সুস্থ্য জীবনের জন্য শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ জরুরী

সুস্থ্য জীবনের জন্য শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ জরুরী

॥॥আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস॥॥


::শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ::

১৯৯৬ সাল থেকে আমেরিকার একটি সংগঠন সেন্টার ফর হিয়ারিং এন্ড কমিউনিকেশন (বর্তমানে লিগ ফর দ্যা হার্ড অব হেয়ারিং) এর উদ্যোগে এপ্রিলের যে কোন বুধবার বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। এবার ২৭ এপ্রিল এই দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে। এ দিবসটি পালন উপলক্ষে সেন্টার ফর হিয়ারিং এন্ড কমিউনিকেশন বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকে। তারা এ দিনে একমিনিট নিঃশব্দে থাকে। এছাড়া বিনামূল্যে কানের পরীক্ষা এবং শোনার যন্ত্রটি দিয়ে থাকে। বিভিন্ন কমিউনিটির সাথে শব্দদূষণ সম্পর্কে মতবিনিময় করে। বাংলাদেশে এ দিবসটি ২০০৩ সাল থেকে বেসকারিভাবে পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবারের মতো এবারও এ দিবসটি উদযাপন করা হবে।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব শহরগুলোর আবাসিক,অনাবাসিক এলাকা, অফিসপাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি হাসপাতালের আশপাশেও শব্দদূষণের তীব্রতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এতে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। শহরগুলোর শব্দদূষণের এ সময় দেশে আন্তর্জাতিক শব্দদূষণ সচেতনতা দিবস পালিত হচ্ছে।
দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা তৈরি ও তা থেকে বের হতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সচেতনতা দিবস পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে পরিবেশ অধিদফতর আয়োজিত অধিদফতরের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচির অংশ হিসেবে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। আজ ধানমণ্ডির সরকারি বয়েজ হাইস্কুল সংলগ্ন মিরপুর রোডের ফুটপাত ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে শব্দ সচেতনতা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। কর্মসূচিটির পরিচালক ফরিদ আহমেদ জানান, ঢাকা শহরের বহুমাত্রিক পরিবেশ দূষণের অন্যতম হচ্ছে শব্দদূষণ। দেশের বড় শহরগুলো শব্দদূষণের মারাত্মক শিকার। এর মধ্যে রাজধানীর
শব্দদূষণ সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কর্মসূচির পক্ষ থেকে জানানো হয়,শব্দদূষণ প্রধান ৩০টি রোগের কারণ। শব্দদূষণের ফলে শ্রবণশক্তি কমে যায়, কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া, মানসিক অশান্তি ও ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের একটি গবেষণায় দেখা যায়, মহানগরী ঢাকায় সর্বাবস্থায় সহনীয় মাত্রার দেড় থেকে ২ গুণ শব্দ বিরাজ করছে।

উচ্চ শব্দ শিশু, অন্তঃসত্ত্বা মা ও হূদরোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে থাকে শব্দদূষণ। আকস্মিক উচ্চ শব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হূদকম্পন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশির সঙ্কোচন করে এবং পরিপাকে বিঘ্ন ঘটায়। হঠাত্ খুব জোর শব্দ যেমন যানবাহনের তীব্র হর্ন বা পটকা ফাটার আওয়াজ মানুষের শিরা ও স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রচণ্ড চাপ দেয়। এ ধরনের শব্দের প্রভাবে সাময়িকভাবে রক্তপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়, রক্তনালি সঙ্কুচিত হয়, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী হর্ন মোটরযানের চালককে বেপরোয়া ও দ্রুত গতিতে যান চালাতে উত্সাহিত করে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়।

মূলত শব্দর মাধ্যমেই রচিত হয় জীবনের ভিত্তিভূমি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ নানা ধরনের শব্দের সাথে পরিচিত হয়। আমারা শব্দের মাধ্যমে রাগ-অনুরাগ, আদর-আবদার, উপদেশ-নির্দেশ প্রকাশ করি যা নাকি একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনের জন্য শরীরে রক্ত সঞ্চালনের মতই প্রয়োজনীয়। এছাড়া বৃষ্টির টাপুর-টুপুর আওয়াজ, বনে-জঙ্গলে পাখির কিচির-মিচির শব্দ শুনতে কার না ভাল লাগে। শব্দের এই প্রয়োজনীয়, নিরীহ,সহনীয় ও রোমান্টিক রূপ সবসময় বজায় থাকলে কোন সমস্যা হত না। কিন্তু দিনের বেশীর ভাগ সময়ই আমরা অসহনীয় শব্দের সঙ্গে বসবাস করছি। ‘‘শব্দ’’ পরিবেশের কোন খারাপ উপাদান নয়। শব্দ জীবনযানপনের জন্য অপরিহার্য একটি উপাদান। প্রাণীর যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলো শব্দ। মানুষ কথা বলতে পারে বলেই সে অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে আলাদা। এই কথা বলার জন্য প্রয়োজন হয় শব্দের। যে মানুষ শব্দ শুনতে পারে না এবং কথা বলতে পারে না সে হাজার মানুষের মাঝে থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু শব্দ দূষণ পরিবেশের এক চরম বিরক্তিরকর উপাদান।

