সাংবাদিক গৌতম দাসের ৮ম মৃত্যুবাষির্কীঃ বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে!

সাংবাদিক গৌতম দাসের ৮ম মৃত্যুবাষির্কীঃ বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে!


শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ:

 

ফ্লাশ ব্যাকঃ ২০০৫ সালের মাঝামাঝি। ফরিদপুর শহরের প্রধান সড়ক মুজিব সড়কের অবস্থা বেহাল। তৎকালীন ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোট সরকারের মদদপুষ্ট সড়কের ঠিকাদার আসিফ ইমরান ও তার পালিত সন্ত্রাসী বাহিনী সংস্কারের নামে চালাচ্ছিল লুটপাট। একের পর এক সংবাদ পরিবেশন করে তাদের এ অপকর্মের চিত্র তুলে ধরেন সাহসী সাংবাদিক গৌতম দাস। তিনি সমকাল সুহৃদ সমাবেশকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন সামাজিক আন্দোলন। তারা মুজিব সড়কের সংস্কার ও পুনর্নির্মাণকাজের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফরিদপুরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক কর্মসূচি পালন করেন। এর পর থেকে সংক্ষুব্ধ ঠিকাদার গ্রুপটি সুযোগ খুঁজতে থাকে গৌতমকে হত্যা করার জন্য।

 

যে দিন খুন হন গৌতমঃ ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর। সকালে আসিফ ইমরান ও নয় সহযোগী মিলে শহরের জনতা ব্যাংকের মোড়ের কাছে সরণি সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় সমকাল অফিসে ঢুকে নির্যাতন ও শ্বাসরোধে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সকাল ১১টার দিকে তার সহকর্মীরা সরণি সুপার মার্কেটের নিচে,যেখান থেকে সাংবাদিকরা নিউজ ফ্যাক্স করতেন,সেই দোকানে সমবেত হন। সেখানে গৌতমকে না দেখে তার মোবাইলে ফোন করা হয়। মোবাইল বন্ধ পাওয়ায় ধারণা করা হয়,হয়তো সে রাত জেগেছে, তাই ঘুমাচ্ছে। তার মৃত্যুর খবর তখনও কেউ জানেন না।
দুপুর ১২টার দিকে সমকালের তখনকার ফরিদপুর প্রতিনিধি হাসানউজ্জামান সমকাল অফিসে গৌতমকে ডাকতে যান। কিন্তু অনেকক্ষণ তার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সহকর্মী নির্মলেন্দু চক্রবর্তী শংকরকে নিয়ে পাশে নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে সমকাল অফিসের জানালা দিয়ে গৌতমকে খোঁজার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা যা দেখেন তা মর্মান্তিক,যা তাদের ভাবনায়ও ছিল না। যে ব্যানার নিয়ে মুজিব সড়কের সংস্কারকাজের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানববন্ধন করা হয়েছিল,সেই ব্যানারের পাশেই পড়ে ছিল গৌতমের নিষ্প্রাণ দেহ। মুখে নির্যাতনের তীব্র যন্ত্রণার ছাপ, গলায় পেঁচানো নাইলনের এক টুকরো রশি।
দুপুরে পুলিশ দরজা ভেঙে তার লাশ উদ্ধারের পর হাজার হাজার জনতার ঢল নামে গৌতমের লাশ দেখতে। নিরীহ,সহজ-সরল ছেলেটি কারও শত্রু হতে পারে,তা ছিল সবার ধারণার বাইরে। কিন্তু তার সহজাত সারল্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিত্ব ও সত্য প্রকাশের অদম্য সাহস তার অজান্তেই যে কায়েমি স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল,তা যেমন বুঝতে পারেনি মানুষ,যেমনটি বোঝেননি গৌতম নিজেও। তার অকালমৃত্যু নাড়া দিয়েছিল সর্বস্তরের ফরিদপুরবাসীসহ সারাদেশের সাংবাদিক সমাজকে।
ঘটনার দিন ঢাকা থেকে ফরিদপুর ছুটে যান সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারসহ কয়েকজন সাংবাদিক। সম্পাদক ফরিদপুরের সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে প্রেস ক্লাবে দীর্ঘ বৈঠক করেন। তার পরামর্শে সমকালের পক্ষে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন সমকালের ফরিদপুর প্রতিনিধি হাসানউজ্জামান। পরদিন ফরিদপুরে ছুটে আসেন সমকাল প্রকাশক এ. কে. আজাদ, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আবু সাঈদ খানসহ ঢাকার অনেক সাংবাদিক। ভাঙ্গা উপজেলার চণ্ডীদাসদী গ্রামে তার নিজ বাড়ির সামনে সমাহিত করা হয়। সেদিন থেকেই ফরিদপুরসহ সারাদেশে বিক্ষুব্ধ সাংবাদিক সমাজ ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন শুরু করে। ফরিদপুরে কর্মরত সাংবাদিকদের ব্যানারে চলে লাগাতার আন্দোলন। এ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মাঠে নামেন ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, নারী সংগঠন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এরই ফলে পুলিশ মাত্র দুই মাসের মাথায় বেশির ভাগ আসামিকে গ্রেফতার করে এবং মামলার চার্জশিট দেয়। তৎকালীন সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে মামলাটি চাঞ্চল্যকর বিবেচনা করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করে।


৮ বছর পর রায়ঃ বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ হতে পেরিয়ে গেল আটটি বছর। দেশের সাংবাদিক হত্যা মামলাগুলোর কোনোটিরই বিচার কাজ শেষ হয়নি। সমকালের ফরিদপুর ব্যুরোপ্রধান গৌতম দাস হত্যা মামলার রায় অবশেষে ঘোষণা হলেও মামলার দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল।
সাংবাদিক গৌতম হত্যা মামলার আসামিরা সবাই তৎকালীন ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোট সরকারের মদদপুষ্ট হওয়ায় বিচার প্রার্থী সাংবাদিকরা ছিলেন নিরাপত্তাহীনতায়। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং সর্বস্তরের মানুষের আন্দোলনে সাড়া দিয়ে সরকার হত্যা মামলাটিকে চাঞ্চল্যকর বিবেচনা করে দ্রুত বিচার মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে। ফরিদপুরের আদালত থেকে মামলাটি ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ২০০৬ সালের ২৮ আগস্ট থেকে সেখানে মামলার কাজ শুরু হওয়ার পরও পেরিয়েছে সাত বছর। মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ স্তরে থাকার সময়ই আসামিপক্ষ মামলাকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য উচ্চ আদালত থেকে বারবার স্থগিতাদেশ নেয়। ২০০৭ সালের মাঝামাঝি রাষ্ট্রপক্ষ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন জানালে উচ্চ আদালত তাতে সাড়া দেন। ছয় মাস মামলার কাজ চলার পর সব সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলে আবারও স্থগিতাদেশের খর্ব নেমে আসে মামলার কার্যক্রমের ওপর। এভাবে একবার স্থগিতাদেশ আবার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চলতে থাকে বছরের পর বছর। সাত বছরের মধ্যে সাড়ে চার বছরই স্থগিত ছিল মামলার কার্যক্রম।
 
মূল প্রেক্ষাপটঃ ফরিদপুর শহরের মুজিব সড়কের সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ কাজের অনিয়ম এবং দুর্নীতির সংবাদ পরিবেশন করায় সাংবাদিক গৌতম দাসের ওপর ক্ষুব্ধ হয় তৎকালীন ক্ষমতাসীন (চারদলীয় জোট) সরকারের মদদপুষ্ট ঠিকাদার গোষ্ঠী ও তাদের সহযোগী সন্ত্রাসীচক্র। ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর ভোরে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা সমকালের ফরিদপুর ব্যুরো অফিসে ঢুকে সাংবাদিক গৌতমকে নির্যাতন ও শ্বাসরোধে হত্যা করে। ওইদিনই সমকালের পক্ষে বাদী হয়ে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা করেন সমকালের স্থানীয় প্রতিনিধি হাসানউজ্জামান। দুই মাস পর ২০০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি ফরিদপুরের আদালতে ১০ জনকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোলাম নবী। আসামি আসিফ ইমরান,আসিফ ইমতিয়াজ বুলু,কাজী মুরাদ, কামরুল ইসলাম আপন,সিদ্দিকুর রহমান মিয়া,রাজীব হোসেন মনা,আসাদ বিন কাদির,অ্যাপোলো বিশ্বাস ও তামজিদ হোসেন বাবু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বিভিন্ন সময় পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। পলাতক আসামি জাহিদ ২০০৬ সালের ১২ অক্টোবর ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। গত ১৯ এপ্রিল মামলার রায় ঘোষণার পর জামিন বাতিল করে আসামীদের জেলহাজতে পাঠান আদালত। এ সময় আসামি অ্যাপোলো বিশ্বাস কাঠগড়ায় অনুপস্থিত থাকায় তাকে পলাতক ঘোষণা করা হয়। অতঃপর গত ১৩ আগষ্ট ফরিদপুর শহরের আলীপুর এলাকার বান্ধবপল্লী থেকে তাকে গ্রেফতার করে কোতয়ালী থানা পুলিশ।

 
গৌতমের বাবা-মায়ের প্রয়াণঃ অকালপ্রয়াত পুত্রের শোকে এবং পুত্র হত্যার বিচার না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে ইতিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন গৌতম দাসের মা ও বাবা। ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর মা সতী রানী দাস এবং ২০০৮ সালের ২৩ নভেম্বর বাবা বলরাম দাস মারা যান।

 

অসন্তোষজনক রায়ঃ ফরিদপুরের নির্ভিক সাংবাদিক গৌতম দাস হত্যা মামলায় ৯ আসামীর যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করায় ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সাংবাদিক সমাজ ও ফরিদপুরের বিভিন্ন স্তরের জনগন। ফরিদপুরের সাংবাদিকরা তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেন,এ রায় আমরা মানিনা। সাংবাদিকদের পাশাপাশি ফরিদপুরের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এ রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। প্রবীন সাংবাদিক মুন্সী হারুন অর রশিদ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন,এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনা। রায়ে সঠিক বিচার পাওয়া যায়নি। ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন,গৌতম দাস হত্যা মামলায় যে রায় দেয়া হয়েছে আমরা সাংবাদিক সমাজ তা প্রত্যাখ্যান করছি। ফরিদপুর রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি আরিফ ইসলাম বলেন,যে রায় দেয়া হয়েছে তা দেখে আমরা হতবাক। আমরা আশা করেছিলাম,এ হত্যাকান্ডের সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের ফাঁসি হবে। গৌতম দাস হত্যা মামলার বাদী সাংবাদিক হাসানুজ্জামান বলেন,আমি এ রায়ে খুশি নই। আসামীদের সব্বোর্চ শাস্তির জন্য আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো। গৌতম দাসের স্ত্রী দিপালী দাস তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন,এ রায়ে আমি খুশি নই। যে রায় প্রত্যাশা করেছিলাম সে প্রত্যাশা পুরন না হওয়ায় আমি হতাশ। দীর্ঘ ৮ বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলাম হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় হবে,কিন্তু হলো না। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। এ রায়ে আমি সঠিক বিচার পাইনি। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন বলেন,গৌতম হত্যা মামলায় আমরা আশা করেছিলাম হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় হবে। তা না হওয়ায় স্বভাবতই আমরা হতাশ হয়েছি। শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক প্রফেসর মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, আমরা আরো কঠোর শাস্তি আশা করেছিলাম। যাতে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়। যেন আর কোন সাংবাদিকের উপর হামলার সাহস না পায় সন্ত্রাসীরা।

শেষ কথাঃ গত দুই দশকে প্রায় ৩০ জন সাংবাদিক নিহত হলেও এর সুষ্ঠু কোনো বিচার নাহওয়ায় সাংবাদিকরা নিজেদের নিরাপদ মনে করতে পারছেন নাএকটি বেসরকারিসূত্রমতে, স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত শুধু দক্ষিণাঞ্চলেই নিহতহয়েছেন ১২ জন সাংবাদিকমানবাধিকার সংগঠন অধিকার’-এর মতে, বাংলাদেশে ২০০২সালে ২ জন, ২০০৩ সালে ১ জন, ২০০৪-০৫ সালে ৬ জন, ২০০৬ সালে ১৪ জন সাংবাদিকনিহত হয়েছেনঅধিকার’-এর বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট ২০০৯ অনুযায়ী ওই বছরদেশে সাংবাদিক খুন, হামলা, মামলা, নির্যাতনসহ ২৬৬টি ঘটনা ঘটেছেএরমধ্যেখুন হয়েছেন ৩ জন, আহত হয়েছেন ৮৪ জন, গ্রেফতার হয়েছেন একজন২০১০ সালেররিপোর্ট অনুযায়ী সাংবাদিক খুন হয়েছেন ৪ জন, আহত হয়েছেন ১১৮ জনসব মিলিয়েসাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২৩১টি অপরদিকে,এ্যামনেষ্টিইন্টারন্যাশনাল তাদের বার্ষিক রিপোর্টে জানিয়েছে ২০১০সালে বিশ্বের বিভিন্নদেশে সাংবাদিকরা নানা গ্রুপের রোষানলের শিকার হয়েছেননিহত ও আহতদের বেশীরভাগ সাংবাদিকের পরিবার অর্থ সংকটে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেক্ষতিগ্রস্থসাংবাদিকদের পরিবার-পরিজন রাষ্ট্রীয় সহায়তা কমই পেয়েছেনঅনেক ক্ষেত্রেক্ষতিগ্রস্ত সাংবাদিকদের পোষ্যরা নির্যাতনের ভয়ে প্রতিকার পান নাঅনেকেইমামলা করে বিপদে আছেনতবুও এত কিছুর পর সৎ সংবাদকর্মীর বিশ্বাসঅটুট থেকে যায়বন্দুকের নল কিংবা কামানের গোলার চেয়েও শক্তিশালী হচ্ছেকলমসব নির্যাতন-নিপীড়ন উপেক্ষা করে সাংবাদিকরা তাদের মহান পেশার পবিত্রকলম চালিয়ে যাবেন

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।

 

প্রধান সম্পাদক