ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ০৩

ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ০৩

জবরুল আলম সুমন: গত পর্বে সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্য নিয়ে ছোট্ট পরিসরে লিখেছিলাম। তারমধ্যে গৌড়রাজ্য ছিলো উল্লেখযোগ্য যদিও গৌড় রাজ্য নিয়ে বিভিন্ন গবেষক ভিন্ন ভিন্ন মত উপস্থাপন করেছেন এবং হযরত শাহজালাল (রঃ) এর আগমনের পূর্বে গৌড় রাজ্য ও গৌড়ের রাজা গোবিন্দ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্যাদির অনেক অভাব রয়েছে। তবে গৌড়েরাজ্যের কুলদেবতা হট্টনাথের নামানুসারে গনেশরাম শিরোমনির হট্টনাথের পাঁচালীতে নির্ভরযোগ্য অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। হট্টনাথের পাঁচালির সাথে ত্রিপুরা রাজমালা ও ভাটেরার তাম্রফলকের বর্ণনার সাথে যথেষ্ট সাদৃশ্য পাওয়া যায়। হট্টনাথের পাঁচালি থেকে জানা যায় যে কামরূপের রাজা কামসিন্ধুর মৃত্যুর পর কামরূপ আক্রান্ত হয়। কামরূপের রাণী উর্মি পালিয়ে এসে জৈন্তার নারী রাজ্যের অংশবিশেষে রাজ্য স্থাপন করেন। হাটকের (তিব্বত) কৃষক নামীয় যুবরাজ রাণী উর্মির নতুন রাজ্যে ভ্রমণে এলে রাণী উর্মীর রূপসী কন্যা উর্বরাকে বিয়ে করেন। কিছুদিন পর যুবরাজ আবার তার নিজ দেশে ফিরে যান। কিন্তু উর্বরার গর্ভে রেখে যান তার ঔরশজাত সন্তান। উর্বরার গর্ভজাত সন্তানের নামও হাটকের নামানুসারে রাখা হয় হাটক। যথাসময়ে হাটক সিংহাসন আসীন হন। হাটকের মৃত্যুর পর হাটকের পুত্র গুহকও সেই সিংহাসনের উত্তরাধীকার লাভ করেন। গুহকের ছিলো তিন পুত্র ও দুই কন্যা যথাক্রমে লড্ডুক, গুড়ক ও জয়ন্ত এবং মেয়েরা হলো শিলা ও চটলা। রাজা গুহকের প্রয়াণের পর তার তিন পুত্রের মধ্যে রাজ্য বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই তিন রাজ্যের নাম হয় যথাক্রমে লড্ডুকের লাউড়, গুড়কের গৌড় এবং জয়ন্তকের জৈন্তা বা জয়ন্তিয়া। মূলতঃ এই তিনটি রাজ্য নিয়েই সিলেট গঠিত হলেও পরবর্তীতে এই তিনটি থেকেও ইটা, তরপসহ আরো কিছু রাজ্যের সৃষ্টি হয়।

** উপরের অংশটা গত পর্বের জন্য নির্বাচিত ছিলো কিন্তু টাইপ করতে গিয়ে এই অংশের হ্যান্ডনোটটি খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাই গত পর্বের সাথে প্রকাশ করতে পারিনি বলে দুঃখিত।

সিলেটের প্রাচীন অধিবাসী ছিলো অষ্ট্রিক জাতীয় লোক। অষ্ট্রিকরা তৎকালীন সময়ে অন্যতম অগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে খ্যাত ছিলো। অষ্ট্রিকরা হাড় এবং পাথর দিয়ে অস্ত্র তৈরী করতে পারেতেন। ফল ফসল উৎপাদনেও তারা বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ধান, কলা, পান, সুপারী, নারকেল, আদা, হলুদসহ বিভিন্ন ধরনের শাক সবজির চাষ করতেন এবং বিক্রি করতেন। বিকি কিনির মাধ্যম হিসেবে কড়ির ব্যবহার ছিলো। ১৭৭৮ সালে সিলেটের বেসিডেন্ট ও কালেক্টর রবার্ট লিন্ডসে সিলেটে এসে কড়ির প্রচলন দেখেছেন বলে বর্ণনা করেছেন। অষ্ট্রিকদের পর সিলেটে আসে মঙ্গোলীয় লোকজন। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে আসেন আর্যরা এবং ত্রায়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই হযরত শাহজালালের (রঃ) এর আগমনের মাধ্যমেই সিলেটে ছড়িয়ে পড়েন মুসলমানেরা। পঞ্চদশ শতকে আসেন উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা এবং ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে বিদ্রোহী পাঠানরা মোগলদের দ্বারা বিতাড়িত হলে তারা উড়িষ্যা ও পশ্চিম বঙ্গ থেকে সিলেটে আশ্রয় নেন এবং সিলেটের জনজীবনের সাথে মিশে যান খুব দ্রুতই। সিলেটের জাতি গোষ্ঠীতে সর্বশেষ সংযোজন হিসেবে বৃটিশ আমলের শুরুর দিকে আসেন মনিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজন। উত্তর-পূর্ব ভারতের মনিপুর রাজ্যই হলো মনিপুরীদের আদি আবাসস্থল। ঐতিহ্যবাহী মনিপুরী সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব সমাজ, সংস্কৃতি বজায় রেখেও সিলেটের মূলধারার অধিবাসীদের সাথে মিশে গেছেন সহজেই।

প্রাচীন কালে রাজা-বাদশারা তামার পাত বা প্লেটে রাজকীয় ঘোষণা, অনুশাসন ইত্যাদি খুদাই করে রাখতেন। এই ধরনের তামার পাত বা ফলক ইতিহাসের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবে বিবেচ্য। সিলেট অঞ্চলে বেশ কিছু তাম্র ফলক পাওয়া গেছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিয়ানীবাজার থানার নিদনপুর গ্রামে ছয়টি তাম্রফলক পাওয়া গেছে। এই তাম্রফলকগুলো ছিলো সপ্তম শতাব্দীর। ১৮৭২ সালেও মৌলভীবাজারের ভাটেরাতে আরো দুটি তাম্রফলক পাওয়া গেছে, গবেষকেরা মনে করেন মৌলভীবাজারে পাওয়া তাম্রফলক দুটি ছিলো একাদশ বা দ্বাদশ শতাব্দীতে খুদাই করা। এসব তাম্রফলক থেকে জানা যায় যে সপ্তম শতাব্দীতে সিলেট অঞ্চল ছিলো কামরূপের রাজা ভাস্কর বর্মার শাসনাধীন। ১৯৬১ সালে মৌলভীবাজারের রাজনগরে প্রাপ্ত দশম শতাব্দীর মহারাজা শ্রীচন্দ্রের আমলে খুদাই করা অপর একটি তাম্রলিপি থেকে শ্রীহট্টমন্ডলের সীমানা সম্পর্কে জানা যায়। শ্রীমঙ্গলের কালাপুর গ্রাম থেকে ১৯৬৩ সালে পাওয়া সপ্তম শতাব্দীর অপর আরো একটি তাম্রফলক থেকে জানা যায় যে কুশিয়ারা নদীর দক্ষিণে শ্রীহট্টমন্ডল ‘চন্দ্রপুরী বিষয়ের’ অন্তর্ভূক্ত ছিলো।

১৪৫৯ থেকে ১৪৭৪ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার স্বাধীন বাদশাহ ছিলেন রুকুনুদ্দিন বরবক শাহ। তার আমলে খুদাই করা শিলালিপিই ছিলো মুসলিম আমলের সিলেটে প্রাপ্ত শিলালিপির মধ্যে প্রাচীনতম। ফার্সী ভাষায় খুদাই করা তার সময়ে একটি শিলালিপি হাটখোলা (বর্তমান ভারতের কাছাড় জেলা) থেকে পাওয়া যায়। রুকুনুদ্দিন বরবক শাহের আমলের আরেকটি শিলালিপি সিলেটের গয়বী দীঘি থেকে উদ্ধার করা হয়। রুকুনুদ্দিন বরবক শাহের পুত্র শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের আমলের আরোও তিনটি শিলালিপি সিলেটে পাওয়া গেছে। প্রাচীনতম শিলালিপিটি এখনো শাহজালালের দরগায় সংরক্ষিত আছে। অপর দুটি শিলালিপির একটি আছে মৌলভীবাজারের গয়গড়ের খোজার মসজিদে।

আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে খুদাই করা আরোও ছয়টি শিলালিপি সিলেটে পাওয়া গেছে। এসব শিলালিপির মধ্যে সবচে প্রাচীনতম শিলালিপিটি হযরত শাহজালাল (র:) এর দরগার প্রবেশদ্বারের সংরক্ষিত আছে। সিলেটে প্রাপ্ত আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলের ৯১৮ হিজরীতে খুদাই করা অপর একটি শিলালিপি জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এই শিলালিপি থেকে জানা যায় হযরত শাহজালালের (রঃ) আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যে সুলতান ফিরোজ শাহ দেহলবীর আমলে সিকন্দর খান গাজী সর্বপ্রথম সিলেটে মুসলমানদের অধিকার স্থাপন করেন। এছাড়া আরোও বেশ কয়েকটি শিলালিপি শাহজালালের দরগাহের বিভিন্ন দেয়ালে সংরক্ষিত আছে। মোগল আমলে সিলেটের ফৌজদার ছিলেন ফরহাদ খান। তার সময়ের বেশ কিছু শিলালিপি শাহজালালের দরগাহ ছাড়াও সিলেটের বিভিন্ন স্থানে সংরক্ষিত আছে। ফার্সী ভাষায় খুদাই করা হযরত শাহজালালের দরগাহের দেয়ালে একটি শিলালিপির গায়ে লেখা ছিলো “চুন মহব্বতে বস কভি বুনিয়াদ দেওয়ারে ইয়ে সিদক বমজে শপকে দিল বগিরদের রুনজায়ে আম্বর মরিষ্ট। সখতে লুৎফুল্লাহ বখসী ও আমিল দেওয়ারে আফতাবও মাহবুওদ পায়েস্তা দরওয়াই হামচু খিস্ত শাল তারিখে। চুনেইন দেওয়ার দরগায়ে বুজুরগ হাতিফে আজ গুয়ের গুফত।” এর বাঙ্গানুবাদ হলোঃ এই দেয়ালের ভিত্তি এই দরগার প্রতি শ্রদ্ধার মতোই দৃঢ়। লুৎফুল্লাহ বখসী ও আমিল এই দেয়াল নির্মান করেন। সুর্য ও চন্দ্র এই দেয়ালে ইটের মতোই ব্যবহার করা হলো। এই পবিত্র দরগার দেয়ালের তারিখ। (শিলালিপিটার গায়ে তারিখের অংশটা মুছে গেছে।) এখানে উল্লেখ্য যে লুৎফুল্লাহ ছিলেন ১৬৬০ থেকে ১৬৬৫ সাল পর্যন্ত সিলেটের ফৌজদার।

সিলেট শহরের চৌকিদিঘী মহল্লায় শাহনুরের দরগায় আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলের আরোও একটি শিলালিপি সংরক্ষিত আছে। আরোও বেশ কিছু শিলালিপির মধ্যে সিলেটে শহরের আম্বরখানা মহল্লার মহাফেজ আব্দুল খালেকের বাড়ী সংলগ্ন মসজিদের গায়ে সংরক্ষিত একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে মসজিদটি ১৬৮৪ খৃষ্টাব্দে বাদশাহ আলমগীরের আমলে নির্মিত হয়েছিলো।

তরপ পরগনার দাউদপুর নগরে শাহ আহমদ উল্লাহর বাড়ী সংলগ্ন মসজিদের দেয়ালে একটি শিলালিপি আছে। সেই শিলালিপি পাঠ করে জানা যায় যে ত্রিপুরার সেনাপতি ও মোয়াজ্জমাবাদের মন্ত্রী খোয়াস খান ৯১৯ হিজরীতে এই মসজিদ নির্মান করেন। আরোও জানা যায় যে খোয়াস খানের অধিকার তরপ রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো।
চলবে…
____________________________________________________________

পূর্বে প্রকাশিত লিংক সমূহ:–

অতিথি লেখক