল এবং তখন বেশ হইচইও হয়েছিল। সুপনকে পরে অনেকদিন আমরা বাঘা সুপন নামে ডাকতাম। সুপন রায় পরে সাংবাকিতায় তারকাখ্যাতি পেয়েছেন। কিন্তু নিশ্চয়ই সুপনও স্বীকার করবেন, সেই বাঘের মৃত্যুর রিপোর্ট তার রিপোর্টিং ক্যারিয়ারেরই টার্নিং পয়েন্ট ছিল। আলোচিত সেই রিপোর্টের সোর্স হলো—বাসের আলাপচারিতা। এমন অনেক সূত্র থেকে আমরা প্রতিদিনই অনেক খবর পাই। কিন্তু সাংবাদিকের দায়িত্ব হলো, পাওয়া খবরগুলো ফিল্টার করা, যাচাই করা, প্রয়োজনে একাধিক সূত্র থেকে নিশ্চিত করা, সম্ভব হলে নিজে উপস্থিত থেকে নিশ্চিত করা; তারপর দর্শকদের জন্য প্রচার করা। মাঝে মাঝে এমন ফোনও আসে, অমুক জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় তিনজন মারা গেছে। নিজের চোখে লাশ দেখে আসলাম। তিনি কিন্তু পুরোপুরি মিথ্যা বলেননি। আবার তার কথা শুনে সেটা স্ক্রলে দিয়ে দিলে বড় ভুল হবে। সোর্স যেটা জানিয়েছেন, সেটা সত্যি। কারণ সেখানে তেমন একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিজের চোখে তিনটি মরদেহ দেখার তথ্যটিও পুরোপুরি মিথ্যা নয়। কারণ তিনি হয়তো সেখানে রক্তাক্ত এবং অজ্ঞান অবস্থায় তিনজনকে পড়ে থাকতে দেখেছেন, যাদের সাদা চোখে মৃতই মনে হয়। কিন্তু একজন সাধারণ পথচারীর চোখ আর একজন সাংবাদিকের চোখ এক নয়। একজন সাংবাদিক কখনোই মরার মতো পড়ে থাকা কাউকে মৃত মনে করবেন না। তাই যাচাই ছাড়া কোনো সংবাদ প্রচার করা যাবে না। কিন্তু এগিয়ে থাকার ইঁদুর দৌড়ে থাকা আমরা খবর পেলেই সবার আগে দেওয়ার লোভে তা দিয়ে দিই। পরে তা গিলতেও বাধ্য হই।

এই প্রতিযোগিতার সবচেয়ে বিপদজনক প্রবণতা হলো নির্বাচনের ফলাফল প্রচার। সমপ্রতি ৫টি সিটি করপোরেশন, বিশেষ করে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল প্রচার করতে গিয়ে এই বিপদজনক প্রতিযোগিতার উদগ্র প্রকাশ দেখেছি আমরা। আগে যখন একমাত্র বিটিভি ছিল, তখন নির্বাচনের ফলাফল মানেই উত্সব, দিনভর বাংলা সিনেমা দেখা। তারপর আস্তে আস্তে চ্যানেলের সংখ্যা বাড়তে থাকল, বাড়ল প্রতিযোগিতা। কিন্তু ফলাফল আগে প্রচারের এই প্রতিযোগিতা রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ, পৌঁছে গেছে অসুস্থতার পর্যায়ে। গত জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল প্রচারের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলে নিই। তখন আমি এনটিভিতে কাজ করি। নির্বাচনী ফলাফল প্রচার ডেস্কের দায়িত্ব ছিল আমার কাঁধে। আমি সব প্রতিনিধিদের বলে দিয়েছি, আমরা শুধু রিটার্নিং অফিসারের দেওয়া ফলাফল প্রচার করব। তাতে শুরুতে এনটিভি বেশ পিছিয়ে ছিল। ফলে অফিসের সবাই খেপে গেল আমার ওপর। বারবার এসে বলতে লাগল, অমুক টিভিতে এত আসন দেখাচ্ছে, আমরা এত পিছিয়ে কেন? বাইরের কেউ কেউ ফোন করে, এমনও বললেন, বিএনপি হেরে যাচ্ছে বলেই আমরা স্লো যাচ্ছি কি না।

এক পর্যায়ে এনটিভির তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েতুর রহমান বাপ্পীও নেমে এলেন। জানতে চাইলেন, আমরা পিছিয়ে কেন? কিছুটা রেগে গিয়ে আমি তাকে বলেছিলাম, প্লিজ আমাদেরকে আমাদের কাজটা করতে দিন। প্রয়োজনে কাল আমাকে শোকজ কইরেন বা স্যাক কইরেন। কিন্তু এখন আমি কোনো প্রশ্নের জবাব দেব না এবং ফলাফল যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে। আমার দৃঢ়তায় উনি ফিরে গিয়েছিলেন। ভাগ্যিস উনি আমার ওপর আস্থা রেখেছিলেন। মধ্যরাতে এনটিভির সকল স্টাফ এবং দর্শকরা বুঝলেন যে আমরাই ঠিক। কারণ ততক্ষণে হয়তো অন্য চ্যানেলগুলোও যোগ দিয়েছিল ফলাফলের মূলধারায়। আমার অবশ্য তখন অন্য চ্যানেল দেখার সুযোগ ছিল না। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল প্রচার নিয়ে চলেছে অসুস্থ ও অবৈজ্ঞানিক প্রতিযোগিতা।

সাধারণত রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে প্রাথমিক বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এছাড়াও প্রিজাইডিং অফিসার, অ্যাজেন্ট, প্রার্থী, প্রার্থী স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, পুলিশ, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকেও খণ্ডিত বা আংশিক ফলাফল পাওয়া সম্ভব। গণমাধ্যম কোন সূত্র থেকে ফলাফল সংগ্রহ করবে, সে বিষয়ে আইন বা বাধ্যবাধকতা নেই। এই সুযোগে চলছে এক ধরনের চরম স্বেচ্ছাচারিতা। আমার ব্যক্তিগত মত হলো, একটি সূত্র থেকে ফলাফল সংগ্রহ ও প্রচার। আর সে সূত্রটি হওয়া উচিত রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়। কিন্তু বিপদটা হলো, দূরের কেন্দ্র থেকে নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফলাফল রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে এসে প্রচার উপযোগী হতে অনেক সময় লেগে যায়। ততক্ষণ তর সয়না আমাদের। আমরা যেকেনো সূত্র থেকে পাওয়া ফলাফল প্রয়োজনীয় যাচাই বাছাই ছাড়াই প্রচার করতে থাকি সবার আগে দেওয়ার তাড়নায়।

আমি স্বীকার করছি, রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে পাওয়া ফলাফল প্রচারের পক্ষে হলেও সবসময় আমি তা অনুসরণ করতে পারিনি। চেষ্টা করেছি, কিন্তু একসময় সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপে হার মানতে হয়েছে। নইলে যে আমরা অনেক পিছিয়ে যাই! এই যেমন সর্বশেষ গত ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় ফলাফল প্রচার নিয়ে দারুণ হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এখন মানুষের হাতে রিমোট কন্ট্রোল থাকায় তারা নির্দিষ্ট কোনো টিভি দেখেন না। ঘুরেফিরে নানা টিভি মনিটর করেন। আমি নিশ্চিত ৬ জুলাই রাতে অনেকেই বিভ্রান্তিতে ঘুমাতে পারেননি। কোন টিভি বিশ্বাস করবেন? সেদিন সকালে এসেছিলাম বলে ক্লান্তিতে একটু আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। বাসায় যাওয়ার আগেই রাত একটায় অফিস থেকে শহিদুল আজম ফোন করে বললেন, অন্যরা তো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি কেন্দ্রের ফলাফল দিচ্ছে। আমরা কী করব? আমি বললাম, রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে যা পাওয়া যায়, সেটাই ফলো করেন। বাসায় ফিরে আমি নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। কিছুটা হীনম্মন্যতাও গ্রাস করল, আমরা কত পিছিয়ে, অন্যরা কত এগিয়ে। আবারও শুনতে হলো সেই পুরোনো অভিযোগ, এবার উল্টো করে, আওয়ামী লীগ হেরে যাচ্ছে বলেই কি আপনারা আস্তে আস্তে ফল দিচ্ছেন। কিচ্ছু বলতে পারিনি। কিন্তু রাত যত গড়াতে লাগল, হীনম্মন্যতার জায়গা নিলো বিভ্রান্তি।

যারা রিটার্নিং অফিসারের অফিস ফলো করছিলেন, তারা অনেক পিছিয়ে। যারা অন্য সূত্র ব্যবহার করছিলেন, তাদের কারোর সঙ্গে কারোটা মিলছিল না। একাধিক টিভি চ্যানেল সেদিন, এক সাথে দুই সূত্রের ফলাফল প্রচার করছিল। একদিকে অনেক পিছিয়ে থাকা রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ের ফল, অন্যদিকে অসমর্থিত সূত্র থেকে পাওয়া অনেক এগিয়ে থাকা ফল। একই টিভিতে দুই রকম ফল, চরম বিভ্রান্তির উদাহরণ দিতে সেই টিভির স্ক্রিনশট রেখে দেওয়া উচিত ছিল। এক পর্যায়ে গভীর রাতে একটি ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল বিএনপির সমর্থিত প্রার্থী এম এ মান্নানকে বিজয়ী ঘোষণা করে ব্রেকিং নিউজ প্রচার করে। তারা দাবি করে, ৩৯২ কেন্দ্রের সবগুলোর ফলই তাদের হাতে রয়েছে। সে অনুযায়ী এম এ মান্নান পেয়েছেন ৪ লাখ ৬৮ হাজার ভোট, আর আজমতউল্লা পেয়েছেন ৩ লাখ ১২ হাজার ভোট। দুই জনই পেয়েছেন রাউন্ড ফিগারের ভোট। ব্যবধান ১ লাখ ৫৬ হাজার। তাদের হিসাব অনুযায়ী কাস্টিং অবিশ্বাস্য—৮৫ শতাংশ। সেই রাতে স্বেচ্ছাচারিতা এমন চরম আকার ধারণ করে যে, এক টেলিভিশন আরেক টেলিভিশনকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে ফলাফল সমপ্রচার করে। হায়রে এগিয়ে থাকার কী প্রাণান্তকর চেষ্টা। জয়-পরাজয় বদলে যায়নি বটে, তবে শেষ পর্যন্ত দুইজনের ব্যবধান দাঁড়ায় ১ লাখ ৬ হাজার ৫৭৭ ভোট। সরকারি দলের প্রার্থী হেরে গিয়েছিলেন বলে রক্ষা। যদি বিরোধী দলের প্রার্থী হারতেন, আর ফলাফল এভাবে ওঠানামা করত, তাহলে কী হতো। ভাবতেই গা শিউড়ে উঠছে। এম এ মান্নান যদি দাবি করতেন, আমার বাকি ৫০ হাজার ভোট ফিরিয়ে দিন। ভাগ্য ভালো তিনি জিতেছেন। নইলে নিশ্চয়ই দাবি করতেন। যে চ্যানেলটি রাতে ব্যবধান দেখালো ১ লাখ ৫৬ হাজার, আর সকালে দেখালো ১ লাখ ৬ হাজার, তারা কীভাবে এই ৫০ হাজার ভোটের হিসাব মিলিয়েছিল জানি না। ক্ষমা চেয়েছেন বলেও শুনিনি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এটা আরেকটা সমস্যা। পত্রিকায় তবু ভুল নিউজ হলে পরে প্রতিবাদ ছাপানোর, নিজ থেকে ক্ষমা চাওয়ার বা লেখা প্রত্যাহারের সংস্কৃতি আছে। কিন্তু টেলিভিশনে তা নেই। টেলিভিশনে আমরা ভুল কিছু হলে স্রেফ গিলে ফেলি বা সুযোগমতো অস্বীকার করে বসি। আতাউস সামাদের মৃত্যু সংবাদ দুই ঘণ্টা প্রচারের পরও কাউকে ক্ষমা চাইতে দেখিনি। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, ভুল আমাদের হতেই পারে। তাই ভুল স্বীকারের সংস্কৃতিটাও গড়ে তোলা উচিত। জাতিকে প্রতিদিন টক শো-তে জ্ঞান দেব, ভুল স্বীকারের, ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার; আর নিজেরা সেটা মানবো না, তা তো হয় না, হওয়া উচিত নয়।

ফলাফল সংগ্রহে নানা সূত্র ব্যবহারের বিপদটা হলো, ছাড়া ছাড়া সূত্র থেকে তো আপনি পুরো রেজাল্ট পাবেন না। তাই একটা পর্যায়ে গিয়ে আপনাকে বিপদে পড়তে হবে। তাছাড়া বিভিন্ন সূত্র থেকে একই কেন্দ্রের ফলাফল বারবার পাওয়ার আশঙ্কা রয়ে যায়। তাতে ভোটের সংখ্যা বেড়ে যায়। সম্ভবত সেই রাতে এই বিপদেই পড়েছিল ব্যবধান বাড়িয়ে দেওয়া চ্যানেলটি। যদি গাজীপুরে কোনো চ্যানেলের ৩৯২ জন প্রতিনিধি থাকত, তাহলেই কেবল তাদের পক্ষে সবার আগে ফলাফল প্রচার সম্ভব ছিল। সরাসরি কেন্দ্র থেকে। এটা তো যেকোনো নির্বাচনেই বাংলাদেশে অসম্ভব। আপনি বিএনপি প্রার্থী থেকে ১০টি কেন্দ্রের ভোট পেলেন, গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পেলেন আরও ১০টি। কিন্তু দুই সূত্রের মধ্যে হয়তো কিছু কেন্দ্র কমন হয়ে গেছে। সেখানে হয়তো মোট ১৫টি কেন্দ্রের রেজাল্ট আছে। কিন্তু তারা দুই সূত্র যোগ করে প্রচার করছেন ২০টি কেন্দ্রের ফল। তাতে ভোটের সংখ্যা তো বেড়ে যাবেই। তাই রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়কে ফলো করে যাওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ। কিন্তু সেই নিরাপত্তাকে কেইবা কেয়ার করে। সবাই চায় এগিয়ে থাকতে।

এটা ঠিক সবার আগে সর্বশেষ সংবাদ দিতে পারাটা যেকোনো টেলিভিশন বা গণমাধ্যমের জন্য বড় কৃতিত্ব। যেখানে সবার আগে সংবাদ পাবে, দর্শক তো সেই টিভিই দেখবে। কিন্তু সবার আগে ভুল সংবাদ দেওয়া ভালো, নাকি সবার শেষে সঠিক তথ্য প্রচার করা উচিত? আমি ভাই এই প্রতিযোগিতায় বারবার ফেল করতেই চাই। কচ্ছপ আর খরগোশের দৌড় প্রতিযোগিতার হারজিতের গল্প তো আমাদের সবারই জানা। অল্পের জন্য গাজীপুরে বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছি আমরা, মানে ইলেকট্রনিক মিডিয়া। কিন্তু এটা হওয়া উচিত আমাদের জন্য ওয়েক আপ কল। কারণ সামনেই জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনে এ ধরনের ছোটখাটো ভুল বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ওলটপালট হয়ে যেতে পারে রাজনৈতিক পরিস্থিতিই। তাই এখনই সময় কিছু একটা করার। সরকার বা নির্বাচন কমিশন কিছু করার আগে সচেতন হওয়া উচিত আমাদের নিজেদেরই। ডাবল চেক ছাড়া কোনো নিউজ প্রচার না করা, ছাড়া ছাড়া সূত্র থেকে নির্বাচনী ফলাফল প্রচার না করে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ের ফলের জন্য অপেক্ষা করা আর ভুল হলে ক্ষমা চাওয়া—এই কয়েকটা সাংবাদিকতার প্রাথমিক পাঠ কি আমরা মেনে চলতে পারি না? তবে আমার ধারণা, অন্তত নির্বাচনী ফলাফল প্রচারের ব্যাপারে একটা কোনো নীতিমালা থাকা প্রয়োজন, যেটা সবাই মেনে চলবেন। নির্বাচন কমিশন এখনই, মানে নির্বাচনী ডামাডোল শুরুর আগেই এ ব্যাপারে নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। প্রয়োজনে এজন্য টেলিভিশনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বসে তাদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।

দর্শকদের সময়মতো সঠিক তথ্য দিতে না পারি, ভুল তথ্য দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করার কোনো অধিকার তো নিশ্চয়ই আমাদের নেই।

প্রভাষ আমিন: এডিটর, নিউজ এন্ড কারেন্ট এফ্যায়ার্স, এটিএন নিউজ।

অতিথি লেখক