শীতের শুরুতেই খেজুর রস আহরণে ব্যস্ত গাইবান্ধার গাছিরা

শীতের শুরুতেই খেজুর রস আহরণে ব্যস্ত গাইবান্ধার গাছিরা

মোঃ ছাদেকুল ইসলাম রুবেল, গাইবান্ধা প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ শীতের হাওয়া বইতে না বইতেই গাইবান্ধা অঞ্চলের খেজুর গাছিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মাটির ভাড় (ঠিলে) সংগ্রহ, দা ধার, গাছি দড়া, নলি ও খিল তৈরিতে তৎপর তারা। আমাদের দেশে খেজুর গাছে যে খেজুর জন্মায় তা গাছেই পড়ে থাকে। পাকলে পখিরা খায় আবার কেউ হয়তো শখ করে দুই-একটা পাকা খেজুর খায়। এ ছাড়া বাজারে তেমন বিক্রি হয় না। আবার সৌদি আরব, ইরাক, ইরানে যে উন্নত জাতের খেজুর গাছ জন্মায় তা থেকে কেবল খেজুরই উৎপাদন হয়। তবে বাংলাদেশের খেজুর গাছ থেকে যে সুমিষ্ট রস বের করে আনা হয় আর তুলনা হয় না।এ রকম একটি বৃক্ষ থেকে এত সুস্বাদু, সুমিষ্ট রস যে বের করে আনা যায়, এ পদ্ধতিটি আমাদের এ অঞ্চালে কে, কবে প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন তা জানা যায়নি। এখানে খেজুর গাছ থেকে মূলত রস সংগ্রহ করা হয়। খেজুর গাছ ৬-৭ বছর বয়স খেকে শুরু করে ২৫-৩০ বছর বয়স পর্যন্ত রস দেয়। মাঝ বয়াসী গাছ থেকে বেশি রস পাওয়া যায়। অন্য গাছের তুলনায় দো-আঁশ ও পলি মাটিতে জন্মানো গাছে বেশি রস হয়। রস আহরণের জন্য সাধারণত আশ্বিন মাস থেকে গাছ প্রস্তুত (গাছ কাটা) শুরু হয়। রস পাওয়া যায় ফল্গুন মাস পর্যন্ত। তবে রসের মান ও পরিমাণ প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। তেমনি গাছির দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার উপরও নির্ভর করে। একবার গাছ কাটার পর দুই-তিন দিন রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের রসকে স্থানীয়ভাবে বলে জিরেন রস। এই জিরেন রস স্বাদে ও মানে অনন্য। জিরেন রস দিয়েই তৈরি হয় উন্নত মানের গুড় ও পাটালি। দ্বিতীয় দিনে পাওয়া রসকে দোকাট ও তৃতীয় দিনে পাওয়া রসকে তেকাট বলে। তৃতীয় দিনের রস দিয়ে তৈরি হয় ঝোলা গুড়। রসের জন্য গাছ একবার কাটার পর ৫-৬ দিন বিশ্রাম দেয়া হয়। রোদে কাটা অংশ শুকিয়ে গেলে আবার ঐ অংশ চেছে রস সংগ্রহ করা হয়। আর এ কারণে সাধারণত খেজুর গাছ পূর্ব ও পশ্চিম দিকে কাটা হয় যাতে সূর্যের আলো সরাসরি ঐ কাটা অংশে পড়তে পাড়ে। উলে¬খ্য, এ অঞ্চলের গুড় পাটালী বেশি বিখ্যাত। এখানকার দক্ষ কারিগররা যে গুড়-পাটালি তৈরি করেন তা দেখতে অনেকটা মিছরীর মত এবং লালচে বর্ণের। পাটালির সারা শরীর কাচের মত মোটা দানায় পরিপূর্ণ থাকে। এই পাটালির বাইরের অংশ শক্ত মনে হলেও ভিতরটা থাকে রসে টুইটুম্বর। একসময় খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ ও গুড়-পাটালি তৈরি একটি লাভজনক ব্যবসা ছিল। এখন আর আগের মত অগণিত খেজুর গাছও নেই, নেই দক্ষ গাছি, নেই ভাল গুড়-পাটালি তৈরির কারিগর। গাছি মোস্তফা কামাল জানান, সাধারণত আশ্বিনের শেষের দিকে খেজুর গাছকে প্রস্তুত করতে হয় রস আহরনের জন্য। গাছের বাকল কেটে গাছে গাছ তোলা হয়। গাছ তোলা শেষে গাছ কাটার পালা। কোমরে মোটা দড়ি বেঁধে ধারালো গাছি দা দিয়ে সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে গাছ কেটে রস আহরণ করতে হয়। রস পেতে হলে কিছু কাজ করতে হয়। গাছের উপরিভাগের নরম অংশকে কেটে সেখানে বসিয়ে দেয়া হয় বাঁশের তৈরি নালা। গাছের কাটা অংশ থেকে চুইয়ে চুইয়ে রস এসে নল দিয়ে ফোটায় ফোটায় জমা হয় ভাড়ে। এ অঞ্চলের মানুষ রস দিয়ে নানা ধরনের পিঠা তৈরি করেন। এই রস থেকে তৈরি হয় গুড় ও পাটালি। বর্তমানে চিনির থেকে পাটালির দাম অনেক বেশি। নড়াইলে মিষ্টির দোকানদাররা এই খেজুরের পাটালি থেকে তৈরি করেন বিখ্যাত ক্ষিরের সন্দেশ। খুবই মজাদার ও সুস্বাদু এই ক্ষিরের সন্দেশ। নড়াইলে পরিতোশ কুন্ডুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টির কারিগর ও দোকানদার প্রশান্ত দে বলেন, খেজুরের পাটালি দিয়ে তৈরি এ ক্ষিরের সন্দেশ কিনতে বিভিন্ন জেলার মানুষ এখানে আসেন। কেউ কেউ দেশের বাইরেও পাঠান। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় আমাদের এই প্রাকৃতিক সম্পদ হারিয়ে যাচ্ছে। কারণ নির্বিচারে খেজুর গাছ কেটে ইটের ভাটায় পোড়ান হচ্ছে। রক্ষার জন্য সচেতন সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে খেজুর গাছ আর খেজুরের সুমিষ্ট রস শুধু ইতিহাস হয়ে বইয়ের পাতায় থাকবে।

এসবিডি নিউজ ডেস্ক