বাংলা নববর্ষ ও আমাদের পান্তা-ইলিশ

বাংলা নববর্ষ ও আমাদের পান্তা-ইলিশ

সোহরাব শান্ত: বাঙালির জীবনে আনন্দের বার্তা নিয়ে নতুন বছর শুরু হলো। মহাসমারোহে উদযাপিত হলো বাংলা নববর্ষ। রাজধানী ঢাকার লাখো মানুষের প্রাণস্পন্দন যেন রমনার বটমূলকে ঘিরেই ছিল। চারুকলার শোভাযাত্রার রং সকলের মনে। যে রঙের দোলা শিশু-কিশোর-তরুণের পোশাকে। এমন উৎসব মেতে ওঠা বাঙালিকেই মানায়। উৎসবের রং বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের বাঙালি অধ্যুষিত সকলখানে ছড়িয়ে গেছে। গ্রামে-গঞ্জে চলছে বৈশাখী মেলা। সাংস্কৃতিক উৎসেবর ছড়াছড়ি। এই লেখকও এ উপলক্ষে গ্রামের বাড়ি ঘুরে এল। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে। ঢাকায় যখন রঙের ছড়াছড়ি। পান্তা-ইলিশের যখন এত ঢামাঢোল তখন এ নিয়ে দুটো কথা বলার ইচ্ছা জাগছে। মনে পড়ছে ছেলেবেলার কথা। আমাদের গ্রামে চৈত্রের শেষদিনে হয় পৌষ সংক্রান্তির মেলা। এসময়টায় শুরু হয় ধান কাটা। পাকা ধান। সোনালী ধান। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায় আমার। বলতে দ্বিধা নেই ছোটবেলায় ধান কাটার সময় এলেই আমার পড়াশোনায় মনযোগ বেড়ে যেত! কারণ, ধান-খড়ের মারাত্বক কঠিন কাজ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। আমাদের মতো গৃহস্থ পরিবারে প্রায় একটি ঘটনা ঘটতো। হাজার মণ ধান যার গোলায় ওঠে, সেই গৃহস্থরে বাড়িতেও ধান তোলা মৌসুমে (প্রায় ১মাস) অন্তত দুইবেলা পান্তা ভাত থাকবেই। কেন?
১. চৈত্র-বৈশাখ (এবং জৈষ্ট, আষার, শ্রাবণ) মাসে আকাশের কোনো বিশ্বাস নেই। এই রোদ-এই বৃষ্টি। ধান শোকানোর ঝুঁকিও তাই বেশি। যতক্ষণ রোদ আছে ততক্ষণই কাজে লাগানো চাই। তাই আগের রাতের রান্না করা ভাত (পানি দিয়ে রাখা, যেন পঁচে না যায়) লবণ-মরচি বা গুড়-কলা-চিনি-দই দিয়ে গলাদকরণ করা। তিনবেলা গরম ভাত রান্না করে কে খাবে?
২. এসময় আবহাওয়া থাকে মারাত্বক উত্তপ্ত। ধান-খড়ের গরম যে কি ভয়ংকর, জীবনে এই অভজ্ঞিতা যাদের হয়নি বর্ণনা দিয়ে কুঝানো কঠিন। এছাড়া ধান কাটা, মাড়াই, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সেদ্ধ করা, শুকানো এবং খড় শুকানোর সময় রোদ-গরমে প্রচুর ঘাম বের হয় শরীর থেকে। এসময় ঠান্ডা পান্তা ভাত যেন বেহেশতি খাবার। তাই গ্রামের কৃষি ভিত্তিক গৃহস্থ পরিবারগুলোতে পান্তাভাত হয়ে ওঠে প্রধান খাবার।
৩. পান্তাভাত নিয়ে শহুরে মানুষের একটা ধারণা, এটা গরীবের খাবার। বিষয়টা পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ, গরম ভাতে পানি ঢেলে কয়েক ঘন্টা পর খেলেই তা পান্তাভাত হয়। তারমানে, যে পরিবার পান্তা খাচ্ছে সে পরিবারের গরম ভাত জুগারের সামর্থ আছে। তবে হ্যা, পান্থাভাত খাওয়ার জন্য বেশি টাকা খরচ করে তরকারীর যোগার করতে হয় না। গরম ভাতও কিন্তু লবণ-মরিচ দিয়ে খাওয়া যায়!
পান্তা নিয়ে লিখতে বসে কৌতুহল নিয়েই গুগল সার্চ দিলাম। বাংলা উইকিপিডিয়া’র পান্তা সংক্রান্ত লেখাটা দেখে আমি অবাক। সেখানে লেখা আছে- ‘পান্তা ভাত বাঙালি জনগোষ্টির একটি জনপ্রিয় খাবার। রান্না করা ভাত প্রায় একদিন পানিতে ভিজিয়ে রাখলে তাকে পান্তা ভাত বলা হয়। সাধারণত লবন, মরিচ মিশিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া হয়। পান্তা ভাত ও ইলিশ মাছ বাঙালি সংস্কৃতির একধরনের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে পান্তা উৎসবের মাধ্যমে অনেকেই নতুন বছরকে বরণ করে নেন।’ অবাক লাগলো এজন্য-
১. পান্তা বাঙালির জনপ্রিয় খাবার নয়। ঐতিহ্যবাহী খাবার বলা যেতে পারে।
