বাংলাদেশ যেন সোনার খনি ।। এক বছরে সাড়ে ৫’শ কেজি সোনা আটক!

বাংলাদেশ যেন সোনার খনি ।। এক বছরে সাড়ে ৫’শ কেজি সোনা আটক!

বিশেষ প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ  এখন বাংলাদেশে যেন বানের জলের মতো আসছে সোনা। বলা যায়, রবি ঠাকুরের সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেছে, বাংলাদেশ হয়ে গেছে সোনার খনি। এখানে ওখানে সোনা পাওয়া যাচ্ছে, তবে আদ্যিকালের বালুমাটিমিশ্রিত সোনা নয়, একেবারে প্রসেসড সোনার বিস্কুট। যার একেকটি বারের দাম কয়েক লাখ টাকা। তবে এ সোনা বৈধ নয়, অবৈধ। মধ্যপ্রাচ্যসহ কয়েকটি দেশ থেকে পাচার হয়ে বাংলাদেশে আসছে সোনা, আবার পাচারও হয়ে যাচ্ছে। জানা যায়, দেশের বিমানবন্দরে সোনা চোরাচালান হয় সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট চেইনে। প্রায় প্রতিদিনই বিমানবন্দর দিয়ে চোরাচালানের জন্য নিয়ে আসা সোনা ধরা পড়ছে নিরাপত্তাকর্মীদের জালে। তবে ধারণা করা হচ্ছে যে পরিমাণ সোনা ধরা পড়ছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি সোনা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই সোনা চোরাচালানের সঙ্গে বিমানবন্দর ও সীমান্তে দায়িত্বরত সংস্থাগুলোর দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কিছু রাজনীতিবিদ জড়িত। মাঝে মধ্যে সোনাসহ কয়েক বহনকারী ধরা পড়লেও চোরাকারবারি গডফাদাররা রয়ে যায় আড়ালে। এদিকে সোনা চোরাচালান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে এ সংক্রান্ত অপরাধপ্রবণতাও। সূত্র জানায়, দেশে ২৫ হাজারের মতো ছোট-বড় সোনার দোকান রয়েছে। এসব দোকানের ব্যবসায়ীদেও বৈধ পথে (এলসি খুলে) কোনো সোনা আমদানির রেকর্ড নেই। প্রবাসীদের আনা সোনা দিয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো হয়। তাহলে পাচার হয়ে আসা বিপুল পরিমাণ সোনা যায় কোথায়? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। চোরাই পথে আসা সোনা আবার চোরাই পথেই ভারতসহ কয়েকটি দেশে পাচার হচ্ছে। আর এতে অল্পতে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছেন চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত একশ্রেণীর মানুষ। এমনকি বিমানবন্দর ও সীমান্ত বন্দরগুলোতে দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীসহ অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীও টাকায় লাল হয়ে যাচ্ছেন। তাদের বেশভূষা দেখলে সহজেই তা অনুমেয়।
২৬ এপ্রিল (শনিবার) দুপুরে বিমানবন্দর থেকে হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা একটি ফ্লাইট থেকে ১০৬ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করেছে বিমানবন্দর কাস্টমস এবং শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ স্বর্ণ উদ্ধার করে। দুবাই থেকে আসা একটি ফ্লাইটে তল্লাশি চালিয়ে বিমানের টয়লেট থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় এই বিপুল পরিমাণ সোনার বার উদ্ধার করা হয়। হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটের টয়লেট থেকে ১০৬ কেজি ওজনের সোনার বার উদ্ধার করা হয়েছে। বিমানবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার ইশরাত জাহান রুমা জানান, বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট ডিজি০৫২ বিমানবন্দরে অবতরণ করলে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিমানে ব্যাপক তল্লাশি চালালে এক পর্যায়ে বিমানের পিছনের দিকের টয়লেট থেকে কালো কাপড়ে বাধা অবস্থায় টয়লেটের ভতর থেকে এই সোনার চালানটি উদ্ধার করা হয়। এ সময় কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সোনার মূল্য জানাতে সক্ষম হননি। এর আগে গত শুক্রবার হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আলাদা তল্লাশির মাধ্যমে ২৮টি সোনার বার এবং বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রাসহ দুই যাত্রীকে আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৯ সালে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার হাতে চোরাচালানের পৌনে ১২ কেজি সোনা ধরা পড়ে। ২০১০ সালে ৯ কেজি, ২০১১ সালে ৪ কেজি, ২০১২ সালে প্রায় ২৪ কেজি। আর গত বছর এই সোনা চোরাচালান ধরা পড়েছে কয়েকগুণ। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মাইনুল খান এসবিডি নিউজকে বলেন, গত এক বছরে (২০১৩ সাল) সাড়ে ৫শ’ কেজি সোনা আটক করা হয়েছে। অর্থাৎ ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে ৪৫ গুণ বেশি সোনা ধরা পড়েছে। ২০১০ সালের তুলনায় ৬১ গুণ, ২০১১ সালের তুলনায় ১৩৭ গুণ, ২০১২ সালের তুলনায় ২৩ গুণ বেশি সোনা ধরা পড়ে ২০১৩ সালে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৪৯টি চালানে ১৯১ দশমিক ২৯০ কেজি সোনা জব্দ করা হয়। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ১২৪ কেজি সোনা উদ্ধারের ঘটনা ঘটে গত বছরের ২৪ জুলাই। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মাইনুল খান জানান, সম্প্রতি ভারতে সোনার শুল্ক প্রথমে ৩ থেকে ৫ এবং সর্বশেষ ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সেই সঙ্গে সর্বসাধারণের জন্য সোনা আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। ভারতে এখন গয়না উৎপাদনকারী ছাড়া যে কেউ সোনা আমদানি করতে পারে না। শুধু বাংলাদেশ নয় শ্রীলঙ্কা ও নেপাল দিয়েও সোনার চোরাচালান বাড়ছে। সাম্প্রতিক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে এসব বিষয় আলোচনায় উঠে আসে বলে জানান তিনি। ঐ সেমিনার থেকেই তিনটি দেশের কাস্টমস বিভাগের পক্ষ থেকে বিষয়টি ভারতকে জানানো হয়।
জানা যায়, বাংলাদেশে সোনা আমাদানির কোনো নীতিমালা নেই। বাংলাদেশে যে কেউ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে ভরি প্রতি (১১ দশমিক ৬৬ গ্রাম) মাত্র ১৫০ টাকা শুল্ক দিয়ে দেশে ফেরার সময় সর্বোচ্চ ২০০ গ্রাম সোনা আনতে পারেন। শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বিমানবন্দর দিয়ে যে পরিমাণ যাত্রী আসা-যাওয়া করে তাদের মাত্র ৫ শতাংশকে স্ক্যানিং করা যায়। শুল্ক গোয়েন্দাসহ বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বরতরা সুনির্দিষ্ট তথ্য কিংবা সন্দেহের ভিত্তিতে সন্দেহভাজন যাত্রীদের তল্লাশি করতে পারেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যখন-তখন যে কোনো যাত্রীর দেহও তল্লাশি করা যায় না। ফলে ধারণা করা হচ্ছে যে পরিমাণ সোনা বিমানবন্দর দিয়ে পাচারের সময় আটক করা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ সোনা পাচার হয়ে যাচ্ছে। চোরাকারবারিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যদের আন্তঃবনিবনা ও তাদের সঙ্গে পাচারকারীদের বনিবনা না হওয়ায় মাঝে মধ্যে সোনার চালান ধরা পড়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যরা হয়রানি ও চাকরি হারানোর ভয়ে সোনার চোরাচালান ধরার সাহস পায় না বলে সংশ্লিষ্ট কয়েক পদস্থ কর্মকর্তা জানান।

বিশেষ প্রতিনিধি