তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার

তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: দেশজুড়ে তামাক চাষ বন্ধ ও তামাকের ভয়াবহতা সম্পর্কে গনসচেতনামুলক প্রচার আরও জোড়ালো করা প্রয়োজন। সরকারী ও বেসরকারীভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে কৃষকদের সবুজ ফসলাদী চাষে উদ্বুদ্ধ ও সহযোগীতা করে তামাক চাষ বন্ধ করতে হবে। এতে করে আমাদের বনাঞ্চল রক্ষা পাবে, পাশাপাশি চরমভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে লাখ লাখ মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় বলা হয়েছে, বিড়ি-সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যে নিকোটিন, ডিডিটি, কার্বন মনোক্সাইড, টার বা আলকাত্রা, আর্সেনিক, মিথানল, ন্যাপথালিন, বেনজোপাইরিন, সায়ানাইড, এমোনিয়া, অক্সিডেন্টসহ ৪০০০ এর বেশী ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। যার মধ্যে ৬০টি সরাসরি ক্যান্সার সৃষ্টির সাথে জড়িত। তামাক সেবন ও ধূমপানে বিভিন্ন প্রকারের ক্ষতি হয়ে থাকে। তামাকের ভয়াবহতা এবং বাংলাদেশ ২০০৯ সালে গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) এর পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে ৪৩.৩% মানুষ (পুরুষ ও নারী) তামাক (বিড়ি-সিগারেট, জর্দা, গুল ইত্যাদি) ব্যবহার করে। এতে দেখা যায়, দরিদ্র (৫৫.৬%) ও নিরক্ষরদের (৬২.৯%) মধ্যে তামাক সেবনের হার হার বেশি। এ বিপুলসংখ্যক মানুষের ধূমপান ও তামাক সেবনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও উন্নয়নের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এছাড়া খাদ্যেও জমিতে তামাক চাষ খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলছে। বিড়ি কারখানা নারী, শিশুসহ শ্রমিকদেও মারাত্মক রকম কম মজুরি দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। যে কারণে তাদের দরিদ্রতা দূর হচ্ছে না। বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে এত তামাক চাষ হয়,অসংখ্য বিড়ি কারখানা রয়েছে তারপর সে এলাকার মানুষ ঠিকমত খেতে পায় না। মঙ্গার প্রভাব সেখানে ব্যাপক। এসব দিক বিবেচনা করে তামাকের ব্যবহার ও তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
২০০৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় বলা হয়,তামাক সেবন ও ধূমপানের কারণে দেশে ১২ লক্ষ মানুষ ৮টি প্রধান রোগে (ক্যান্সার, যক্ষা, ডায়াবেটিস, হাঁপানি, হৃদরোগ, বার্জাজ ডিজিজ ইত্যাদি) আক্রান্ত হচ্ছে। যার মধ্যে বছরে ৫৭,০০০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছে এবং ৩,৮২,০০০ মানুষ পঙ্গত্ব বরণ করছে। যদিও সে সময়ে তামাক ব্যবহারকারীর হার ও সংখ্যা-দুটোই কম ছিল। তবু সে পরিসংখ্যান অনুযায়ীও বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে যদি ২৫ ভাগ মানুষও সরকারী স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে সেবা গ্রহণ করে তবে যে ব্যয় হয় তা তামাক খাত থেকে প্রাপ্ত রাজস্বেও চেয়ে অনেক অনেক বেশি। ২০০৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপরিল্লিখিত গবেষণার আলোকে ২০০৭ সালে অধ্যাপক আবুল বারাকাত এর নেতৃত্বে এইচডিআরসি’র গবেষণায় বলা হয়েছে,বাংলাদেশে সরকার সকল প্রকার তামাক থেকে রাজস্ব পায় ৫,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শুধু ২৫ ভাগ রোগীর চিকিৎসাবাবদ সরকারী ব্যয় ১১,০০০ কোটি টাকা। যেখানে ঘাটতি ৬,০০০ কোটি টাকা। এছাড়া ধূমপান ও তামাকজনিত রোগে আক্রান্তদের ব্যক্তিগত আর্থিক ক্ষতিও অনেক। তামাক সেবীদের তামাকের জন্য ব্যয় করা অর্থের ৬৯ভাগ যদি খাদ্যের পেছনে ব্যয় করা হয় তবে অপুষ্টির কারণে যেসব শিশু অকালে মারা যায় তার ৫০ ভাগ শিশুকে বাঁচানো সম্ভব। ২০০৯ সালে ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দরিদ্র বিড়ি সেবনকারীরা প্রতিদিন গড়ে ৮ কোটি টাকা এবং প্রতিবছর প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে দেশে ৭২ লাখ অপুষ্ট শিশুর প্রত্যেককে এক গ্লাস দুধ অথবা ৫৩ লাখ অপুষ্ট শিশুর প্রত্যেককে এক গ্লাস দুধ ও একটি ডিম দেয়া সম্ভব,যা অপুষ্টিজনিত মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। বিশ্ব ব্যাংক এর এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ যদি কার্যকরভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তবে ১৮.৭ভাগ কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। প্রতি কেজি তামাক শুকানোর জন্য ২৫কেজি কাঠ পোড়াতে হয়। এতে ধ্বংস হচ্ছে বনজ সম্পদ ফলে ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ। তামাক পাতা একটি চুল্লির মধ্যে আগুনের তাপের সাহায্যে শুকানো হয়। এতে বাংলাদেশের বনজ সম্পদ ধবংশ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর যত পরিমাণ বৃক্ষ নিধন হয়,তার ৩০ভাগ ব্যবহার শুধু তামাক পাতা শুকানোর কাজে। বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপক হারে বৃক্ষনিধন হচ্ছে। এভাবে বৃক্ষনিধন চলতে থাকলে আগামী ১০ বছর পর পার্বত্য অঞ্চলে কোন গাছ থাকবে না বলে পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন।
তামাক চাষ আমাদের পরিবেশ এর জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। তামাক চাষ এর ফলে কৃষি জমি দখল হচ্ছে, সেখানে তামাক চাষ হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তা। খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। সারাদেশে যে জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে সে জমিতে তামাক চাষের পরিবর্তে খাদ্য চাষ করা হলে তবে দেশে কোন খাদ্য ঘাটতি থাকবে না। তামাক গাছ মাটি থেকে অধিক পরিমাণ পানি শোষন করে এতে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যায়। যেজন্য তামাক উৎপাদিত জমিতে অন্য কোন শস্য উৎপাদিত হয়না। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও পরিবেশ রক্ষায় খাদ্যের জমি এবং বর্তমানে তামাক চাষ হয় না এমন কৃষি জমিতে তামাক চাষ নিষিদ্ধ করা আবশ্যক।
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।

প্রধান সম্পাদক