২. একদিন বলতে আমরা বুঝি ২৪ ঘন্টা। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, চব্বিশ ঘন্টা পানিতে ভেজানো ভাত কখনোই ভাল থাকবে না। পঁচে যাবে। পঁচা ভাত গ্রামের গরীব মানুষও খায় না। দুএকটা ব্যতিক্রমধর্মী উদাহরণ খুঁজে পেলে ভিন্ন কথা। আর একদিন ভিজিয়ে রাখলেই বুঝি পান্তাভাত বলা হয়? গ্রামীণ নারীরা রাতের খাবারের পর ঘুমানোর আগে সেবেলার বেঁচে যাওয়া ভাতে পানি দিয়ে ঘুমান। যেন ভাত নষ্ট না হয়। ৩/৪ ঘন্টা পর এই ভাত খেলে একে কি বলা হবে!
৩. পান্তা ভাত ও ইলিশ মাছ বাঙালি সংস্কৃতির একধরনের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? সেটা কয় বছর ধরে? অনুচ্ছেদ রচয়ীতা কি সচেতনভাবে কথাটা লিখেছেন? আমার মনে হয়না। এ ব্যপারে ১৩ এপ্রিল (৩০ চৈত্র ১৪২০) পোস্ট করা শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দিনের ফেসবুক স্ট্যাটাস লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, ‘পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশ ভাল যায় না, আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নাই, ইলিশের ঘোর প্রজনন মৌসুম এখন: আমার এ চিৎকার কারো কারো কানে গেছে, বেশির ভাগেরই যায় নাই। যেমন যায় নাই, আমাদের সবার গায়ের রঙই সুন্দর, ক্রিম ঘষাঘষি করে তা বদলে ফেলার কোনো মানে নাই এ চিৎকারও। আমাদের গণতান্ত্রিক, পরমতসহিষ্ণু হতে হবে এসব চিৎকারও মাঠেই মারা গেছে-যাচ্ছে। কিন্তু এই নতুন বছরে আমি স্বপ্ন দেখি গড্ডলিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে আরো একটু যুক্তিবাদি হবো। স্বপ্ন দেখতে আমার ভালো লাগে, বিশেষ করে এইসব উৎসব মুহূর্তে।’
>>>
এক-দুই দশক আগেও পহেলা বৈশাখ উদযাপন হতো অনভাবে। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা ও পূজা। পহেলা বৈশাখে হালখাতা অনুষ্ঠান, বৈশাখী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বর্তমানে শহরের আয়োজনগুলো হয়েছে আরো জাকজমকপূর্ণ ও পরিকল্পিত। গ্রামাঞ্চলেও চেষ্টা হচ্ছে শহুরে বৈশাখকে অনুকরণের। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাসটা আমরা আবার একটু দেখে নিতে পারি। অবশ্য এজন্য বাংলা উইকিপিডিয়ারই শরণাপন্ন হতে হচ্ছে আমাকে!
সেখানে বলা হয়েছে- ‘হিন্দু সৌর বছরের (পঞ্জিকা অনুযায়ী) প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়– এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই (নববর্ষ) পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত।
ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।
>>>
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি।’ বর্তমানে মহাসমারোহে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। এটা আমাদের অহংকার। আমরা আমাদের দেশটাকে ভালবাসি। আমাদের সংস্কৃতি ভালবাসি। তাহলে, সারাবছর কি আমরা পারিনা বাংলা ক্যালেন্ডারের ব্যবহার করতে? বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির চর্চা করতে। নাকি আমাদের সময় সম্পাদক শ্রদ্ধেয় কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের আক্ষেপ করে দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসই সত্য হবে! তিনি গতকাল লিখেছেন, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো। একদিন অতিযত্মে থেকে পরদিনই গলাধাক্কা খেতে এসো। আজকের তথাশিক্ষিত বাঙালি বৈশাখকে একদিন যাপন করে মাত্র, প্রতিদিন উদযাপন করে না। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী দিনগণনা দূরে থাক, ৬ ঋতু আর ১২ মাসের নাম পর্যন্ত জানে না। এক সময় এই বাঙালির উঠোনে ‘বারোমাস্যা’ পুথিপাঠ হত। সেই সুরেলা দিনগুলো এখন নিছকই অতীত।’

[সোহরাব শান্ত: সাংবাদিক ও গল্পকার।।]

অতিথি লেখক