শান্ত,সাকিব এবং আমি!

শান্ত,সাকিব এবং আমি!

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: ফেসবুকে আমার বন্ধু তালিকায় থাকা দু’জনের নামের শেষাংশ ‘শান্ত’। এই দুই জনের সাথে আমার পরিচয় ২০১১ সালে। সকালের খবরে। নামের সাদৃশ্য থাকলেও মানসিকতায় এই দুই ‘শান্ত’ দুই মেরুর। একজন আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করেন। সুখ-দুঃখের বিবিধ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা থেকে শুরু করে ফান,দুষ্টামিও বাদ যায় না।

আমি সোহরাব শান্ত’র কথা বলছি।  যদিও সম্প্রতি বিবিধ পত্রিকায় তার লেখা সোহরাব আলম নামেও ছাপা হতে দেখছি। শুরুতেই বলেছি শান্ত’র সাথে আমার পরিচয় সকালের খবরে। একই পত্রিকায় আমরা কাজ করতাম। একই তলায় বসতাম।  শান্ত আর আমার কাজ ভিন্ন।  বসার ডেস্কও বেশ দূরত্বে। এর আগে আমাকে শান্ত চিনতো না। আমিও না। কিন্তু কেন জানি না শান্ত এবং আমার মধ্যে একটি চমৎকার সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়। প্রতিদিন দুপুরে খাওয়ার পর নীচে চা খেতে যাওয়া ছিলো আমাদের নিয়মিত রুটিন।

বায়তুল মোকাররম সংলগ্ন চায়ের দোকান। সেখানে শুধু চা নয়,বিভিন্ন ধরনের দোকান রয়েছে। ফুটপাত ঘিরে যেন মার্কেট। শান্ত’র স্বভাব ছিলো এইসব দোকান থেকে টুকটাক জিনিস কেনা। প্রায় প্রতিদিন। একটি বই বা ম্যাগাজিন হলেও শান্তর কিনতেই হবে। তাছাড়া বাড়ি যাওয়ার আগে ছোট ভাই-বোনদের জন্য বিভিন্ন শো-পিস কিংবা যখন যেটা পছন্দ।

ফ্ল্যাশব্যকে পেছনের সব স্মৃতিই মধুর। আমার এবং শান্তর স্মৃতি সুমধুর। আমার পরিস্কার মনে আছে,যেদিন আমি সকালের খবরের চাকরি ছেড়ে দিই,সেদিনও শান্ত’র সাথে আমার দেখা। শান্ত আমাকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলো। সার্বক্ষণিক ফুটফুটে হাসিতে বিদায় জানিয়েছিলো। সেটাও প্রায় দুই বছর আগের কথা। মাঝে শান্ত’র সাথে আমার যোগাযোগ ছিলো না। আমরা দু’জন-ই দু’জনের ফোন নম্বর জানি। কিন্তু কেউ কাউকে নক করিনি। হঠাৎ ফেসবুকে শান্ত’র ফ্রেণ্ড রিকোয়েষ্ট। আমি গ্রহণ করি। আমাদের আলাপচারিতা আবার শুরু হয় তবে এবার ডিজিটাল পদ্ধতিতে। চ্যাটের মাধ্যমে।

গত বছরের শেষ দিকে কিংবা এই বছরের প্রথমার্ধে। শান্ত হঠাৎ জানালো সাকিব অসুস্থ। সাকিবের হৃদযন্ত্রে সমস্যা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সে বেশ বিচলিত। বহু পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়েছে। নিয়মিত ডাক্তারও দেখানো হচ্ছে। শান্ত সর্বত্র চেষ্টা করছে। খোঁজ-খবর করছে। কোথায় গেলে সাকিবকে সম্পূর্ণ সুস্থ্য করে তোলা যায়! এই বিষয়ে প্রায় প্রতিদিন শান্ত’র সাথে আমার চ্যাটালাপ হতো। দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি তার আস্থা অনেক। আমি আমার সীমিত জ্ঞান নিয়ে শান্ত’র সাথে কথা বলতাম। টুকটাক পরামর্শও দিতাম। নিজের অজ্ঞতা ঢাকার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম পরামর্শ দেয়া। আমি সেটি করতাম। কিন্তু শান্ত বুদ্ধিমান। সে আমার মতো নিরেট অপদার্থের পরামর্শ গ্রহণ/বর্জন কোনটাই করতো না। সে নিজে জেনে বুঝে যেটা ভালো মনে করতো সেটাই করতো।