পরিবেশ বিজ্ঞানী N. Manivasakam বলেন, ভৌত পরিবেশে সহনক্ষমতা বহির্ভূত অপেক্ষাকৃত উচ্চ-তীব্রতা সম্পন্ন শব্দের উপস্থিতিতে জীব-পরিবেশ তথা মানুষের উপর যে অসংশোধনযোগ্য ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়, সেই পরিবেশ সংক্রান্ত ঘটনাকে শব্দ দূষণ বলে। পৃথিবীতে প্রতিদিনই মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্য স্থলে পৌঁছানোর তাগিদে মানুষ যানবাহন নির্ভর হয়ে পড়েছে । রাস্তায় নামছে নতুন গাড়ি। তৈরি হচ্ছে নতুন স্থাপনা। আর এই বাড়তি মানুষের চাহিদার জোগান দিতে বেড়েছে শব্দদূষণের মাত্রা। আবাসিক, অনাবাসিক এলাকা, অফিসপাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি হাসপাতালের আশপাশেও শব্দদূষণের তীব্রতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। স্কুল,হাসপাতালের সামনে লেখা থাকে,‘হর্ণ বাজাবেন না’ তবে কে শোনে কার কথা। বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে শব্দ দূষণ হয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ডিজেল ও পেট্রোলচালিত ইঞ্জিন যেমন বাস, ট্রাক, লরি, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, টেম্পু ইত্যাদির হাইড্রোলিক হর্ন (৬০-৯০ ডেসিবল) রেলগাড়ির হুইসেল (৯০-১১০ ডেসিবল), পটকা, ডিজেল চালিত জেনারেটর (৮০ ডেসিবল), ঝগড়া বিবাদে পারস্পরিক উচ্চ স্বরে কথা বলার সময় (পুরুষের ১২০ হার্জ এবং নারীর ২৫০ হার্জ), মিছিল, মিটিং এ শ্লোগান, লাউড স্পিকার ও মাইকের মাধ্যমে (১১০ ডেসিবল), (ঢোল ১০০ ডেসিবল), নিউজ পেপার প্রেস (১০০ ডেসিবল), রেডিও, টেলিভিশন, ক্যাসেট প্লেয়ার (৪৫-৮০ ডেসিবল), জেড বিমান ও সুপারসনিক বিমান (১৪০ ডেসিবল), বিভিন্ন নির্মাণ কাজে (৬০-৮০ ডেসিবল), লঞ্চ, ফেরি, স্টিমারের ভেঁপু (৮০ ডেসিবল), হোটেল, বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন ইত্যাদিতেও অযাচিতভাবে শব্দ দূষণ হয়ে থাকে।

ঢাকা শহরে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের হাইড্রোলিক হর্নের আওয়াজ শব্দ দূষণকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বলা যায়,শব্দ দূষণ এক মহামারি আকার ধারণ করেছে। শব্দ দূষণ রোধের জন্য অনেক আইন থাকলেও এ যেন ‘‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’’ এর বাস্তবরূপ। শব্দ দূষণ রোধের জন্য আমাদের দেশে আইনের কমতি নেই। কমতি রয়েছে প্রয়োগের। ২০০২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সংস্থা (বেলা) শব্দদূষণ বন্ধে আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে। ২০০২ সালের ২৭ মার্চ উচ্চ আদালত হাইড্রোলিক হর্ন এবং বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী যে কোন ধরনের হর্ন গাড়িতে সংযোজনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং গাড়িতে বাল্ব হর্ন সংযোজনের নির্দেশ প্রদান করে। এই আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে শাস্তির বিধানও প্রচলিত আছে। এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) অধ্যাদেশ ১৯৭৬ এর ২৫, ২৭, ২৮ ধারামতে শব্দদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে অর্থদন্ড ও কারাদন্ড উভয়েরই বিধান রয়েছে। মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ১৩৯ এবং ১৪০ নং ধারায় নিষিদ্ধ হর্ন ব্যবহার ও আদেশ অমান্য করার শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড ও অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ক্ষমতাবলে সরকার শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ প্রণয়ন করে। বিধিমালার আওতায় নীরব এলাকায় ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ৫০ ডেসিবল এবং রাতে ৪০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ডেসিবল এবং রাতে ৪৫ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ডেসিবল ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবল ও রাতে ৬০ ডেসিবল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ডেসিবল ও রাতে ৭০ ডেসিবলের মধ্যে শব্দের মাত্রা থাকা বাঞ্ছনীয়। আইন থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণে দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে।

লসএঞ্জেলসের শব্দ বিজ্ঞানী ডা. ভার্ন ও নুভসেন এর ভাষায় ফিসফিস করে কথা বলার মধ্যে যে মাধুর্য ছিল তা আমরা হারাতে বসেছি। অন্তরঙ্গ আলাপ হয়ত ভবিষ্যতে হবে বিরাট হাকডাক করে। কুটনিপনা হবে উঁচু গ্রামে। শব্দহীনতা কখনোই জীবন সহায়ক নয়। শব্দহীন জীবন মৃত্যুর কাছাকাছি। কিন্তু এই শব্দই আজ শব্দ দানব হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। দূষিত করছে পরিবেশ। উৎকট শব্দে আমরা আজ পরিশ্রান্ত। একজন নিরপরাধ ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবে আর একজন গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে তাঁর শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দিবে এর জন্য তার কোন শাস্তি হবে না এটা হতে পারে না।

আমরা যারা শব্দদূষণের স্রষ্টা এবং যারা শিকার,সবাইই কিন্তু সাধারন নাগরিক। আমাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? এ দেশে নকল মহামারি রূপ ধারণ করার পর নকল তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে,পলিথিন বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে,রাজধানী থেকে থ্রি হুইলার তুলে দিয়ে পরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। সুতরাং এ দেশে শব্দ দূষণ রোধ সম্ভব হবে না এমন কথা দায়িত্বহীনতা ছাড়া আর কিছু নয়। ইস্রাফিলের শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার আশায় শুধু সরকারের দিকে না তাকিয়ে থেকে আসুন আমরা সবাই মিলে সচেতন হই। আসুন সবাই মিলে শব্দ দূষণ প্রতিরোধ করি।

[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।]

jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক