বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি

বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি

বিশেষ প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ এশিয়া মহাদেশের আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার এলাকাকে ভূমিকম্পপ্রবণ তথা হিমালয়ান ফল্ট থ্রাস্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গত পাঁচ শত বছর ধরে এই হিমালয়ান থ্রাস্ট ফল্ট এলাকায় ঘুরেফিরে ভূমিকম্প হচ্ছে। তবে, বাংলাদেশ ও ভুটানে এ পর্যন্ত বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়নি। তাই এ অঞ্চলের ঝুঁকিও অনেক বেশি।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদী আহমেদ আনসারির সঙ্গে। তিনি ২৬ অক্টোবর (সোমবার) সন্ধ্যায় বলেন, আফগানিস্তানে যে ভূমিকম্প হয়েছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নেই। তবে ভয়টা রয়েই গেছে। কারণ, গত পাঁচ শ বছরের রেকর্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হিমালয়ান ফল্ট থ্রাস্টের অন্যান্য দেশে ভূমিকম্প হয়েছে। কয়েক মাস আগে নেপালেও বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। এখন বাদ রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও ভূটান। ভূমিকম্পের গতিবিধি পর্যালোচনা করলে ধরেই নেয়া যায়, বাংলাদেশেও বড় ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে।

ড. মেহেদী জানান, গত বছর ডিসেম্বরে গ্লোবাল আর্থকোয়েক মডেল (জিইএম) নামের একটি সংস্থা এ বিষয়ে ডক্যুমেন্টসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিষয়ও রয়েছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর সূত্র জানায়, অতীতের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ১৯৬০ সালের পর থেকে ভূমিকম্পের হার বেড়েছে, অর্থাৎ ঘন-ঘন স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। তবে, এর মাত্রা তেমন বাড়েনি। সূত্র মতে, ছোট-ছোট ভূমিকম্প সংঘটন বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস।

জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপি ২০১০ ও ২০১২ সালে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করার জন্য দুটি গবেষণা চালায়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের ভূ-অভ্যন্তরে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হতে পারে এমন পাঁচটি ফল্ট লাইন বা টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল আছে। ফল্ট লাইন হলো, দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল, যেখানে সাধারণত ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়।

ফল্ট লাইনগুলোর একটি ঢাকা থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে মধুপুর দিয়ে গেছে। ওই ফল্ট লাইনে যদি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে ঢাকার ৩০ শতাংশ ভবন ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হবে।

অন্য চারটি ফল্ট লাইন হলো, কক্সবাজার-ফেনী প্লেট বাউন্ডারি-১, ফেনী-শ্রীমঙ্গল প্লেট বাউন্ডারি-২, শ্রীমঙ্গল-ভারত প্লেট বাউন্ডারি-৪ এবং ময়মনসিংহ থেকে পঞ্চগড় পর্যন্ত ডাউকি ফল্ট লাইন।

মধুপুর ফল্ট লাইনে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয় ১৮৮৫ সালে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭.১। ডাউকি ফল্ট লাইনে ১৮৯৭ সালে ৮ মাত্রার ভূকম্পন হয়। ১৯১৮ সালে ফেনী-শ্রীমঙ্গল ফল্ট লাইনে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।

ড. মেহেদী  আনসারী বলেন, এ পাঁচটি স্থানের যেকোনও স্থানে ভূমিকম্প হলে তা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দিতে পারে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভবনগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে, বিশেষ করে ঢাকা শহর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আগে থেকেই সরকারি উদ্যোগে ব্যবস্থা নিলে ক্ষয়ক্ষতি হতে কমিয়ে আনা যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের জ্যাকসনভিল স্টেট ইউনিভার্সিটির নগর পরিকল্পনাবিদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানভীর ইসলাম এক নিবন্ধে বলেছেন, ভূমিকম্প ঝুঁকি অনুযায়ী ভূ-তাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশকে তিনটি প্রধান অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। সিলেট বিভাগসহ নেত্রকোনা, শেরপুর, কুড়িগ্রাম জেলা এবং ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, গাইবান্ধা, রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার অংশবিশেষ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে রয়েছে। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ইত্যাদি জেলা মাঝারি ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় পড়েছে।

তানভীর ইসলাম জানান, ভূমিকম্পের ফলে ক্ষয়ক্ষতির তীব্রতার যে মাত্রা রয়েছে, সে সূচক অনুযায়ী ঢাকা পৃথিবীর শীর্ষ ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ শহরের অন্যতম। ঢাকার উত্তরা এলাকা সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং খিলগাঁও, বাড্ডা, গুলশান, ক্যান্টনমেন্ট এবং পুরনো ঢাকার বুড়িগঙ্গা সংলগ্ন অঞ্চল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রয়েছে।

রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী নগরপরিকল্পনাবিদ মো. এমদাদুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ন, নাজুক দালান-কোঠা এবং অত্যধিক জনসংখ্যা ভূমিকম্পে ক্ষয়-ক্ষতির সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে। তিনি বলেন, ভূমিকম্প সহায়ক ভবন নির্মাণে সরকার বিএনবিসি নামের একটি নীতিমালা প্রণয়ন করলেও সেটা কেউ মানছেন না।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ভৌগোলিক অবস্থান, ভূতাত্ত্বিক গঠনের জন্য দেশে ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সিলেট সীমান্তে সক্রিয় ডাউকি ফল্ট-এর অবস্থান ও টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্ট-এর অবস্থান এবং উত্তরপূর্বে সীমান্ত সংলগ্ন ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেট-এর সংযোগস্থল হওয়ায় বাংলাদেশ ভূমিকম্পের আশঙ্কামুক্ত নয়।

তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ইতোমধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট সিটি করপোরেশনের ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে এবং টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর ও রাজশাহীর ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

প্রসঙ্গত, সোমবার বিকালে আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বতে বড় ধরনের  ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। যা বাংলাদেশও অনুভূত হয়। বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩টা ৯ মিনিটে সংঘটিত এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭.৫। প্রায় এক মিনিট স্থায়ী এই ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে ২৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে হিন্দুকুশ অঞ্চলের ২১৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার গভীরে। ওই এলাকার কাছেই পাকিস্তান ও তাজিকিস্তানের সীমান্ত।

এ বছর ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান ও ভারতে তিন দফায় তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়। নেপালে উৎপত্তিস্থলে এর মাত্রা ছিল ৭.৯। ওই সময় বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক মো. শাহআলম জানান, ঢাকা থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সাড়ে সাতশ কিলোমিটার দূরে নেপালে। উৎপত্তিস্থল থেকে যতদূর যাবে ভূমিকম্পের মাত্রা তত কমে আসবে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ বা তার কিছু বেশি।

বিশেষ প্রতিনিধি