এপার বাঙলা ওপার বাঙলা মাঝখানে কাঁটাতার…

এপার বাঙলা ওপার বাঙলা মাঝখানে কাঁটাতার…
ছবি: জবরুল আলম সুমন।

জবরুল আলম সুমন: গুণীজনেরা বলে থাকেন, বোকারা করে তর্ক আর জ্ঞানীরা করে আলোচনা। হয়তো গুণীজনদের কথা মাথায় রেখেই কোন বিতর্কিত বিষয় নিয়ে সহজেই যুক্তি বা তর্কে আর যাইনা। একথা বার বার ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলার দরকার নেই যে আমি দীর্ঘ দিন ধরে ফেসবুকে অনিয়মিত এবং সেই সাথে স্বীকার করি আগের মতো সমসাময়িক বিবিধ বিষয় নিয়ে চর্চা করিনা, হয়তো নিজেকে খুব বেশি গুটিয়ে নিয়েছি কিংবা খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছি। তারপরও যখন খুব বেশি একঘেয়েমি চলে আসে তখন দেশে বিদেশে অবস্থানরত চেনা পরিচিত বন্ধু-বান্ধব বা প্রিয় মানুষদেরকে ফোন করি, খোঁজ খবর নিই আবার অনেকেই নিজ থেকেই আমাকে ফোন করেন, প্রাত্যহিক সময়গুলো এভাবেই কাটছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের সমর্থকদের মধ্যে যা হচ্ছে তা যুদ্ধের চেয়ে কোন অংশে কম নয়, মাঠের যুদ্ধ থেমে গেলেও কথার যুদ্ধ থেমে নেই, যে যেভাবে পারছে সেভাবেই প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার চেষ্টা এখনো চলছে, এই বাকযুদ্ধ আগুনের লেলিহান শিখার মতো ছড়িয়ে পড়ছে একজন থেকে অন্যজনে বা বহুজনে, বিভাজনে! জাতি হিসেবে বাঙালীরা খুব বেশি আবেগপ্রবণ। আমাদের আবেগের জায়গাগুলোতে একটু ফুঁ দিলেই আবেগের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে, এই আগুন নেভানোও বেশ শক্ত! এটা বারবার প্রমাণিত।

গত ২৬শে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস ছিলো। আমাদের জীবনে স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব অনেক। এই স্বাধীনতা কেবল অহংকার আর গৌরবের বিষয়’ই নয় বরং আবেগেরও। স্বাধীনতা বা বিজয় অর্জনের পর থেকে প্রত্যেক বছরই এই দিনে আমরা বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি আমাদের পূর্বসূরী, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। বিশেষ করে সোস্যাল মিডিয়াতে ঝড় তুলি আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বীরত্ব গাঁথা নিয়ে, অন্তত এই দিনে সব কিছু ছাপিয়ে আমাদের বীর নায়কেরাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেন! তবে এবার একটু ব্যতিক্রম মনে হলো, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশা-পাশি চলমান ক্রিকেট প্রসঙ্গও আলোচনার প্রধান কেন্দ্রতে ছিলো।

আমি খুব একটা ক্রিকেটানুরাগী না হলেও ব্যক্তিগত ভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট চর্চাকে বেশ সমীহ করি, ভালোবাসি প্রধানত দুটি কারণে। বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণেই দুটি বা তারও বেশি ধারায় বিভক্ত হয়ে আছেন, এই বিভাজিত মানুষজনদের কেবল মাত্র ক্রিকেটই এক কাতারে দাঁড় করাতে পারে। মতপার্থক্যকে মতানৈক্যে রূপান্তরিত করার জন্য ক্রিকেটের বিকল্প আর নেই। দ্বিতীয় কারণটা হলো আমাদের ক্রিকেট নৈপুণ্য এখন এমন একটা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে যে আমরা যেকোন ক্রিকেট পরাশক্তিকে ধরাশায়ী করার সামর্থ রাখি। আমাদের এই সামর্থ একাধিকবার প্রমাণ করেছি। ভাবতে গর্ব হয়, যোগ্য দল হিসেবেই নিউ জিল্যান্ড এবারের বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলবে, অথচ এই নিউ জিল্যান্ডকেই আমরা হোয়াট ওয়াশসহ পর পর সাত বার হারিয়েছি, এবং এবারে বিশ্বকাপ আসরে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে অন্যান্য দল যেখানে ছিলো নিষ্প্রভ ও প্রাণহীন সেখানে আমরাই তাদের বিপক্ষে সপ্রতিভ ও প্রাণবন্ত ছিলাম। জিততে জিততেই হেরেছি, ক্রিকেটীয় ভাষায় যাকে বলে সম্মানজনক হার। অন্তত এই দুটি কারণ বিবেচনায় ক্রিকেট আমাদের কাছে শুধুমাত্র একটি খেলা’ই নয়, আমাদের অহংকার, আমাদের চেতনার অংশ।

কোয়ার্টার ফাইনালে বাজে আম্পায়ারিংয়ের মাধ্যমে খুবই অন্যায় ভাবে বাংলাদেশকে হারানো হয়েছে। বিশ্বখ্যাত ক্রিকেট ব্যক্তিত্বরা বাজে আম্পায়ারিংয়ের প্রতিবাদ করেছেন নিজ নিজ অবস্থানে থেকে। খোদ ভারতের অনেক বিখ্যাত ক্রিকেটার ও ক্রিকেটানুরাগীরা ভারতের এই চক্রান্তের জয় মেনে নেননি, সঠিক আম্পায়ারিং হলে ফলাফল অন্যরকম হতে পারতো তাও অনেকেই স্বীকার করেছেন। খুব স্বাভাবিক ভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তরা এই বাজে আম্পায়ারিং মেনে নিতে পারেননি। নিজেদের বিরুদ্ধে এমন চক্রান্ত পৃথিবীর কেউই বোধ করি মেনে নিতে পারবেনা তাই বাংলাদেশী ভক্তরা যে যার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ জানিয়েছেন কেউ কেউ রাগ ক্ষোভ ঝেড়েছে হয়তো একটু বেশিমাত্রায়। কলকাতার অনেক বাঙালী বন্ধুরা বাংলাদেশী সমর্থকদের সান্ত্বনা দিলেও বেশির ভাগ বাঙালী বন্ধুরা বাংলাদেশী সমর্থকদের সাথে বাক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।

আমি অবাক হয়ে দেখেছি ওপার বাঙলার অনেকেই বাংলাদেশী সমর্থকদের কাঙ্গালী, ছোট লোক বলতেও দ্বিধা করেননি। শুরুটা করেছিলেন প্রসেনজিৎ তার হাত ধরে রূপম ইসলাম অব্দি এই গালাগালের সংস্কৃতি পৌছেছে! অথচ উল্লেখিত এই দুজনই বাংলাদেশেও তুমুল জনপ্রিয়, অনেকেই এদের দুজনকেই আদর্শ হিসেবে দেখে থাকেন। ব্যক্তিগত ভাবে আমি রূপমের গানের একজন অন্ধভক্ত তাই রূপমের এই আচরণ আমাকে খুব বেশি ব্যথিত করেছে। আমার খুব বলতে ইচ্ছে করে, কলকাতার বন্ধুরা বা বাঙালীরা বহির্বিশ্বে যেসব বাঙালীদের নিয়ে গর্ব করে তাদের সিংহ ভাগই কিন্তু আমাদের এই বাংলাদেশের প্রোডাক্ট! ওপার বাঙলার রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্যকে যারা সমৃদ্ধির শিখরে নিয়ে গেছেন তাদের বেশির ভাগের শিকড় কিন্তু আমাদের এই বাংলাদেশে। নোবেল জয়ী আমর্ত্য সেন (মানিকগঞ্জ), প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ (ঢাকা), জ্যোতি বসু (নারায়ণগঞ্জ), বুদ্ধদেব বসু (কুমিল্লা), পন্ডিত রবি শংকর (নড়াইল), অতুলপ্রসাদ সেন (ফরিদপুর), সুচিত্রা সেন (পাবনা), শচীন দেববর্মণ (কুমিল্লা), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (ফরিদপুর), শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (ময়মনসিংহ), মিঠুন চক্রবর্তী (বরিশাল), মিতালী মূখার্জি (ময়মনসিংহ), নচিকেতা চক্রবর্তী (বরিশাল), হালের শ্রেয়া ঘোষাল (ঢাকা) সহ অনেক পরিচিত নাম চোখে ভাসবে যাদের জন্ম আমাদের এই বাংলাদেশে কিংবা তাদের বাপ-দাদার ভিটে মাটি এই বাংলাদেশে, তাদের নাড়ি পোঁতা আমাদের এই বাংলাদেশে। তাই বাংলাদেশীদের কাঙাল বা ছোট লোক বলার আগে নিজেকে আরো বেশি সংযত করা উচিত, একটু হলেও ইতিহাস ঘাঁটা উচিত; না হলে বাঙালীদের গালমন্দ করে কিছু বললে সেটা নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল হবে।

যতদূর মনে পড়ে কোন এক বিখ্যাত মার্কিন নাগরিক কলকাতাকে ঈশ্বরের বিষ্ঠার সাথে তুলনা করেছিলেন। হয়তো সেদিনের সেই কলকাতা ঈশ্বরের বিষ্ঠা হিসেবেই আজও দূর্গন্ধ ছড়াতো যদি না বাংলাদেশের উল্লেখিত এই গুণী মানুষেরা কলকাতায় গিয়ে আপন প্রতিভার সৌরভ ছড়িয়ে কলকাতাকে আজকেই এই অবস্থানে নিয়ে আসতেন। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। জাতি হিসেবে আমরা যেমন বাঙালী তেমনি জাতীয়তাও আমাদের বাংলাদেশী। দেশ ও ভাষা দুটোতেই বাংলার স্পর্শ এবং অহংকার, এই অহংকারটা কেবল বাংলাদেশের বাঙালীরাই করতে পারে। বাঙালিয়ানায় ষোল আনা স্বকীয়তা কেবলমাত্র বাংলাদেশী বাঙালীদের মাঝেই আছে।

বাংলাদেশে জন্মেছি বলেই হয়তো কলকাতা বা ওপার বাঙলার মাটিকে অতটা আপন মনে না হলেও ওপার বাঙলার মানুষগুলোকে বড় বেশি আপন মনে হয়। ওপার বাঙলার মানুষগুলোও যে ঠিক আমাদের ভাষায় কথা বলে, প্রাণ প্রিয় বাঙলা ভাষায় কথা বলে, সবচে বড় কথা ওপার বাঙলার অধিকাংশ মানুষের নাড়ি পোঁতা আমাদের এপার বাঙলাতেই এই নিরেট সত্যটা কি অস্বীকার করার উপায় আছে? সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে দুই বাঙলার মানুষের মধ্যে যে ফাটল ধরেছে তা অন্য অনেকের মতো আমাকেও ব্যথিত করেছে। ওপার বাঙলাতে আমারো অনেক প্রিয় মানুষ আছেন যাদের সাথে প্রতি নিয়ত আমি আমার সুখ দুঃখকে ভাগা-ভাগি করি। মাঠের যুদ্ধকে মাঠেই ছেড়ে দিই, দিন ফুরিয়ে যায়নি, আমাদের সাথে যে অন্যায় করা হয়েছে তার জবাব মাঠেই দেবো। সেটা আগেও বলেছি আমাদের ক্রিকেট নৈপুণ্য এখন এমন একটা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে যে আমরা যেকোন ক্রিকেট পরাশক্তিকে ধরাশায়ী করার সামর্থ রাখি। আমাদের এই সামর্থ একাধিকবার প্রমাণ করেছি। সময় পেলে সেটা আরো একবার আমাদের দামাল ছেলেরা বুঝিয়ে দেবে। এবার তবে সব ঝগড়া ঝাটির অবসান ঘটিয়ে আমাদের পরিচয় হয়ে উঠুক আমরা বাঙালী, আমরা একে অন্যের ভাই।
এপার বাংলা ওপার বাংলা
মাঝখানে কাঁটাতার,
সুযোগ পেলে কাঁটাতার ডিঙ্গিয়ে
আসিয়ো এক বার;
এই হাতে হাত মিলিয়ো বন্ধু
আসিয়া আমার কাছে,
তুমিও বাঙাল আমিও বাঙাল
একই আকাশের নীচে।

[জবরুল আলম সুমন: প্রাবন্ধিক।।]
সিলেট।
২৮শে মার্চ ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ।

অতিথি লেখক