যশস্বী সুনীল ব্যানার্জিঃ বাংলাদেশের সাংবাদিকতার স্রোতধারার পথিকৃৎ

যশস্বী সুনীল ব্যানার্জিঃ বাংলাদেশের সাংবাদিকতার স্রোতধারার পথিকৃৎ

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ:তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র ও অবহেলিত আমাদের এই দেশে সর্বগুণে গুণান্বিত প্রতিভা সত্যিই বিরল। তবুও এ দেশে মাঝে মাঝে এমন দু-একজন প্রতিভাবান জন্ম নেন, যাদের জ্ঞান-গরিমা, চিন্তা-ভাবনা, প্রজ্ঞা অল্প সময়ের জন্য হলেও আমাদের পারিপার্শ্বিকতাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায়। দেশ-কালের সীমাবদ্ধ গণ্ডি ছাড়িয়ে তাদের প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্বে। আমাদের দুর্ভাগ্য,চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী এরাও একদিন বিদায় নেন আমাদের মাঝ থেকে,রেখে যান তাদের কর্ম, তাদের অনন্য প্রতিভা- যা শুধু স্মৃতি হয়েই ধরা দেয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রথিতযশা সাংবাদিক,লেখক ও সমাজ বিশ্লেষক সুনীল ব্যানার্জির ৬৭তম জন্মবার্ষিকী ২০ এপ্রিল। ২০০৬ সালের ২৮ আগস্ট তিনি জগত সংসারের সকল মায়ার-বন্ধন ত্যাগ করেন। ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৮টি বছর। তাঁর প্রয়াণে দেশ ও জাতি যে অপরিমেয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তা কখনই আর পূরণ হবে না। জাতির কঠিন ক্রান্তিলগ্নে, রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্যোগের ঘনঘটায় পথের যে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন তিনি,তার অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে পথচলার বিকল্প নেই।

সৎ সাংবাদিকতায় সমর্পিত এক ব্যক্তি-নামের আড়ালে বাংলাদেশে সাংবাদিকতাক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। তাই তাঁর কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন পড়ে না। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে প্রয়াত সুনীল ব্যানার্জির অসাধারণ ও অনবদ্য অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে অনাদিকাল। সত্যের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল তাঁর পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের কর্মকাণ্ড। সাংবাদিকতা পেশায় সততার সর্বতোমুখী স্বাক্ষর সুনীল ব্যানার্জি স্বয়ং। প্রবীণ সাংবাদিক ওবায়েদ উল হকের ভাষায়,তাঁর মৃত্যু নেই। তাঁকে বরণ করে মৃত্যুও ধন্য।সুনীল ব্যানার্জির জীবনাচরণ সৎ মানুষের পরম প্রত্যয়ের প্রতিচ্ছবি। সারল্যের আভিজাত্য প্রকাশ পেত তাঁর কথায়,তাঁর লেখায়,তাঁর চলাফেরায়,তাঁর আচার-আচরণে,তাঁর রুচিবোধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আতিকুজ্জামান খানের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রয়াত সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘একজন ডাক্তার ভুল করলে একজন রোগী মারা যায়। এতে একটি পরিবারের লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়,শোকাহত হয়। কিন্তু একজন সাংবাদিক যদি ভুল করে (তা স্বেচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক), তাহলে তা একটি জাতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারে।একই সাক্ষাৎকারে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আধুনিকতাআমরা যেটাকে বলি, সেটার সঙ্গে আমরা মিলিয়ে ফেলি সমকালীনতাকে। আধুনিকতা হলো মানুষকে, মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করা, সম্প্রসারিত করা। সমকালীনতা হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে উন্নতি হয়েছে, তা থেকে আমরা যে সুবিধা পেয়েছি, সেই সুবিধাগুলো গ্রহণ করা। সুবিধা গ্রহণ করেও মানুষকে মানুষহিসেবে প্রকাশ করতে হবে সাহিত্যে, তার গল্পে,তার সাংবাদিকতায়,তার লেখায়। সেই জিনিসটা যদি না আসে, সেটাকে আধুনিকতা বলি না। কিন্তু আমরা এ দুটোকে মাঝে মাঝে গুলিয়ে ফেলি। কারণ একজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তিও তার ঘরে রেডিও-টেলিভিশন রাখেন, আধুনিক ব্যক্তিও রাখেন। কাজেই রেডিও-টেলিভিশন বা আধুনিক প্রযুক্তির অন্যান্য যে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে চলেছি,সেগুলো কিন্তু সমকালীনতা; আধুনিকতা নয়। এটা পার্থক্য করা দরকার। এ বিষয়টি অবশ্য আমরা অনেক সময় পার্থক্য করতে ভুলে যাই-তাড়াহুড়ার মধ্যেই হোক আর খেয়াল না করার জন্যই হোক।”
হয়তো, সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও ইতিহাস একই বিষয়। দেশের সমসাময়িক ঘটনাবলিসংক্রান্ত তাঁর কলামগুলো পড়ার সময় প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক জেমস রেস্টনের একটি উক্তি প্রায়ই মনে পড়ে। নিউ ইয়র্ক টাইমসে ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে রেস্টন বলেছিলেন, ‘
If  it is far away it is news, but if it is close at home, it is sociologyসুনীল ব্যানার্জির বিবিধ লেখায় আমরা বারবার সমাজকেই পেয়েছি, সমাজমুক্তির প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের সূত্র পেয়েছি। তাঁর রিপোর্টে,কলামে বিশদভাবে সমাজচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, The truth shall make us freeসমসাময়িক তথ্যের নির্ভুল উপস্থাপনা, ইতিহাসের নিরিখে তাঁর নির্মোহ বিশ্লেষণ এবং নীতি-নৈতিকতার কষ্টিপাথরে তাঁর নিখুঁত যাচাই-বাছাই যেভাবে অনিরুদ্ধ করে গেছেন জীবনভর,তা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক পরম সম্পদ। গভীর চিন্তা এবং জটিল বিশ্লেষণ অতি সহজ ভাষায় প্রকাশের বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জি।
পাঠকদের প্রতি সুবিচারের জন্য সাংবাদিকতায় কঠিন বিষয় সহজভাবে প্রকাশের জন্য সর্বদাই গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সহজ করে কিছু বলা বা লেখা আসলেই কঠিন। এটা আরো কঠিন গভীর চিন্তাপ্রসূত বক্তব্য উপস্থাপনের সময়। কিন্তু এই কঠিন কাজটিই অতি সহজে তিনি দিনের পর দিন করে গেছেন । অত্যন্ত নিপুণভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর কলাম ও প্রবন্ধ-নিবন্ধে নিজস্ব নিয়ম ও চিন্তাচেতনায় বহু প্রসঙ্গের যুগপৎ অবতারণা করেছেন, যা সাম্প্রতিক ও সুদূর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যসমৃদ্ধ ও যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি সমস্যাগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। সুনীল ব্যানার্জির মৃত্যুর পর প্রবীণ সাংবাদিক নির্মল সেন লিখেছেন, ‘সব দিক থেকে সুনীল ছিলো একজন বড়মাপের মানুষ। নিজের ঢাক নিজে পেটানোর মানসিকতা তাঁর ছিল না। সে ছিলো নিভৃতচারী এক জ্ঞানসাধক। পড়া ও লেখা_এই দুই-ই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। যা বিশ্বাস করতেন, তা লেখার মতো সৎ সাহস তাঁর ছিল। কারো চোখরাঙানি বা চাওয়া-পাওয়া তাঁর বিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারেনি। আজ সুনীল আমাদের মাঝে নেই। তবে তা দৈহিক অর্থে। মানুষকে ভালোবেসে, মানুষের ভালোবাসা নিয়ে যাঁর মৃত্যু, তিনি বেঁচে থাকেন তাঁর কর্ম ও কীর্তির মধ্যে।

সৃষ্টিকর্তা যুগে যুগে মানুষের রূপ দিয়ে এমন কিছু প্রতিভা পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন যাঁদের দেখতে মানুষের মত স্বাভাবিক মনে হলেও তাঁরা স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে অনেক গুণ বেশি মেধা সম্পন্ন। স্বীয় কর্মে দ্বারা লক্ষ-কোটি হৃদয়ে বেঁচে থাকেন চিরকাল। মানব কল্যাণে তাঁদের সৃষ্টিকর্ম,নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মাঝে তাঁদের পরম সুখ। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁরা শুধুই অন্যের চিন্তায় মগ্ন থাকেন। কোন এক সময় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান কিন্তু কর্মই বাঁচিয়ে রাখেন তাঁদের যুগ যুগ ধরে। এমনই এক গুণীব্যক্তি সুনীল ব্যানার্জি। বাংলাদেশে  পত্রিকায় রিপোর্টিং ভিত্তিক আধুনিকতার প্রবর্তক,স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে
সাংবাদিকতা জগতে একটি বিদ্রোহী নাম ছিলেন সুনীল ব্যানার্জি। অন্যায়ের সাথে আপস না করে যিনি হয়ে উঠেছিলেন দ্রোহের ফুল। আজকের সময়ের অনেক আলোচিত সাংবাদিকদের হাতেখড়ি হয়েছিল সুনীল ব্যানার্জির মাধ্যমে। অনেক তুখোড় সাংবাদিকেরই সংবাদ জগতের গুরু ছিলেন তিনি। সততা, প্রতিভা, সময়, শ্রম, অভিজ্ঞতা ও মেধা তিনি নিঃস্বার্থভাবে বিনিয়োগ করে গেছেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতায়। সাংবাদিকতাকে তিনি জীবন হিসেবে দেখেছিলেন; জীবিকা হিসেবে নয়। তাঁর জীবনের মূল উপজীব্য ছিল চিন্তা ও কর্মের সততা। মানুষের সব সদ্গুণের মাঝে সততাই সর্বোৎকৃষ্ট গুণ। সাংবাদিকতায় প্রবেশকালে তিনি সততাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন এবং সারা জীবন সাংবাদিকতায় সততা সনি্নবিষ্ট করেছেন, সৎ সাংবাদিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সাংবাদিকতার মাধ্যমে সততার বিস্তৃতি ঘটানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন অবিরাম

১৯৪৭ সালের ২০ এপ্রিল সাতক্ষীরা শহরের এক অভিজাত পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন সুনীল ব্যানার্জি। ১৯৭৩ সাল থেকে প্রত্যক্ষ ভাবে তিনি সাংবাদিকতা পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। বিসিএস পাশ করেও ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেননি সুনীল ব্যানার্জি। এমন কি এল,এল,বি পাশ করে স্বাধীন আইন পেশায় যোগ না দিয়ে সাংবাদিকতাকেই তিনি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত তিনি অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলায় সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল দৈনিক জনকন্ঠ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন অনুসন্ধানী রির্পোট লিখে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ২০০৬ সালে একুশে গ্রন্থ মেলায় সুনীল ব্যানার্জির লিখিত বই সাংবাদিকতায় বিড়ম্বনা পাঠক মহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন,প্রয়াত বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান। তিনি সেখানে সুনীল ব্যানার্জিকে একজন আপাদমস্তক সাংবাদিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। সুনীল ব্যানার্জি জাতীয় প্রেস ক্লাবের স্থায়ী সদস্য,ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য,ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটের আজীবন সদস্য ও কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর কার্যনির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন। সাংবাদিক ইউনিয়নের সাথেও তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। গত ২০০৬ সালের ২৮ আগষ্ট ভোররাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার মোহাম্মদপুরস্থ নিজ বাস ভবনে তাঁর আকস্মিক মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর। তাঁর স্ত্রী শিখা ব্যানার্জি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার এবং একমাত্র সন্তান সাংবাদিক শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ এসবিডি নিউজ24 ডট কম এর প্রধান সম্পাদক। বিশিষ্ট সাংবাদিক,লেখক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সুনীল ব্যানার্জিকে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন (ক্র্যাব) মরণোত্তর বিশেষ সম্মাননা স্মারক প্রদান করেছে। এর আগে মুক্তিযুদ্ধে অমূল্য অবদানের জন্য সুনীল ব্যানার্জিকে ২০১০ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মরনোত্তর স্বীকৃতি স্মারক প্রদান করা হয়।

সুনীল ব্যানার্জির মতো মানুষকে নিয়ে আলোচনা সভা করা যায়, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-ওয়ার্কশপ করা যায়, কিন্তু স্মরণসভা বা শোকসভা করা যায় না। কারণ সুনীল ব্যানার্জির মতো মানুষেরা নিজ কর্মের মাধ্যমে সর্বদাই জীবিত। তাঁর স্মৃতি ও জীবনাদর্শ আমাদের পথনির্দেশনা।

[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।]

jsb.shuvo@gmail.com

 

প্রধান সম্পাদক