তারুণ্যে বিনিয়োগ সময়ের দাবী

তারুণ্যে বিনিয়োগ সময়ের দাবী

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: পৃথিবী এখন বিজ্ঞানের কলা-কৌশলের একটি ধ্রুব অংশ। এখানের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে সর্বাধিক আলোচ্য এবং বিপদজনক কারণটি হচ্ছে জনসংখ্যার অত্যাধিক ঘনত্ব। অধিক জনসংখ্যার প্রভাবে পৃথিবী ক্রমান্বয়ে স্বীয় ভারসাম্য এবং সকীয়তা হারিয়ে ফেলছে। এর কুপ্রভাবে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী সম্পূর্ণ ভাবে পানির নীচে তলিয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ইতমধ্যেই বিজ্ঞানীরা প্রকাশ করেছেন। প্রকৃতির ভারসাম্য ও পরিবেশ রক্ষার জন্য যে বিষটির প্রতি নজর দেয়া আবশ্যক, সেটি হলো পরিবার পরিকল্পনা। পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করে ছোট পরিবার গঠনের মাধ্যমে দেশকে অগ্রগতির দিকে ধাবিত করা অনেকাংশে সম্ভব। ছোট পরিবারে শিক্ষা বিস্তার যেমন দ্রুত সম্ভব, তেমনি সম্ভব দারিদ্রের অভিষাপ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১০ সালের খানা জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে। এর মধ্যে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ অতিদরিদ্র বা হতদরিদ্র। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ সালে বাংলাদেশের ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে ছিল। তখন হতদরিদ্রের হার ছিল ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিবার পরিকল্পনা প্রণয়নের ধাপ গুলোকে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করাই সময়ের অন্যতম মুখ্য দাবি।

গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে প্রজনন হারের সমন্বয়হীনতা বিশ্বজুড়ে নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। প্রজনন হার হ্রাস এবং গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে মোট জনসংখ্যার বিপরীতে তারুণ্যের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২৫ বছরে বিশ্বের বেশিরভাগ স্থানে মোট জনসংখ্যার বিপরীতে তারুণ্যের আনুপাতিক হার কমবে বলে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে। বাংলাদেশেও এ প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশে অবশ্য এ বিষয়ে কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। স্বাস্থ্য সচিব এম এম নিয়াজউদ্দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ জনগোষ্ঠী। তাদের সঠিকভাবে প্রতিপালন, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে সঠিক পুষ্টিসেবা নিশ্চিত করতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি ইউএনএফপিএর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,বিশ্বে বর্তমানে ১০-২৪ বছর বয়সের ১৮০ কোটি মানুষ রয়েছে। এ পরিমাণ মোট জনসংখ্যার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশ। আগামী ২৫ বছরে বিশ্বের বেশিরভাগ স্থানে মোট জনসংখ্যার বিপরীতে তারুণ্যের এই আনুপাতিক হার কমবে। এ সময়ে ইউরোপ ও আফ্রিকা বাদে সব অঞ্চলেই মোট জনসংখ্যায় কিশোর ও তরুণের শতকরা হার হবে ২০ শতাংশের বেশি। তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশেরই অবস্থান নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। ওইসব দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকায় উন্নত জীবনের সন্ধানে তাদের অন্য দেশে পাড়ি জমাতে হয়। বিশ্বজুড়ে তরুণ জনগোষ্ঠীর পেছনে দৈনিক দুই মার্কিন ডলারেরও কম ব্যয় করা হচ্ছে। এরপরও বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ দেশ আজও দারিদ্র্য বিমোচন নীতি তৈরিতে কিংবা জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করে না। তাই সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে ইউএনএফপিএ তরুণদের উন্নত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে কাজ করতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এ অবস্থায় ১১ জুলাই (শুক্রবার) পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ‘তারুণ্যে বিনিয়োগ, আগামীর উন্নয়ন’। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

জাতিসংঘের সর্বশেষ বিশ্ব জনসংখ্যা জরিপ ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের হাতে থাকা তথ্যানুযায়ী,বর্তমানে দেশে ১৫ কোটি ৬৬ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ৯ কোটি ৫৫ লাখ ৮৪ হাজার। এদের মধ্যে তরুণের সংখ্যা ১ কোটি ৩৫ লাখ ৪ হাজার এবং তরুণীর সংখ্যা ১ কোটি ৪১ লাখ ৪৫ হাজার। ২৯ শতাংশ তরুণ-তরুণীর বয়স ১৫-২৪ বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করেনি এবং মাত্র শূন্য দশমিক এক-শতাংশ কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে এখনও চিহ্নিত। বাল্যবিয়ের কারণে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের মধ্যে বেশিরভাগই তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। প্লান বাংলাদেশের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৬৪ শতাংশই ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক নূর হোসেন তালুকদার বলেন, পরিবারের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির সঙ্গে গুণগত সীমিত সন্তান সংখ্যার জন্য প্রয়োজন নতুন স্লোগান। আর বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে নতুন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৩১ শতাংশ তরুণ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তারাই বড় অংশীদার এবং শ্রমশক্তির মূল জোগানদাতা। এদের মধ্যে অধিকাংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত। কিছু অংশ বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কাজ করে এবং অল্প কিছু সংখ্যক বিদেশে যায়। অবশিষ্ট স্বল্পসংখ্যক তরুণ-তরুণী নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যাওয়া ৪ লাখ ৩২ হাজার ৬৯ জন শ্রমিক ১৪ হাজার ৪৬১ দশমিক ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ দেশে পাঠিয়েছে। জিডিপিতে এর অবদান ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজের জন্য সঠিক উন্নয়ন কৌশল, কর্মপরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে উপযুক্ত কাজের সুযোগ সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম নূর-উন-নবী বলেন,তরুণ সমাজকে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে গড়ে তুলতে পারলে আর্থ-সামাজিক ও কাঠামোগত উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব।

জানা যায়, ১৯৮৭ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে উপনীত হয়। পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সালে বিশ্বের জনসংখ্যায় বছরে যুক্ত হতো ৪ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ এর সময়ে এই হার উন্নীত হয় ৮ কোটি ৬০ লাখে। এই দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং এক্ষেত্রে জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণের আবশ্যকতা অনুভূত হয়। বিশেষত জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সমস্যাগ্রস্থ উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিরীখে বিষয়টি ভেবে দেখা হয়। এক্ষেত্রে আরও পরিলক্ষিত হয় যে, ১৯২৭ সালে বিশ্বে মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২০০ কোটি। ১৯৬০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩০০ কোটিতে। ক্রমেই জনসংখ্যাবৃদ্ধির বিষয়টি অনেকটা সর্তক সংকেতের রূপ লাভ করতে থাকে। ফলে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউ এন ডি পি) এর সুপারিশে প্রতি বছর ১০ জুলাই “বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস” পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৬০ সালে বিশ্ব জনসংখ্যা বুদ্ধির শতকরা ৭০ শতাংশ ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। এ হার বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে শতকরা ৮০ শতাংশে। অপরপক্ষে জনসংখ্যা বৃদ্ধির শতকরা ১৫ শতাংশ ঘটে পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশ গুলোতে। বর্তমানে বিশের জনসংখ্যা ৮০০ কোটি অতিক্রম করেছে। ১৯৬০ এ ৩০০ স্থলে বর্তমানে ৮০০ কোটি জনসংখ্যা উপনীত হওয়ার পেছনে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ বা নির্ধারকের ভূমিকা তা হচ্ছে ‘মৃত্যুহারের নজিরবিহীন হ্রাস’। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অগ্রগতির অন্তরালে জনসংখ্য বৃদ্ধি একটি মৌলিক এবং অনস্বীকার্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। খুব স্বাভাবিক ভাবেই একটি উন্নয়ণশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এই সমস্যার ঊর্ধ্বে নয়। আর তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির মাধ্যমে ৭০ দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাসের হার শতকরা ৮ থেকে ৫১ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য ছিল ২০০৫ সালের মধ্যে সার্বজনীন দু’সন্তানের পরিবার গড়ে তোলা বা এন আর আর-১ অর্জন করা। এ লক্ষ্যে ৫ বছর ব্যাপী স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা কার্যকর প্রোগ্রামের আওতায় ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে থেকে প্যাকেজ সেবা প্রদাণের কর্মসূচিও গ্রহণও করা হয়েছিল। কিন্তু সে কর্মসূচি কতোটা সফল তা প্রশ্নবিদ্ধ!

প্রসঙ্গত, ১৯৫১ সালে বর্তমান বাংলাদেশ নামের ভূখন্ডে জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪ কোটি। আজ সেটি প্রায় ১৬ কোটি। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০২০ সালে এ সংখ্যা ২১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। জনসংখ্যার এ বৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, সামাজিক জীবনে, পরিবেশ সংরক্ষণে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং সর্বপরি কর্মসংস্থানে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির অশণী সংকেত। সরকারি হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ৩ থেকে ১.৬ শতাংশে নেমে এসছে বলে দাবি করা হলেও বেসরকারি হিসাব এর পরিপন্থি। ১৯৬৯ সালে গঠিত জাতিসংঘ তহবিল (ইউএনইপিএ) এর স্বেচ্ছায় দেয়া চাঁদায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সর্বধিক সহায়তা প্রদান করেই যাচ্ছে। এই তহবিলের প্রধান কাজ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ভিত্তিতে জনসংখ্যা ও পরিবার পরিকল্পনার চাহিদার প্রতি সাড়া দানের সমর্থন গড়ে তোলা, জনসংখ্যা প্রশ্নে সচেতনতা সৃষ্টি, জনসংখ্যা কর্মসূচি ও প্রকল্প প্রণয়নে সরকার সমূহকে সহায়তা করা এবং সেগুলো বাস্তবায়নে আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের নিদের্শনা অনুযায়ী ১৯৯০ সাল থেকে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালন করে আসছে। নারীর নিরাপদ জীবন সামাজিক জীবনে উন্নয়নের প্রতিফলন ঘটাতে পারে,এই ব্রতের আলোকে এই দিবসটি পালন করা বাঞ্চনীয়।

[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।]

jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক