আমরাই আমাদেরকে খুন করছি…

আমরাই আমাদেরকে খুন করছি…

মোমিন মেহেদী:
‘বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনায়-
সরকার বিরোধীদলকে দোষারোপ করছে,
বিরোধীদল বলছে ‘আওয়ামী এজেন্টদের কাজ’,
আমার মনে হয় ‘আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারছে সাধারণ জনগন।’ জনগণ নিজেদের গায়ে আগুন দিয়ে রাজনীতিবিদদের ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।
(এ-ও হতে পারে, সাধারণ জনগণ নিজেদের গায়ে আগুন দিয়ে মৃত্যুর মধ্যে শান্তি খুঁজছে)’ আমার একজন রাজনীতি সচেতন বন্ধু ডা. এনামের সাথে এভাবেই একাত্ম হয়ে বলতে চাই- আমরাই আমাদেরকে খুন করছি, কারন আমরা প্রতিবাদ করছি না। আমরা তাদের পক্ষে যাচ্ছি না, যারা সৎ কিন্তু অনেক টাকার মালিক না। আমরা তাদেরকে নির্বাচিত করছি না, যারা টাকা দিয়ে ভোট কিনতে আসছে না। আতএব, বলা যায় আমরাই আমাদেরকে খুন করছি…
আসলেই তাই। এভাবেই ঘটনাগুলো ঘটছে বলে মনে হচ্ছে বর্তমানে। কেননা,  নূন্যতম সহানুভূতিটুকুও প্রকাশ করছেন না শেখ হাসিনা অথবা খালেদা জিয়া। তারা একর পর এক রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন, রাজনৈতিক কথা বলছেন, ক্ষমতায় আসার কথা বলছেন, ক্ষমতায় থাকার কথা বলছেন; কিন্তু জনতার কথা, জনতার কষ্টের কথা কেউ বলছেন না। এর পেছনে একটাই কারন, আর তা হলো- আদর্শচূত হওয়া। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার আদর্শ স্বাধীনতার ঘোষক দাবীদার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেখানো পথ। সে পথ থেকে খালেদা এখন যোজন যোজন দূরে রাজনৈতিক শিবিরে যুদ্ধাপরাধী-জামায়াত-শিবিরের মাঝে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনার আদর্শ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্ভিক পথচলা। সেই পথচলা থেকে তিনিও ছিটকে পড়েছেন একেবারে সেখানে, যেখানে বাম আদর্শ থেকে ক্ষমতার জন্য নিবেদিত হয়ে উভচর প্রাণীতে পরিণত কিছু রাজনৈতিক উভচরের ফাঁদে। সে ফাঁদে পা দিয়েই জাতির জনকের কন্যা হয়েও আবারো ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে আছেন নিছক মোহের টানে।

একজন ক্ষমতায় আসার জন্য, অন্যজন ক্ষমতায় থাকার জন্য নিজেদেরকে ব্যাস্ত রাখছেন বর্তমানে। আর তাদের একজনের চারপাশে কিলবিল করছে জামায়াত-শিবির- দেশ বিরোধীরা। শুধু একটু ক্ষমতার ছিটেফোটার জন্য। অন্যজনের পাশে সবসময় আছে লাল পতাকাবাহি সুবিধাবাদি কালো মনের মানুষেরা। যাদের লক্ষ্য ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ মুখে মুখে বললেও তারা মূলত আপনতন্ত্র নিয়েই ব্যাস্ত থাকেন-ছিলেন-থাকবেন নিরন্তর।

