প্রয়াণে মুক্তিযুদ্ধের শব্দ সৈনিক বাবুয়া বোস

প্রয়াণে মুক্তিযুদ্ধের শব্দ সৈনিক বাবুয়া বোস

সৈকত রুশদী: রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের সূতিকাগার মেহেরপুরের গর্ব প্রসেনজিৎ বোস বাবুয়া, যিনি সুপরিচিতি ছিলেন বাবুয়া বোস নামে, সোমবার (১৩ অক্টোবর ২০১৪) মেহেরপুরে নিজ বাসগৃহে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন |

গভীর শ্রদ্ধা জানাই মুক্তিযুদ্ধের এই শব্দ সৈনিকের প্রতি | যুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নানা অনুষ্ঠান, বিশেষ করে ব্যঙ্গধর্মী ধারাবাহিক নাটক ‘জল্লাদের দরবার’-এ লারকানার নবাব (জুলফিকার আলী ভুট্টো) চরিত্রে তাঁর অনবদ্য অভিনয় ছিল উদ্দীপনামূলক | কেবল অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতা প্রত্যাশী অবরুদ্ধ ও শরণার্থী বাঙালিদের মনোবল বৃদ্ধিতে যে অবদান রেখেছেন তা’ তুলনাহীন | জীবদ্দশায় তাঁকে আমরা যোগ্য সম্মান দিতে পারিনি | মেহেরপুরবাসী হিসেবে এবং জাতি হিসেবে এটি আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতা |

স্বাধীনতা অর্জনের চার দশক পার হতে না হতেই সেই সময়ের তরুণ, যুবা মুক্তিযোদ্ধারা, যাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশের অহংকার, বিদায় নিচ্ছেন একে একে | স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁদেরকে যোগ্য সম্মান প্রদান এবং আত্মসম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে জীবন যাপনে সহায়তার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও এই জাতি কতোটা করেছে, তা’ কী আমরা কখনও ভেবে দেখেছি? খন্ডিতভাবে বিভিন্ন সরকার তাঁদের সমমনা ও ভিন্নমতের মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে পৃথকভাবে বিবেচনা করেছেন এবং করে আসছেন, তা’ কী আমাদের জন্য গৌরবজনক ! জাতি হিসেবে কী আমরা পারিনা দলমত নির্বিশেষে তাঁদের অবদানকে সম্মান দেখানোর ন্যূনতম একটি রাষ্ট্রাচার নির্ধারণে একমত হতে? সম্মানজনকভাবে তাঁদের জীবনধারণের ব্যবস্থা করে দিতে |

আমার সৌভাগ্য যে বাবুয়া বোসের স্নেহের ধারায় সিক্ত বহু মানুষের একজন ছিলাম | দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই যখন ঢাকা থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মেহেরপুর গেলাম ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে, তখন মুক্তিযোদ্ধা চাচা নাজমুল হক খোকনের সাথে নানা জায়গায় যাওয়ার সুবাদে তাঁর সাথে প্রথম পরিচয় | জানতে পারি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা | তিনি অবশ্য আমাকে চিনতেন বোধ করি আমার জন্মের পর থেকেই, কুষ্টিয়া জেলার প্রখ্যাত চিকিত্সক মেহেরপুরের ডাক্তার জাফর আলীর জ্যেষ্ঠ পৌত্র হিসেবে | পরে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে যখন মেহেরপুর গিয়ে প্রায় মাস তিনেক ছিলাম, তখন বেশ কয়েকদিন তাঁর সান্নিধ্যে কেটেছে | তিনি যে কতটা স্নেহশীল ও নিরহংকারী ছিলেন তার একটি নমুনা দেখতে পাই ১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে | তখন আমি ঢাকায় কানাডিয়ান হাই কমিশনে তথ্য কর্মকর্তা | ঈদ উপলক্ষে মেহেরপুরে গিয়েছি বাবা-মায়ের কাছে | ঈদের পরদিন সকালে দেখি আমাদের বাড়িতে উপস্থিত তিনি | ঢাকা থেকে সাংবাদিক বন্ধু ইরতিজা নাসিম আলী (প্রধান সম্পাদক, প্রোব এবং প্রোব নিউজ এজেন্সি) আমার সাথে যোগাযোগের উপায় খুঁজে না পেয়ে টেলিফোনে তাঁকে জানিয়েছেন, ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশন আমাকে খুঁজছে | কিছুক্ষণ কথা হলো তাঁর সাথে | যোগাযোগ করলাম ইরতিজার সাথে | একদিন পর ঢাকায় ফিরে যোগাযোগ করলাম অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনে | তাঁরা একজন তথ্য কর্মকর্তা খুঁজছিলেন | আমার সাথে অনানুষ্ঠানিক আলাপের পর ঐ পদে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হলো | কানাডিয়ান হাই কমিশনের চেয়ে ভাল সুবিধা | চাকুরীর জন্য আবেদন না করেই পেলাম এই আমন্ত্রণ | যোগ দিলাম এপ্রিলে | মাস তিনেক পরই অবশ্য আমি আরও বড় পরিসরে, বেশি দায়িত্ব ও সুবিধার সুযোগ পেয়ে চলে যাই ঢাকায় ব্রিটিশ হাই কমিশনে গণবিষয়ক শাখা প্রধান ও উর্ধ্বতন গণবিষয়ক কর্মকর্তা পদে | কিন্তু একথা আমার কখনও ভুলবার নয় যে, বাবুয়া বোসের মত ব্যক্তিত্ব আমার বাড়ি বয়ে খবর দিয়েছিলেন বলেই অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনের সাথে যোগসূত্রটি পুন:প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সময়মতো | তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার আমার শেষ নেই |

আপাদমস্তক সংস্কৃতিসেবী এই মানুষটি ছিলেন মেহেরপুরের সংস্কৃতি জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র | আলোকবর্তিকা স্বরূপ | তাঁর প্রয়াণে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো তা’ অপূরণীয় | তাঁর দেখানো পথ ধরে পরবর্তী প্রজন্ম মেহেরপুর তথা বাংলাদেশে একটি উঁচু মানের সাংস্কৃতিক আবহ সৃষ্টিতে এগিয়ে যাবে বলে আশা করি | একটি অসাম্প্রদায়িক, পরমতসহিষ্ণু ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে তাঁর অবদানের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য তখনই কেবল সার্থক হয়ে উঠবে | শব্দ সৈনিক বাবুয়া বোসের বিদেহী আত্মার পরম শান্তি প্রার্থনা করছি |

[সৈকত রুশদী: প্রবাসী সাংবাদিক]
টরন্টো,১৩ অক্টোবর ২০১৪।।

অতিথি লেখক