পণ্যমূল্যে উত্তাপ: প্রতিবাদ নেই কেন?

পণ্যমূল্যে উত্তাপ: প্রতিবাদ নেই কেন?

মীর আব্দুল আলীম: এই বাংলায় আমরা সবাই রাজা! কারোরই অর্থকড়ির অভাব নেই! তাই ১ টাকার জিনিস, ২ টাকায় কিনতেও নেই সমস্যা। ভাবখানাতো এমনই। এবারের রোজায় পণ্যমূল্য বেড়েছে অবিশ্বাস দরে। দাম বাড়ে হু হু করে। জনগন বাড়তি দামে এসব পণ্য কিনছে না তা কিন্তু নয়। নিত্যপণ্যের এতো দাম! তবুও দেশের কোথাও কোন প্রতিবাদ নেই। আমজনতার মুখে কুলুপ আঁটা। বলতে গেলে জনগনের গাঁটে পয়সা আছে; তাই গায়ে লাগছে না এই আর কি। কোন কোন পণ্য ৪০ টাকা থেকে লাফেয়ে বেড়ে হয়েছে ১ শ’ টাকা। কাঁচামরিচ ও বেগুনের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। প্রথম রোজয় ৪০ টাকার শসা বিক্রি হয়েছে প্রতিকেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা। কাঁচামরিচ ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হলেও চলতি রমজান মাসে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে। আর ৫০ টাকার বেগুন বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১০০ টাকা দরে। মাছ-মাংসের দামও বেড়েছে। কেজিপ্রতি পাঙ্গাস ১২০-১৪৫, সিলভার কার্প ১৫০-১৬০, শিংমাছ ৫০০-৬২০, তেলাপিয়া ১৫০-১৭০, দেশি মাগুর ৬০০-৮০০, চায়না পুঁটি ১৫৫-১৯০। দেশি আলু (লাল) ৪০, করলা ৫০-৬০, পটোল ৫০, কাকরোল ৪৫-৫০, চিচিঙ্গা ৪০-৫০, মিষ্টি কুমড়া ২৫-৩০, লাউ ৪০-৬০, কচুর লতি ৪০-৫০, গাঁজর ৪০-৫০ টাকা, পেঁপে ৪০-৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এটাই বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন বাজরের হালচিত্র। শুধু তরিতরকারি নয় ছোলা, খেজুর, মাছ মাংস সব কিছুর দামই এখন বেশ চড়া।
এখন দেশে অতি খরা নেই, নেই অতি বৃষ্টি, নেই হরতাল অবরোধও। তাহলে কেন এভাবে বাড়লো পণ্যমূল্য? রোজার মাসে বেশ কিছু পণ্যের চাহিদা অন্য মাসের চেয়ে বেড়ে যায়। চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও তার সুফল অনেক সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় পরিবহন চাঁদাবাজি ও মজুদদারির কারণে। এবারও বেড়েছে। চলতি সরকারের অধিনেই গত রমজানে বাজার অনেকটাই নিয়ন্ত্রনে ছিলো। এবার নেই। সিয়ামসাধনার মাসে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। মাহে রমজানে দ্রব্যমূল্য এবং চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে সরকার কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর  দপ্তর থেকেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রনে কঠোর নির্দেশ দিয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদেও সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেছে; পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। সারা দেশে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভাগীয় এবং জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কাজ করছেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। কিন্তু তাতেও কি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রনে আছে? প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রনালয় আর জেলাপ্রশাসনের তাবৎ হুমকী ধমকিকে কি পাত্তা দিলো ব্যবসায়ীরা?

প্রতিবছর রোজা আসে; বাড়ে জনগনের নাভিশ্বাস। এটা নতুন নয়। ঈদ আর রোযা মানেই পণ্যমূল্যের দাম বেড় যাওয়া। এটা দ্রব্যমূল্য বাড়ারই মওসুম। দীর্ঘদিন ধরে এটাই চলে আসছে এদেশে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রোযা শুরু হতেই দ্রব্যমুল্যের লাগামহীন পাগলা ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই। বর্তমানে অস্থির হয়ে উঠেছে বাজার। কোনই সুখবর নেই। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, ডিম, আলু, খেজুর, মাছ, মাংস, মসলা, কাঁচামরিচ, শাকসবজি, ফলমূলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। সংযম নয় এ যেন ব্যবসায়ীদের বেশি আয়ের মহাউৎসব। নিত্যপ্রয়োজনীয় হেন পণ্য নেই যে, গায়ে মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ নেই-তফাৎটা শুধু ডিগ্রির, কোনোটার বেশি কোনোটার কম। নতুন বাজেটের পরও পণ্যবাজারে তার বিরূপ প্রভাব পড়েনি। তাই সরকারি মহল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলো। কিন্তু কয়েকটা দিন পার না হতেই রমযানের আগমনী বার্তায়, কারন ছাড়াই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ লাগে। রমযান উপলক্ষে কতক বিশেষ পণ্যের চাহিদা বাড়ে। ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, মসুর, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, নানা রকম গরম মশলার চাহিদা বেড়ে অনেক। চাহিদা বাড়ে মাছ, মাংস, দুধের। আর ব্যবসায়ী-মজুদদাররা ধরেই নেয়, মুনাফায় পকেট ভারি করার মওকাই হচ্ছে সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র রমযান। রমযানে দুটো পয়সা কামিয়ে নিতে এরা কোমর বেঁধে প্রস্তুতি নেয় পূর্বাহ্নেই। মজুদ গড়ে তোলে, দফায় দফায় মূল্য বাড়িয়ে সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়ে। এসব মুনাফাখোররা এদেশের অসহায় মানুষের কথা ভাবে না। রোযায় নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের চাপিয়ে দেয়া দাম দিয়ে খাবার কিনতে পারছে না। ওরা ২ বেলা পেট পুরে খেতে পারছে না। আসলে মানুষকে জিম্মি করে অধিক মুনাফা লাভের ব্যবসায়ীদেও এই খেলা কোন সরকারই বন্ধ করতে পারে না, একথা কেউ বিশ্বাস করবে না। সরকারের সৎ ইচ্ছা থাকলে এই খেলা বন্ধ করা অবশ্যই সম্ভব, কিন্তু এই সম্ভবকে অসম্ভবের হাত থেকে বাঁচাতে সরকারকে অবশ্যই হার্ড লাইনে চলতে হবে। প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে সেই সকল অসাধু ব্যবসায়ীদের যারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের সকল বিবেকহীন আয়োজন সম্পূর্ণ করেছে।
অর্থনীতিতে একটা কথা আছে, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন যতো কম হবে পণ্যের দাম বাজারে ততো বেশি হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও চারদলীয় জোট সরকার এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের সময় দেখেছি, যতবার পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, ততবার বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা সরকারকে বারবার আশ্বাস দিচ্ছে, রোযার মধ্যে পণ্যের দাম বাড়বে না।  কিন্তু বাস্তবে তা তামাশা মাত্র! তার কোনো প্রভাব বাজারে পড়েনি কখনো। দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য অসৎ ব্যবসায়ী সব সময়ই বেপরোয়া। তারা মন্ত্রী, সচিব, ডিসি এসপিদের ছোঁড়া হুংকারকে দিব্যি ধিক্কার দিয়ে চলেছে। অসৎ বৃহৎ ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠী বড়াবরই পণ্যমূল্য বাড়িয়ে তাদের পকেট স্ফীত করে চলেছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ সরকারকে যেকোন মূল্যে নিতেই হবে। এজন্য বিরোধীদলগুলোকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এভাবে অহেতুক পণ্যমূল্য বাড়ার ঘটনা বোধ করি কোন সভ্য সমাজে ঘটে না। অন্য কোন দেশেও তার নজির নেই। এভাবে আর চলতে পারে না। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এখনই ওদের রুখতে হবে। সরকার, জনগণ দলমত নির্বিশেষে ওদের উপর দুর্বার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। প্রতিবাদি হতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে এর আর বিকল্প আছে বলে আমি মনে করি না।
দ্রব্যসামগ্রী অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের মূল্য স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারে বর্তমান পরিস্থিতিতে যা করা দরকার তাহলো- সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তাদের নেয়া পদক্ষেপগুলো কার্যকর করতে হবে। যেকোন মূল্যে মধ্যস্থানীয় শ্রেণীর কারসাজি বন্ধ করতে হবে। সরকারকে ব্যবসায়ীদের ওপর বাজার নিয়ন্ত্রণের নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য সামঞ্জস্য আছে কিনা নিয়মিত তা তদারকি করতে হবে। দোকানদারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজদের চাঁদাবাজি বন্ধের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। রমযান মাসে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি, তা বেশি করে যোগান দিতে হবে। পাইকারি বাজার থেকে মধ্যশ্রেণীর গোষ্ঠী যাতে স্বার্থ হাসিল না করতে পারে, সেজন্য পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত সরকারি নিজস্ব পরিবহন ও জনবলের মাধ্যমে খুচরা বাজারে পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়া যেতে পারে। তাতে করে চাঁদাবাজদের চাঁদাবাজিও বন্ধ হবে। বেশি করে পণ্য আমদানি করে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করা। আরো বেশি করে সরকারি বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা করা। সর্বোপরি ব্যবসায়ীদের পবিত্র মাহে রমযানের পবিত্রতা অনুধাবন করে এখনি শপথ নেয়া উচিত-‘আমরা পণ্যসামগ্রী মজুদের মাধ্যমে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়াবো না এবং পণ্যসামগ্রীতে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করবো না।’ আগাম সতর্ক বার্তার মতো উচ্চারণ করা যায়, রমযানে বাজার একবার চড়লে সেই চড়া বাজার আর নামতে চায় না। এটা হচ্ছে অতীতের অভিজ্ঞতা। সে জন্য পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে যা যা করা দরকার তা সরকারকে করতে হবে। এজন্য বাজার মনিটরিংয়ে সরকারকে আরও চৌকস হতে হবে। আর তাতে হয়তো কিছুটা মুক্তি মিলতে পারে।

[লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও সম্পাদক- নিউজ-বাংলাদেশ ডটকম।]

e-mail-newsstore13@gmail.com

অতিথি লেখক