ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ২

ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ২

জবরুল আলম সুমন:

হযরত শাহজালাল (রঃ) এর আগমনের পূর্বে ও পরে সিলেট অঞ্চল বিভিন্ন ছোট বড় রাজ্যে বিভক্ত ছিলো। এসব রাজ্যের আয়তন ও ইতিহাস সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য থাকলেও সকল গবেষকদের মতামত গ্রহণ করে এসব রাজ্য সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক ধারনা লাভ করা যায়। মূলতঃ গৌড়, জৈন্তা, লাউড়, ইটা ও তরফ বা তরপ রাজ্য নিয়েই সিলেট অঞ্চল গঠিত ছিলো। এসব রাজ্যের সীমা ও আয়তন বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলো।

গৌড় রাজ্যঃ সিলেটের সর্বাধিক আলোচিত রাজ্য ছিলো গৌড় রাজ্য। গৌড় রাজ্যতে অনেক রাজা বিভিন্ন সময়ে রাজ্য শাসন করলেও সর্বশেষ ও আলোচিত এবং সমালোচিত রাজা ছিলেন গোবিন্দ। রাজ্যের নামানুসারে পরবর্তিতে তার নাম হয়ে যায় গৌড় গোবিন্দ। গৌড়ের অত্যাচারিত রাজা হিসেবে তিনি কুখ্যাতি অর্জন করেন। ১৩০৩ খৃষ্টাব্দে গৌড় গোবিন্দকে পরাজিত করে হযরত শাহজালাল (রঃ) ৩৬০ আউলিয়া নিয়ে  সিলেটের মাটিতে প্রবেশ করেন। এই কারণেই গৌড় রাজ্যটি সিলেটের সবচে আলোচিত রাজ্য হিসেবেই পরিচিত পেয়েছে। বর্তমান সিলেটের জৈন্তা, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট থানা ছাড়া সমগ্রই এবং বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার কিছু অংশ নিয়েই গৌড় রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। গৌড় রাজার ছিলো বিশাল সৈন্যবাহিনী ও নৌবাহিনী। গৌড় গোবিন্দ বিভিন্ন সাথে গড় বা দুর্গ নির্মান করেছিলেন এসব গড়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রায়গড়, পেচাগড়, টিলাগড়, গড়দোয়ার ইত্যাদি।  নামগুলো এখনো প্রচলিত আছে যা বর্তমানে মূল শহরে উল্লেখিত নামে এসব স্থানের নামকরণ করা হয়েছে। সিলেট শহরের মনারায়ের টিলায় ছিলো রাজা গৌড় গোবিন্দের সাত তলা রাজ প্রসাদ। পরে পেচা গড় প্রসাদে গোবিন্দ তার বাসভবন স্থানান্তরিত করে তার মন্ত্রী ও সেনাপতি মনারায়কে পুরাতন প্রসাদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে এই টিলার নাম হয়ে যায় মনারায়ের টিলা। যা এখনো কালের স্বাক্ষী হয়ে টিকে আছে।

জৈন্তা রাজ্যঃ জৈন্তা রাজ্য প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র, কামাখ্যাতন্ত্র ইত্যাদিতে বিশেষভাবে উল্লেখিত আছে। সিলেট জেলার জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট এবং কোম্পানীগঞ্জের বিশাল এলাকা নিয়েই ছিলো বিশাল জৈন্তা রাজ্যের অবস্থান। খাসিয়া রাজ বংশের সময় জৈন্তা পাহাড়, সিলেটের উত্তরাংশের সমতল ভূমি এবং আসাম প্রদেশের নওগাঁ জেলার অংশ বিশেষ ছিলো জৈন্তা রাজ্যের অধীনে। মহাভারতে উল্লেখিত “খাস” স্থানটিকেই খাসিয়াদের আবাসভূমি জৈন্তাকেই মনে করা হয়। খাসিয়া রাজবংশের শাসন শুরুর দিকের ইতিহাস অস্পষ্ট। পুরোহিত বংশের শেষ রাজা ছিলেন জয়ন্ত রায়। তিনি ১৫০০ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৫১৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত জৈন্তার রাজা ছিলেন। খাসিয়ারা ‘খাস’ ও সিন্টেং নামেও সমধিক পরিচিত ছিলো। মূলত এরা তিব্বত থেকে জৈন্তায় আসেন বলে ধারণা করা হয়। এই রাজবংশ ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত জৈন্তায় রাজত্ব করেন এবং ধর্ম হিসেবে হিন্দু ধর্মকেই বেছে নেন। খাসিয়ারা কালি পুজোর সময় নর বলি দিতো। ১৬৮০ খৃষ্টাব্দে রাজা লক্ষ্ণী নারায়ণের সময় বর্তমান জৈন্তা থানার সদর নিজপাট গ্রামে জৈন্তার রাজধানী স্থাপন করেন। একে একে ২৩ জন খাসিয়া জৈন্তা রাজ্যের রাজত্ব লাভ করেন এবং জৈন্তা রাজ্য শাসন করেন। ১৮৩২ খৃষ্টাব্দে রাজা রাজেন্দ্র সিংহের সময় নওগাঁ জেলার অন্তর্গত জৈন্তার সামন্ত রাজ্য গোভার শাসক ছত্র সিংহ চারজন বৃটিশ প্রজাকে ধরে নিয়ে যান। এই চারজনের মধ্যে তিনজনকেই কালী মন্দিরে বলি দেয়া হয়। এই বাহানায় পূর্বেকৃত চুক্তি ভঙ্গ করে ইংরেজরা ছলে বলে ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে জৈন্তা দখল করে নেয়। ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দের ১৬ই মার্চ হ্যারি লিষ্টার অতর্কিত ভাবে সৈন্য নিয়ে জৈন্তা আক্রমণ করলে রাজেন্দ্র সিংহ যুদ্ধ পরিহার করেন। পরে রাজেন্দ্রকে বন্দি করে সিলেট শহরের দেওয়ান মুরারী চাঁদের বাড়িতে আটকে রাখা হয়। ১৮৬১ সালে রাজেন্দ্র বন্দি অবস্থায় মারা যান। রাজা রাজেন্দ্রের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বহু শতাব্দীর প্রাচীন জৈন্তা রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে।

লাউড় রাজ্যঃ বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় সর্বত্রই এবং হবিগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার কিছু অংশ নিয়েই ছিলো গঠিত ছিলো লাউড় রাজ্য। কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে ব্রহ্মপুত্রের তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো লাউড় রাজ্য। কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে রাঢ় থেকে সম্রান্ত মুসলমানরা এসে এখানে বসতি স্থাপন করেন বলেই রাঢ় থেকেই লাউড় নামে রূপান্তরিত হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে লাউড়ের রাজা ছিলেন দিব্য সিংহ। লাউড়ের মন্ত্রী ছিলেন প্রখ্যাত বৈষ্ণব সাধক অদ্বৈতাচার্যের পিতা কুবেরাচার্য। রাজা বিদ্য সিংহ সন্ন্যাস গ্রহণ করে লাউড়ের মন্ত্রীপুত্র অদ্বৈতাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং নাম পরিবর্তন করে রাখেন লাউড়িয়া কৃষ্ণদাস। এই কৃষ্ণদাস সংস্কৃত ভাষায় আলোচিত বাল্যলীলা সূত্র গ্রন্থ রচনা করেন।
দিব্য সিংহ সন্ন্যাস গ্রহণ করলে লাউড়ের সিংহাসনের অধিকারী হন দিব্য সিংহের পুত্র। পরবর্তিতে তাকে হটিয়ে সিংহাসনের ক্ষমতা লাভ করেন রামনাথ। রামনাথের এক পুত্র কেশব জগন্নাথপুরে এবং অপর পুত্র বানিয়াচংয়ে নতুন ভাবে রাজ্য স্থাপন করেন। ষোড়শ শতাব্দীতে লাউড়ের রাজা হোন গোবিন্দ খাঁ। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে রাজা গোবিন্দ খাঁ’র সাথে তার জাতিরদের বিরোধ বাঁধে। গোবিন্দের অংশীদারগণ দিল্লীতে নালিশ করলে দিল্লীর সম্রাটের সৈন্যরা গোবিন্দ খাঁকে ধরে নিয়ে যায়। গোবিন্দ খাঁকে দিল্লীতে নিয়ে গেলে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে হবিব খাঁ নামে পরিচিত হন। এই সময়ে খাসিয়ারা লাউড় রাজ্য আক্রমণ করলে লাউড়ের রাজধানী নবগ্রাম ধ্বংস করে দেয়। হবিব খাঁর নাতি ছিলেন আনোয়ার খাঁ। ১৭১৪ খৃষ্টাব্দে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর সময়ে আনোয়ার খাঁ দেওয়ান উপাধি ভূষিত হয়েছিলেন।

ইটা রাজ্যঃ কুশিয়ারা নদীর তীরে এক সময় ত্রিপুরা মহারাজার অধীনস্ত সামন্ত রাজারা রাজত্ব করেছেন। এদের মধ্যে ভানু নারায়ণ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তার পূর্ববর্তীদের সমন্ধে বেশি কিছু জানা যায়নি। একটি দান পত্র থেকে জানা যায় যে, ত্রিপুরার রাজা ধর্মধর ১১৯৫ খৃষ্টাব্দে ভানু নারায়ণের পূর্বপুরুষ দ্বিজনিধিপতিকে বরমচাল, ইটা, ইন্দানভার, ইন্দেশ্বর, শমসেরনগর, প্রভৃতি এলাকা নিয়ে ঘটিত একটি জনপদ দান করেন। নিধিপতি এই ভূখন্ডে ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করেন। ১৫৪২ থেকে ১৫৮০ খৃষ্টাব্দ এই ইটা রাজ্যের রাজা ছিলেন ভানু নারায়ণ। এই সময়ে ভানুগাছের সামন্ত চন্দ্রসেন বিদ্রোহী হলে ভানু নারায়ণ তাকে বন্দি করে ত্রিপুরার রাজা বিজয় মানিক্যের দরবারে পাঠান। তখন ত্রিপুরার রাজা সন্তুষ্ট হয়ে রাজা উপাধি ও ভানুগাছ দান করেন। সুবিধ নারায়ণ এই বংশের শেষ রাজা ছিলেন। তিনি ১৫৮০ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৫৯৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ইটা রাজ্য পরিচালনা করেন। ১৫৯৮ খৃষ্টাব্দে আফগান বীর খাজা উসমান যুদ্ধের মাধ্যমে ইটা দখল করে নেন এবং এই যুদ্ধে রাজা সুবিধ নারায়ণ নিহত হন। ভানু নারায়ণ ও সুবিধ নারায়ণ যেসব গড় বা দুর্গ নির্মান করেছিলেন খাজা উসমান সেগুলো সংস্কার করে রাজ্যের নাম রাখেন উসমানগড়। সুবিধ নারায়ণের চার পুত্র ইসলাম গ্রহণ করেন উসমানগড়ে বসবাস করেন। খাজা উসমান উসমানগড় ও পতনউষারে দুর্গ নির্মান করেন। ১৪ বছর রাজত্বের পর ১৬১২ খৃষ্টাব্দে তিনি মোগলদের হাতে পরাজিত হন।

তরপ রাজ্যঃ বর্তমান হবিগঞ্জ জেলাব্যাপি এ রাজ্য ছিলো ত্রিপুরার অধীনে একটি সামন্ত রাজ্য। হযরত শাহজালাল (রঃ) এর সময় তরপের রাজা ছিলেন আচানক নারায়ণ। তরপ রাজ্যের উত্তরে ছিলো বরাক নদী পূর্বে ভানুগাছের পাহাড় দক্ষিণে বে জোড়া পরগণা ও পশ্চিম-উত্তরে ছিলো লাখাই। কথিত আছে কাজী নুর উদ্দীন নামক এক ব্যক্তি তার পুত্রের বিয়েতে গরু জবাই করলে রাজা তাকে প্রাণদন্ড দেন। নূর উদ্দীনের ভাই কাজী হেলিম উদ্দিন বাংলার সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের নিকট বিচারপ্রার্থী হয়েছিলেন। সিলেট বিজয়ের পর সিপাহ সালার নাসিরুদ্দীনের নেতৃত্বে হযরত শাহজালাল (রঃ) বার জন আউলিয়ার এক বাহিনী তরপে পাঠান। কারো কারো মতে এই বার আউলিয়া এক হাজার অশ্বারোহী ও তিনহাজার পদাতিক সৈন্য নিয়ে তরপ অবরোধ করেন। অবরোধের ফলে তরপের রাজা আচানক নারায়ণ পালিয়ে গেলে ১৩০৪ খৃষ্টাব্দে সিপাহ সালা নাসিরুদ্দীন তরপের শাসনকর্তা হন। সৈয়দ নাসিরুদ্দীনের বিজয়ের পর তরপ অঞ্চল ইসলামী শিক্ষা দীক্ষা ও সাহিত্য সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে উঠে। এ বংশের সৈয়দ মূসা ও মিনা আরাকানে যাতায়াত করতেন। সৈয়দ মূসার অনুরোধে মধ্য যুগের প্রসিদ্ধ কবি আলাওল ১৬৫৯ খৃষ্টাব্দে মূলক বদিউজ্জামাল নামক পুথি রচনা করেন। মধ্য যুগের মহাকবি সৈয়দ সুলতান ছিলেন সৈয়দ মূসার ছোট ভাই এবং গদা হাসান ছিলেন এই বংশের বিখ্যাত দরবেশ।

চলবে…
————————————————————————————————————————

অতিথি লেখক