মাঝখানে নেত্রীদ্বয়ের রাজনৈতিক অরাজকতার শিকারে পরিণত হচ্ছে সাধারন জনগন। যাদের কাছে এখন রাজনীতি মানেই মৃত্যুর ফাঁদ-রাজনীতি মানেই কষ্টের দাবানল। রাজনীতি মানে এতটাই কষ্ট যে, জনগন মুখ খুলে বলতে শুরু করেছে যে,
‘দেশে এটা কী হচ্ছে? রাজনীতির নামে মানুষরে পোড়াইয়া মারছে! ক্ষমতার কাড়াকাড়িতে জান যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। তাদের তো কিছু হচ্ছে না। তারা সাধারণ মানুষের কথা কী ভাবছেন? এর নাম কি রাজনীতি? এইডা যদি রাজনীতি হয়, তাইলে ঘেন্না করি এই রাজনীতিরে।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চতুর্থ তলায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেশের বর্তমান রাজনীতি নিয়ে এভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সুলতানা। সুলতানার ভাই আবু তালহা রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় শিশুপার্কের সামনে বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সিদ্দিকবাজারের বাসিন্দা তালহা ওইদিন সন্ধ্যায় মিরপুরে বোনের বাসায় যাচ্ছিলেন। তার শরীরের ২৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। তালহা ৭ বোন ৬ ভাইয়ের মধ্যে তার অবস্থান দশম। স্ত্রী আর দুই কন্যা নিয়ে সিদ্দিকবাজারে ভাড়া বাসায় থাকতেন। বড় মেয়ে এবার জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। স্যানিটারি পণ্যের ব্যবসা করে সংসার চালান তালহা। ভাইয়ের পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা তার চোখমুখে। তিনি বলেন, ‘তার যদি কিছু অইয়া যায়, তাইলে পরিবারের যে কী হবে! আমরা সবাই কাজকর্ম করে জীবন সংগ্রামে আছি। এমন কোনো সম্পদ নাই যে, সেটা দিয়ে চলব।’ দেশের বর্তমান রাজনীতি নিয়ে ক্ষোভের শেষ নেই তারও।
শুধু তালহার অগ্নীদগ্ধতাই শেষ? ইা এরপরও আছে আরো অসংখ্য মানুষের কষ্টগাঁথা জীবনের কথা। সেখানে একমাত্র ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে শাহনাজ পারভীনের সংসার। ছেলের বয়স ৮ বছর। থাকেন ঢাকার মিরপুরের দোয়ারীপাড়ায়। গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধায়। বাসচালক স্বামীর রোজগারে কোনোরকম কেটে যায় দিন। তবু তারা সুখী। সেই সুখের সংসারে হানা দিয়েছে পেট্রলবোমার আগুন। শাহবাগে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায় মারাত্মকভাবে আহত মাহবুব হাল না ছেড়ে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ রাখার শেষ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পারেননি। মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগের কাছে শিশুপার্কের বিপরীত দিকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন মাহবুব। তার শরীরের ৩৫ শতাংশ আগুনে পুড়ে গেছে। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে স্বামীর পাশে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন শাহনাজ। অজানা আশঙ্কা তাকে বারবার আতঙ্কিত করে তুলছিল। শাহবাগের ঘটনায় নাহিদ নামের একজনের মৃত্যু শাহনাজের আশঙ্কা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বারবারই বলছেন, কী হবে তার স্বামীর জীবনে। তাকে কি শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যাবে? সবার কাছেই তার একই কথা, ‘আমার পোলাডারে লইয়া কেমনে বাঁচুম, কার কাছে যামু? কে আমাগোরে খাওয়াবে? আমাগো তো আর উপায় নাই। আমার স্বামীডারে কেন আগুন দিল? কী অপরাধ করছিল সে।’
শাহনাজ-মাহবুবের একমাত্র ছেলে ৮ বছরের সাহিলও অপেক্ষায় ছিল বার্ন ইউনিটের সামনে।
এমন অপেক্ষা খালেদা জিয়ার যদি করতে হতো, যদি করতে হতো শেখ হাসিনার অথবা জামায়াত-শিবিরের বর্তমান নেতাকর্মীদের? তাহলে হয়তো তারা রাজনীতির নামে এই অপরাজনীতির ক্ষতিকারক দিকটা বুঝতে পারতেন। তখন আর হয়তো ক্ষমতার জন্য নিজেদের ইচ্ছে মত ঘাড়ত্যারামি করতেন না।
অনেক দুখের মাঝেও একটি উদাহরণ টানতে হচ্ছে, আর সেই উদারণটি হলো বাংলা সিনেমা। যেখানে পুরো কাহিনীতে ভিলেন নিজেকে কখনোই ছোট ভাবে না। সবসময় নায়কের বিরুদ্ধে লড়তে থাকে। যখন কাহিনী একেবারেই শেষ; তখন নিজেকে সমপর্ণ করে বলে, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি আর অন্যায় করবো না। আমার কাছে মনে হচ্ছে জনগন নায়কের ভূমিকায় আছে এখন; ভিলেনের ভূমিকায় আমাদের দেশের রাজনীতির নামে অপরাজনীতির ধারক-বাহক- খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা, মকবুল, মেনন, এবং দু’একটি বাদে অন্য সকল দলের নেতাকর্মীরা। তারা রাজনীতির নামে এতটাই অপরাজনীতিতে মত্ত যে, গণতান্ত্রিক দেশে অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় আসার এবং থাকার জন্য নিজের সন্তানকে তুলে আনছেন যোগ্য-অযোগ্য বিবেচনা না করেই। যেন নিজের ইচ্ছেতেই দেশ চলবে মরনের পরে। তাদের এই সকল খলনায়কের ভূমিকার কারনে নতুন প্রজন্ম জেগে উঠছে। তারা রাজনীতি সচেতন-ই শুধু নয়; মাঠে নামছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘জাগো বাহে কোণঠে সবায়’-এর প্রশ্নের উত্তরে। কেননা, নতুন প্রজন্ম মনে করে দেশ কারো বাবার-স্বামীর বা দাদা-নানার ক্রয় করা সম্পদ নয়। অতএব, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার যতটুকু অধিকার, ততটুকু আমারও। তারা রাজনীতির নামে অপরাজনীতি বন্ধ না হলে সারাদেশে সেই বিপ্লব বইয়ে দেবে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য-মুক্তির জন্য নিজেদের জীবন বাজি রেখে যে বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলো নিশ্বার্থভাবে।

তার-ই নমূনা হলো- ‘কী ছিল এই বাসযাত্রীদের অপরাধ? তাদের ওপর কেন এই হিংসার আগুন? তারা তো রাজনীতিও করেন না। তাহলে কেন তাদের ওপর হামলা?’ ষাটোর্ধ্ব আবদুল কুদ্দুস শরীফ চোখের পানি মুছতে মুছতে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন সংবাদকর্মীদের কাছে। তার ছেলে শফিকুল ইসলাম বংশাল শাখা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা। অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে নাশকতার শিকার হয়ে বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন। তার শরীরের ৩২ শতাংশ পুড়ে গেছে। শফিকুল ইসলামের দেড় বছর বয়সী সস্তানকে নিয়ে চিন্তিত আবদুল কুদ্দুস শরীফ। আধো আধো বোলে ‘বাবা বাবা’ করে শফিকুলকে খুঁজে বেড়াচ্ছে শিশুটি। প্রতিদিনের মতো আজও অপেক্ষায় রয়েছে কখন বাবা বাড়ি ফিরবেন।  ছেলের এরকম দুর্ঘটনায় বেশ ক্ষুব্ধ আবদুল কুদ্দুস শরীফ। তার মতে, স্বাধীনতাবিরোধী চক্র দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। বিদেশি শক্তিগুলো বাংলাদেশকে নিয়ে চক্রান্ত করছে। রাজনীতিবিদরা যদি দেশের মানুষের কথা না ভাবেন, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে মন্তব্য করেন তিনি। নিজের সন্তানের এই দুর্দশা দেখে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এরকম ঘটনা যেন আর কারো সন্তানের ক্ষেত্রে না ঘটে…
আমরাও চাই মানুষ শান্তিতে থাকুক। দেশের রাজনীতিকগণ তাদের মত করে রাজনীতি করুন। কিন্তু তাতে যেন জনগনের কোন ক্ষতি না হয়। জনগন যেন নিজেদের জীবন-সংসার-সন্তান নিয়ে থাকে ডালে ভাতে। দুধ ভাত না জুটুক অন্তত ডাল-ভাত খেয়ে জীবন নির্বাহের শেষ সুযোগটা করে দিতে তৈরি রাজনীতি সচেতন নতুন প্রজন্ম। যারা ডান নয়, বাম নয়, যুদ্ধাপরাধী নয়, যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক নয়, দুর্নীতিবাজ নয়, সন্ত্রাসী নয়, চাঁদাবাজ নয় অথবা ধর্ষক নয়; তারা রাজনীতি সচেতন-স্বাধীনতার পক্ষের নিবেদিত তারুণ্য। তাদেরকে কোন নতুন খালেদা-হাসিনা অথবা নিজামী-মকবুল- মেনন আমরা হতে দিতে চাই না বলেই হয়েছি স্বাধীনতার শপথে বলিয়ান, হয়েছি বাহান্নের আন্দোলনের রাস্তায় আগুয়ান, হয়েছি জনতার জন্য নিবেদিত। অতএব, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বপক্ষের রাজনীতি সচেতন নতুন প্রজন্মের সাথে বলে উঠুন- ‘আমরা রাজনীতির নামে অপরাজনীতি-দুর্নীতি-সন্ত্রাস-খুন-ধর্ষণ চাই না’। এগিয়ে চলুন নতুন দিনের জন্য-নতুনধারা’র সাথে…
[মোমিন মেহেদী : কলামিস্ট ও আহবায়ক, নতুনধারা বাংলাদেশ(এনডিবি)]

mominmahadi@gmail.com

অতিথি লেখক