বেশ কিছুদিন হলো আমার ইনসমনিয়া হয়েছে। এটি অনিদ্রা রোগ। সারারাত ঘুম হয় না। সারা ঢাকা যখন ঘুমায় তখন আমি বাসার ছাদে বসে থাকি। এটা এক ভয়াবহ যন্ত্রণা। যারা এই রোগাক্রান্ত,তারাই শুধু বুঝতে পারবেন,এটা আসলে কতোটা সাংঘাতিক! যাই হোক। আমার মতো একজন সারারাত না ঘুমালে কারও কিছু যায় আসার কথা নয়। এমনি এক রাতে,শান্ত’র সাথে ফোনালাপ হচ্ছে। দীর্ঘদিন পর শান্ত’র সাথে সরাসরি কথা। তখন জানতে পারলাম,সে তার ছোট ভাই-বোনদের ঢাকায় নিয়ে আসতে চাইছে। ঢাকার পড়া-লেখা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চেয়ে নিঃসন্দেহে ভালো। তার এক ভাই এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এক বোনও দিচ্ছে এইচএসসি। ঢাকার ভাল কোনো কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর চেষ্টা করবে সে। ঢাকায় ভর্তি করাতে পারলে,ভবিষ্যত উজ্জ্বল। ভাই-বোনদের প্রতি শান্ত’র মমত্ববোধ আমি জানতাম। হয়তো সেজন্যেই শান্ত এই বিষয় গুলো নিয়ে আমার সাথে আলাপ করতো বা করে।

আমি সোমবার এবং ২৮ তারিখকে কুফা মানি। এই দুটো আমার জন্ম বার এবং তারিখ। নিজেকে পৃথিবীর বোঝা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না আমার। প্রযুক্তির যুগে আমার এই কুসংস্কারছন্ন মনোভাব সংগত কারণেই অযৌক্তিক। তবুও আমি সোমবার সর্তক থাকি। প্রকৃতি আমার সর্তকতায় গুড়েবালি দেয়!

১৪ জুলাই (সোমবার) রাত ৯টার দিকে লাশের গাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ডাকাতের কবলে পড়ে এক সাংবাদিক হত হয়েছে। এই  ধরণের একটি সংবাদ ফেসবুকের দেয়ালে। লিংক ক্লিক করলাম। ডিজিটাল যুগ। তাই লোডশেডিং এর শোভা এড়ানোর উপায় নেই। লিংক আর পড়ার সুযোগ হলো না। পরদিনও একই অবস্থা। রাত সাড়ে ১২টা। লিংক খুলে দেখি আহত সাংবাদিক আর কেউ নয়,আমার প্রিয় ‘শান্ত’। এদেশে ডাকাত মারবে,ছিনতাইকারী/পুলিশ ধরবে সেটা স্বাভাবিক। সাহসী শান্ত এসব বিষয়ে ভড়কে পড়বে সেটা ভাবার কোন কারণ নেই। তবুও,শান্ত’র বিষয়টি জানতে চেষ্টা করলাম। বিভিন্ন লিংক পড়ে বিভ্রান্ত হলাম। একেক পত্রিকায় একেক ধরণের নিউজ। এগুলো দেখে বা পড়ে নিজেকে একজন সাংবাদিক ভাবতে লজ্জা হচ্ছিলো। এমন প্রায়শই হয়। এটিও আমার ব্যর্থতা। সময়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারার সীমাবদ্ধতা।

শান্তকে ফোন করলাম। শান্তর কন্ঠ শীতল। এই কন্ঠ আমার কাছে একেবারেই অপরিচিত। তবুও যথা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে চেষ্টা করছে সে। আমাকে ‘আদাব’ দিতেও ভুল হয়নি। বিষয়টি আমি আঁচ করতে চেষ্টা করলাম। আমার মোটা মাথায় কোন কিছু সহজে ঢুকবে তা তো নয়। আমার অসহায়ত্বকে অনুধাবন করে শান্ত বিষয়টি পরিস্কার করলো। “দাদা…সাকিব আর নেই! পারলাম না তাকে বাঁচাতে…”। আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না। মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেছে। একটি প্রশ্ন মাথার চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী এতো নিষ্ঠুর কেন? কোনদিন না দেখা সাকিবের জন্যে বুকের কোথায় যেন তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম। নিজেকে আরও বেশী অপরাধী মনে হতে লাগলো…

বদিউল আলম সাকিব। ১৩ (প্রায়) বছর বয়স। ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। আমার মতো অনেকের বুকে ব্যথা দিয়ে, এখন পরলোকের বাসিন্দা। তার অসুখটি খুব গুরুতর ছিলো না। বঙ্গবঙ্গু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসা হচ্ছিল। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ তেমন ভয়ের কিছু বলেননি। তাহলে কেন সাকিবের এই মৃত্যু? চিকিৎসকগণ যদি ভয়াবহ কিছু বলতেন,তাহলে একটা মানসিক প্রস্তুতি থাকে। সাধ্যানুযায়ী চিকিৎসার চেষ্টা করানো যেতে পারে। সাকিবের মতো বহু মানুষ প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। এই মৃতের কোন পরিসংখ্যান নেই। আমি বলবো এই মৃত্যু চিকিৎসকদের অবহেলা। একটি পরিবারের সার্বিক বিপর্যয়ের দ্বায় নেবে কে? চিকিৎসকদের জবাবদিহিতার কোন দৃষ্টান্ত এদেশে নেই। সেটি থাকলে হয়তো আজ অন্তত এই সেক্টরটির চিত্র ভিন্ন হতো। নিয়তিকে এতো বেশী দোষারোপ না করলেও চলতো।

জীবন থেমে থাকে না। জীবন বহমান। চলছে,চলবে। সাকিবের অনুপস্থিতি একদিন তাকে ভুলে যেতে বাধ্য করবে। তাই নয় কী?

[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।]
jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক