বিপ্লবী সাহিত্যিক সোমেন চন্দ’র ৯৫ তম জন্মদিন

বিপ্লবী সাহিত্যিক সোমেন চন্দ’র ৯৫ তম জন্মদিন

বিপ্লবী সাহিত্যিক সোমেন চন্দ।

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: সোমেন চন্দ। বাংলা সাহিত্যের তিন উদীয়মান তরুণ সাহিত্যিকের একজন। সুকান্ত কবি হিসেবে আর সোমেন চন্দ আধুনিক কথাশিল্পের স্থপতি হিসেবে এবং খান মোহাম্মদ ফারাবী উভয়কেই ধারণ করে বাংলা সাহিত্যে পরিচিতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই তিন সাহিত্যিকের কেউ ২২ বছর বাঁচতে পারেননি। অর্থাৎ ২১শের ঘরে তাঁদের জীবনের সম্পাত্তি ঘটে। সোমেনকে হত্যা করা হয়। অন্য দু’জন মরণব্যাধী যক্ষা ও ক্যান্সারে মারা যান।

তারুণ্যের গান, সৃষ্টির উম্মাদনা ও বিদ্রোহের অগ্নি জেলে সাহিত্যে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন সোমেন চন্দ। অন্যায়, অত্যাচার, অসঙ্গতি ও অসহায়ত্বের কাছে কখনো মাথা নত করেননি। তাঁর সাহিত্যের  বিষয় ছিল কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষকে ঘিরে। শোষণ-বৈষম্য থেকে মানুষকে মুক্ত করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য ও স্বপ্ন। এস্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে নিয়েজিত করেন সেই শৈশব থেকে। সোমেন চন্দ এমন একটি মানুষ,যে হতাশাগ্রস্থ প্রতিটি মানুষকে জাগ্রত করে নতুন উদ্যমে পথ চলতে সহয়তা করে। প্রথাগত কমিউনিজমের ফ্যাশনের মোড়কে নয়,সত্যিকারার্থে কমিউনিজম ছিল তার প্রেরণা। কমিউনিজমের দর্শনের আলোয় চেতনাকে শান প্রতিনিয়ত। কমিউনিজমই ছিল তার মূল দর্শন। কলম তার সংগ্রামের পাথেয়। আর খেটেখাওয়া মেহনতি মানুষ ছিল তার বেঁচে থাকার প্রেরণা। খাঁটি কমিউনিস্ট বলতে যা বুঝায়, সোমেন চন্দ ছিল তাই।

সোমেন চন্দ ১৯২০ সালের ২৪ মে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার নিকটবর্তী বুড়িগঙ্গার পশ্চিম পাড়ে শুভাড্ডা ইউনিয়নের তেঘরিয়া গ্রামে।  তাঁর বাবার নাম নরেন্দ্রকুমার চন্দ। আর মায়ের নাম হিরণবালা। সোমেন চন্দের পিতামহের নাম রামকুমার। নরেন্দ্রকুমার চন্দের আদিনিবাস ছিল ঢাকার নরসিংদি জেলার বালিয়া গ্রামে। মাত্র ৪ বছর বয়সে সোমেন চন্দ তাঁর মাকে হারান। এরপর তিনি সরযূদেবীকে মা বলে জানতেন এবং তাঁর স্নেহেই তিনি বড় হয়েছেন। পিতার চাকুরির কারণে ঢাকায়ই সোমেনের বেড়ে ওঠা। এখানেই তাঁর শৈশব-কৈশর ও মানস চেতনা গড়ে উঠে। সোমেন চন্দের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর অশ্বিনী কুমার দত্ত মহাশয়ের কাছে পড়েন। প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে ১৯৩০ সালে তাঁকে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করে দেয়া হয় পুরান ঢাকা পোগোজ হাই স্কুলে। এই স্কুল থেকে ১৯৩৬ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ডাক্তারী পরার জন্য ভর্তি হন ঢাকা মিডর্ফোট মেডিকেল স্কুলে। কিন্তু খারাপ স্বাস্থ্যের কারণে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেন নি।

১৯৩৫ সালের নভেম্বরে লন্ডনে ভারতীয় ও বৃটিশ লেখকদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন ই এম ফরস্টার, হ্যারল্ড লাস্কি, হার্বাট রিড, রজনী পাম দত্ত, সাজ্জাদ জহীর, মূলক রাজ আনন্দ, ভবানী ভট্টাচার্য প্রমুখ। নানা আলোচনার পর তারা একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন ডিসেম্বরে। এরই সূত্র ধরে ভারতে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ গঠিত হয়। চার বছর পর ঢাকায় স্থাপিত হয় এর শাখা। ১৯৩৫ সালে লন্ডনে বৈঠকে সাহিত্যিকরা এ সংগঠনের নাম ‘প্রগতি সাহিত্য সংঘ’ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যখন ইশতেহার প্রকাশিত হয় তখন প্রস্তাবিত নাম রাখা হয় ‘প্রগতি লেখক সংঘ’। ১৯৩৬ সালের ১০ এপ্রিলের এ সভায় সভাপতিত্ব করেন বিখ্যাত হিন্দি লেখক মুন্সী প্রেমচান্দ। সভায় সংগঠনের নামকরণ করা হয় ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’। এর সভাপতি নির্বাচিত হন প্রেমচান্দ, সম্পাদক সাজ্জাদ জহীর। ১৯৩৭ সালে তিনি প্রত্যক্ষভাবে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কম্যুনিস্ট পাঠচক্রের সম্মুখ প্রতিষ্ঠান প্রগতি পাঠাগারের পরিচালকের দায়িত্ব নেন। প্রগতি পাঠাগার-এর পরিচালক হন ১৯৩৮ সালে। এসময় তিনি  বিপ্লবী শতীশ পাকড়াশীর মতো বিপ্লবী শিক্ষকের রাজনীতি ও দর্শনের পাঠ নেন। রনেশ দাশ গুপ্তের সানিধ্যে থেকে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, বিভূতিভূষণ, ম্যাক্সিম গোর্কী, মোপাঁসা, রঁলা, বারবুস, জিদ, মারলো, কডওয়েল র‌্যালফ ফক্সসহ আরো অনেকের লেখা পড়ে ফেলেন।

১৯৪১ সালের ২২ জুন। হিটলার সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করে। বিশ্বযুদ্ধ নতুন দিকে মোড় নেয়। এ সময় ভারত উপমহাদেশের প্রগতিবাদী জনতা ফ্যাসিস্ট হিটলারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং স্তালিনের নেতৃত্বে সংগ্রামরত দেশপ্রেমিক সোভিয়েত যোদ্ধাদের প্রতি সমার্থন জানিয়ে জনযুদ্ধ ঘোষণা করে। এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শান্তির লক্ষে_হীরেন মুখোপাধ্যায় ও স্নেহাংশু আচার্যকে আহ্বায়ক করে কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে বঙ্গদেশে গড়ে উঠে ‘সোভিয়েত সুহ্রদ সমিতি’। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় প্রগতি লেখক সঙ্ঘের উদ্যোগে গড়ে উঠে ‘সোভিয়েত সুহ্রদ সমিতি’। এর যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত ও দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এই সমিতির প্রধান প্রধান কাজগুলোর মধ্যে একটা অন্যতম কাজ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার অগ্রগতি প্রসঙ্গে চিত্র প্রদর্শনী করা। এই প্রদর্শনীতে প্রগতি লেখক সঙ্ঘের সোমেন চন্দের ভূমিকা ছিল অনন্য। তাঁর অবিরত শ্রমের কারণে ঢাকায় অল্পদিনের মধ্যে প্রগতি লেখক সঙ্ঘ ও সোভিয়েত সুহ্রদ সমিতি ফ্যাসিবাদ বিরোধী জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হন।

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সোমেন চন্দ পরিবর্তনে বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন বিপ্লবে। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অনুষঙ্গ হিসেবেই রাজনীতি চলে আসে তার লেখায়। নিত্যদিনের ঘরকন্নার মধ্য দিয়ে তিনি অবলীলায় দেখিয়ে দেন শাসনযন্ত্রের কুটিল চালপ্রয়োগ, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা ক্ষমতার সুক্ষ্ম জাল। তাঁর সৃষ্টি চেতনার কারফিউ ভেঙ্গে জাগিয়ে দেয় মাহনতি মানুষের মুক্তির কথা বলতে। যোগায় আত্মপরিচয় খোঁজার অনুপ্রেরণা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যবনিকা পতনের কিছু পরেই বিশ্বমঞ্চে তার আবির্ভাব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনাঙ্খাকিত মৃত্যু তাঁকে প্রচণ্ড পরিমানে ক্ষুব্দ করে। সোমেন তাই আঞ্চলিক সমস্যা যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণের একটি উপাত্ত তা বলতে ‘একটি রাত গল্পের’ সনাতনী মা ছেলের রাজনৈতিক মতাদর্শ বুঝে নিতে বই খুলে বসেন। দাঙ্গা গল্পে দুই ভাইয়ের আদর্শগত বিরোধের মধ্য দিয়ে রূপক আকারে বেরিয়ে আসে উপনিবেশবাদের শেষ ছোবল জাতিগত বিভেদের ভয়াবহ চেহারাটি। দাঙ্গা গল্পের ‘অজয়’ একটি বাস্তব চরিত্র। অকল্পিত গল্পে তিনি দেখান “যারা রাষ্ট্রদেবতার মন্দিরের কাছাকাছি থাকেন,যারা বিশ্ব মানচিত্রে নিজের ক্ষুদ্র অবস্থান সম্পর্কে বেশ সচেতনই বলা চলে, যারা দেখতে পায় কিংবা দেখেও না দেখার ভান করে “আমাদের চারিদকে চাপা কান্নার শব্দ, আমাদের চারিদিকে জীবনের হীনতম উদাহারণ,খাদ্যের অভাবে,শিক্ষার অভাবে কুতসিত ব্যারামের ছড়াছড়ি,মানুষ হয়ে পশুর জীবন-যাপন। আমাদের চারিদিকে অবরুদ্ধ নিশ্বাস,কোটি কোটি ভয়ার্ত চোখ,তারা যেন খুনের অপরাধে অপরাধী একপাল মানুষ”।

জীবনের এই স্বল্প পরিসরে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন শেষের কয়েকটি বছর। ২৪টি গল্প, ২টি নাটিকা এবং তিনটি কবিতা নিয়ে তার সাহিত্য-ঝুলি। প্রতিটি রচনাতেই রয়েছে সৃষ্টিশীলতার ছাপ। তার ‘ইঁদুর’ গল্প বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ’৪০-এ প্রকাশিত সংঘের সংকলন ‘ক্রান্তি’তে তার বিখ্যাত গল্প ‘বনস্পতি’ প্রকাশিত হওয়া ছিল বিরল ঘটনা। মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি ভাল একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন, নাম-বন্যা। কিন্তু জীবিতাবস্থায় তার কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। তিনি সাহিত্যেও বিপ্লবের স্রোতধারা আশা করতেন। বিশ্বাস করতেন,সাহিত্য দ্বারা ঘুণেধরা সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন করার অনুপ্রেরণা মানুষের মধ্যে সঞ্চার করা সম্ভব। আর সেই লক্ষ্যকে সামন রেখে মানুষের মুক্তির কথা চেতনায় ধারণ রচনা করেছিলেন সমাজ পরিবর্তনের কথাশিল্প। তারুণ্যের গান,সৃষ্টির উন্মাদনা ও বিদ্রোহের অগ্নি জেলে সাহিত্যে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন সোমেন চন্দ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সোমেন চন্দ সম্পর্কে লিখেছিলেন, “নিজস্ব একটি জীবনদর্শন না থাকলে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। সোমেন চন্দ ছিল কমিউনিস্ট। সাহিত্যিক হিসেবেও তার রচনায় নানাভাবে ফুটে উঠেছে কমিউনিজমের জয়ধ্বনি”।

সোমেন চন্দ অন্যায়, অত্যাচার, অসঙ্গতি ও অসহায়ত্বের কাছে কখনো মাথা নত করেননি। সকল অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ছিলেন আপোষহীন। রাজপথে শোষিত মানুষের অধিকার আদায় ও শ্রেণী বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার সংগ্রাম আর লেখালেখির মাধ্যমে সমাজের অসঙ্গতি তুলে আনার অবিচল প্রত্যয়ে তিনি ছিলেন ইস্পাতদৃঢ়। সোমেন চন্দের সাহিত্য ছিল কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষকে ঘিরে। শোষণ-বৈষম্য থেকে মানুষকে মুক্ত করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য ও স্বপ্ন। এস্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে নিয়েজিত করেন সেই শৈশব থেকে। ইস্পাতদৃঢ় সংকল্প নিয়ে শোষণমুক্তির লড়াই-সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি সাহিত্যে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন। সোমেন চন্দ এমন একটি মানুষ, যার সৃষ্টি হতাশাগ্রস্ত প্রতিটি মানুষকে জাগ্রত করে নতুন উদ্যমে পথ চলতে সহয়তা করে।

১৯৪২ সালের ৮ই মার্চ তিনি আততায়ীর হামলায় নিহত হন। সেদিন ঢাকায় এক সর্বভারতীয় ফ্যাসিবাদবিরোধী সম্মেলন আহ্বান করা হয়। তথাকথিত জাতীয়তাবাদী কিছু দল এ সম্মেলন বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে। রেল শ্রমিকদের সাধারণ সম্পাদক সোমেন চন্দ রেল শ্রমিকদের মিছিল নিয়ে যখন সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন তখন ঢাকার সুত্রাপুরে সেবাশ্রম ও লক্ষ্মীবাজারের হৃষিকেশ দাস লেনের কাছে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক পার্টির গুণ্ডারা তাঁর উপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ লিখেছেন: “সোমেন হত্যার ব্যাপারটি, বিশেষ করে তখনকার পটভূমিতে এবং প্রেক্ষিতে এই হত্যাকাণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবাহী। সোমেন ছিলেন সে সময়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন, সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি, আর প্রগতি লেখক সঙ্ঘের অনেকখানি”। ১৯৪২ সালে সোমেন চন্দের মৃত্যুর পর কলকাতায় অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে প্রগতি ‘লেখক সঙ্ঘ’-র নামকরণ হয় ‘ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’। ১৯৪৫ সালে কলকাতায় আবার এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’। ১৯৪০ সালে তার “বনস্পতি” গল্পটি “ক্রান্তি” পত্রিকায় ছাপা হয়। তার মৃত্যুর পর তার বিভিন্ন গল্প সংকলন ছাপা হয়। ১৯৭৩ সালে রণেশ দাশগুপ্ত তার গল্পসমূহের একটি সঙ্কলন সম্পাদনা করেন।

[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।]

jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক

Related articles