স্মরণে শওকত ওসমান

স্মরণে শওকত ওসমান

কথাশিলী শওকত ওসমানের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কথাশিলী শওকত ওসমানের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৯৮ সালের ১৪ মে রাজধানী ঢাকায় তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮১ বছর। ১৯১৭ সালের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় তার জন্ম। শওকত ওসমান বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের একজন। তার রচিত ‘ক্রীতদাসের হাসি’ সর্বকালের সৈ¡রশাসকের বিরুদ্ধে গণজাগরণের দিশারি। একই সঙ্গে তার বহুল আলোচিত ‘জননী’ উপন্যাসটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ¡সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে। তার আসল নাম শেখ আজিজুর রহমান।
শওকত ওসমান বাংলাদেশের একজন সব্যসাচী লেখক। নাটক, গল, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রস-রচনা, রাজনৈতিক লেখা, শিশু-কিশোর সাহিত্য সর্বত্র তিনি অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে তিনি ছিলেন এক উচ্চকিত কন্ঠের অধিকারী।
শওকত ওসমান দাবি করেছেন, তিনি লেখক নন, তিনি ‘ঝাড়ু-দার’। অর্থাৎ, সমাজে জমানো জঞ্জাল তিনি আমৃত্যু ঝাড়ু- দিয়ে সাফ করে যাবেন লেখার মাধ্যমে, তাই তিনি ঝাড়ু-দার। কী সাংঘাতিক কথা! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে বলতেন, কলম পেশা মজুর। শওকত ওসমানের রক্তের মধ্যে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-ঠাট্টা, ইয়ার্কি, উপহাস ঢুকে গিয়েছিল। এটাকে তিনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। সমাজের ক−াউনদের, হিপোক্রেটদের, মৌলবাদী দৈত্যদের বুকে এই অস্ত্র তিনি নিক্ষেপ করতেন।
২ জানুয়ারি, শওকত ওসমানের জন্মতিথি। ১৯১৭ সালের এই দিনে তিনি পশ্চিমবঙ্গের সবল সিংহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম শেখ আজিজুর রহমান। শওকত ওসমান তার ছদ্মনাম। তাঁর পিতার নাম ইয়াহিয়া, মায়ের নাম গুলজান বেগম। পিতা ছিলেন চাষী। শওকত ওসমানের কৈশোর কেটেছে ঘোর দারিদ্রতার মধ্যে।
সবল সিংহপুর গ্রামের মক্তবে, পাঁচ বছর বয়সে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়। বছর দেড়েক পড়েছিলেন নন্দনপুর রূপচাঁদগুপ্ত একাডেমিতে। এরপর গ্রামের জুনিয়র মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। ১৯৩৩ সালের কলকাতা মাসাসা-এ-আলিয়ার ইংরেজি শাখা থেকে প্রথম বিভাগ পেয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মাদ্রাসায় পড়ার সময়ই শওকত ওসমান টিউশনি করে সংসারে টাকা পাঠাতেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি অর্থনৈতিকভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। তার রচিত ‘স¡গ্রাম স¡জন’ বইতে বাল্যকালের দারিদ্রতার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
১৯৩৪ সালে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। তখনও টিউশনি করেন। ১৯৩৬-এ এই কলেজ থেকে প্রথম বিভাগেই আইএ পাস করেন। কলকাতা বিশ¡বিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে অনার্স ত্যাগ করে পাস কোর্সে পড়তে থাকেন। ১৯৩৯ সালে বিএ পাস করেন। ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ¡বিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী পেয়ে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্র জীবনেই ১৯৩৮ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম সালেহা খাতুন। শওকত ওসমান পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের বাবা ছিলেন। অকালে রবীন্দ্র-নজরুলের মতো তার একটি ছেলে মারা গিয়েছিল। নাম ছিল তুরহান ওসমান।
ড. আজাদ ঢাকা কলেজে শওকত ওসমানের ছাত্র ছিলেন। তিনি শওকত ওসমানের একটি অতুলনীয় সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সেটি গ্রন্থিত হয়েছে ‘সাক্ষাৎকার’ নামক বইতে। বইটি প্রকাশ করেছে আগামী, ১৯৯৪ সালে।
সেখানে ড. আজাদ শওকত ওসমানের যে চুম্বক মূল্যায়ন করেছেন, তাতেই এই দ্রোহী কথাশিলীর মৌলিক আদল প্রতিচিত্রিত হয়েছে। ড. আজাদ বলেছেন, ‘ক্রীতদাসের হাসির জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার পেলেন। গর্বে গৌরবে উল−াসে আমাদের বুক ভরে গেল। তাতারীর সেই মহান ঔদ্ধত্য ‘শোন, হারুনর রশীদ। দিরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দী কেনা সম্ভব। কিন্তু-কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি না-না-না’ তখন আমাদের রক্তে জ্বেলে দিয়েছে দ্রোহ।’
গুণীই গুণীর মর্যাদা বোঝে। ড. আজাদই মনে হয় শওকত ওসমানকে যথার্থ চিনেছিলেন। তাই তিনি স্মৃতি চারণায় বলেছেন যে, ‘তিনিই একমাত্র জ্ঞান বিলোতেন। চেষ্টা করতেন জ্ঞানের বিভিন্ন দরজা খুলে দিতে। আমরা ভিড় করতাম তার ক−াসে। যদিও জানতাম তার কথা পরীক্ষার কোনো কাজেই লাগবে না। তবুও ভিড় করতাম। অথচ ওই আমরাই তো অন্য এক স্যারকে, যিনি ইসলামী পদ্য লিখে খ্যাতি আয় করেছিলেন পঞ্চাশের দশকে, মেঝে অবিরাম জুতো ঘষে কাঁদিয়েছিলাম। তিনি আর আমাদের ক−াসে আসেননি কখনো। শওকত ওসমান বলতেন সভ্যতার কথা। সমাজের বিকাশের কথা। শিল কলার কথা। … তিনি আমাদের গুরুত্ব দিতেন, কোমলমতি ভাবতেন না। জীবনের পাঠও দিতেন অনেক।’
ড. আজাদ জানিয়েছেন, ‘শওকত ওসমান’ নামটিই তাকে আকর্ষণ করেছে। এই নামের মধ্যেই আছে আধুনিকতা, আছে প্রগতির চিহœ। আমাদের সমাজে নাম দিয়েই কেবল বেহেস্ত পেতে চায় অনেকে, তাই নামে জড়িয়ে থাকে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ¡াস। শওকত ওসমান নাম দিয়েই দ্রোহ ঘোষণা করেন।
শওকত ওসমান দাড়ি রেখেছিলেন সময় বাঁচানোর জন্য, বলেছেন আজাদ। আর আবুল ফজল দাড়ি রেখেছিলেন পিতার অন্তিম অনুরোধে। আমার ধারণা, রবীন্দ্রনাথ দাড়ি রেখেছিলেন বাউল পরিচয় ফুটিয়ে তোলার জন্য।
ড. আজাদ বলেছেন, ‘তিনি আমাদের কাছে শিক্ষকের চেয়ে বড় ছিলেন। অন্য শিক্ষকদের মনে করতাম স্যার, শওকত ওসমানকে মনে করতাম আরো উচ কিছু আরো মহৎ কিছু। তিনি শওকত ওসমান।’
ড. আজাদ জানিয়েছেন, শওকত ওসমানের ক−াসে ঢোকার ঢংটি ছিল মনে রাখার  মতো। পরনে ঢোলা প্যান্ট, উজ্জ্বল, রঙিন, আধহাতা ফ−াইং শার্ট গায়ে। হাতে অপাঠ্য বই। ঢুকে, গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে বললেন, বুঝলেন স্যার, আমি আপনাদের ‘বিলাসী’ পড়াবো। আবার বললেন, ‘বুঝলেন স্যার, ওটা আমার পড়ানোর দরকার হবে না, ওটা আমার চেয়ে আপনারাই ভালো বুঝবেন।’
ড. আজাদ কবিতার ব্যঞ্জনার মতো করে বলেছেন, ‘শওকত ওসমান আমাদের দু’বছর ‘বিলাসী’ পড়িয়েছেন। তিনি দু’বছর কিছুই পড়াননি। পড়িয়েছেন অন্য স্যারেরা।’
শওকত ওসমান সম্পর্কে ড. আজাদের স্মৃতিচারণায় জড়িয়ে আছে বিপুল তাৎপর্য। চাষীর সন্তান তিনি। নির্মম দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করেছেন। এই দরিদ্র চাষী পরিবারেই জীবন্ত ছবি এসেছে তার প্রথম সার্থক উপন্যাস ‘জননী’তে। ‘জননী’ কিংবদন্তির খ্যাতি পেয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘জননী’ উপন্যাসে কলকাতা ও পাশর্¡বর্তী শহরতলির নিম্নবিত্ত মানুষের টানাপড়েনের চিত্র এঁকেছেন। শওকত ওসমান পূর্ববাংলার কৃষিভিত্তিক মহেশডাঙা গ্রামের ছবি এঁকেছেন।
শওকত ওসমানের ‘জননী’ই যেন অবিকল পূর্ববাংলা। এই উপন্যাসের নায়ক আলী আজহার খাঁ মামুলি চাষী। তার বসবাস খড়ের ঘরে।
শওকত ওসমানের গুরুত্বপূর্ণ কোনো একটি বই রাজনীতি সচেতনতার বাইরে পড়েনি। ‘বনী আদম’-এও ইংরেজ বিরোধিতার প্রসঙ্গ এসেছে। এসেছে সেক্যুলার সমাজের কথা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার।
‘জননী’ উপন্যাস ‘বনী আদম’ এর পরবর্তী ধাপ। এই উপন্যাসে শওকত ওসমান গ্রামবাংলার কাঠামোর অতলে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, যে ইহজাগতিক প্রবণতা গুপ্ত থাকে, তার জীবন্ত রূপ তুলে এনেছেন। আলী আজহার খাঁ, চন্দ্র কোটাল, দরিয়া, ইয়াকুব এরা বাংলাদেশের কৃষক সমাজের দরিদ্র মানুষ। এরা মানুষই আর কিছু নয়। তাই তারা জীবনের সংগ্রামে আমৃত্যু লড়ে যায়। হাতেম বকশ, রোহিনী চৌধুরীর মতো মতলববাজ জমিদাররা এদের মধ্যে বর্ণবাদের ফাটল ধরাতে পারে না।
ক্ষুধায়, দারিদ্রতার, অনাহারে, কষ্টে, নির্যাতনে এরা আলাদা নয়, এক। যেন নদীর পানি কাটলে দুভাগ হয় না। ‘জননী’ উপন্যাসের আঙ্গিক পরিশীলনের গুরুত্ব না দিয়ে এর আড়ালের মহত্ব উপলব্ধি করতে হবে। ‘ক্রীতদাসের হাসি’ শওকত ওসমানের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। আর কোনো উপন্যাস না লিখলেও চলতো শওকত ওসমানের। ষাট দশকে উপন্যাসটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জ্বলন্ত প্রেরণা যুগিয়েছিল। খলিফা হারুনুর রশীদকে শওকত ওসমান আইয়ুব খানের আদলে দাঁড় করিয়েছিলেন। সৈ¡রাচারের নিকৃষ্ট, ঘৃণ্য, নিষ্ঠুর, বিকৃত পাশবিক চেহারা এ উপন্যাসে জীবন্ত রূপধারণ করেছে। নিষ্ঠুর, অমানবিক প্রভুত্বও যে এক সময় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, সৈ¡রাচারের সিংহাসনও যে এক সময় টলটলায়মান হতে পারে, তা শওকত ওসমান সার্থকভাবে দেখিয়েছেন।
ক্রীতদাস সে তো মানুষের বাইরের রূপ, খলিকাও বাইরের রূপ। মানুষ মানুষই। মানুষের মধ্যে থাকে মনসুর হেল−াজের মতো অনির্বাণ বিদ্রোহী সত্তা। অত্যাচারের এক পর্যায়ে সেই ঘুমন্ত বিদ্রোহ অবাধ্য হয়ে ওঠে। শওকত ওসমানের তাতারী সেই বিদ্রোহী সত্তা।
‘হন্তারক’ উপন্যাসে শওকত ওসমান আবার চলে গেছেন মধ্য যুগে, সামন্ত শাসনের জমিনে। এঁকেছেন নির্দয়, শাসক আওরঙ্গজেবকে। আমরা জানি, ১৯৪৬ সালে প্রতিক্রিয়াশীলরা বঙ্গ বিভাজনের যে নৃত্য শুরু করেছিল এর বিরুদ্ধে যে ক’জন বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন পন্ডিত হুমায়ূন কবীর, সৈয়দ ওয়ালী উল−াহ, বিপ−বী কবি গোলাম কুদ্দুস এবং শওকত ওসমান।
অর্থাৎ শওকত ওসমান সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিক এক যোদ্ধা। তাই দেখি যে, তার ‘রাজসাক্ষী’ উপন্যাসে আদম পাচারকারী এক ব্যক্তির আদালতে দুই পক্ষের আইনজীবীর জেরা উপলক্ষে টেনে আনেন ধর্ম রাষ্ট্রের কথা, টেনে আনেন পাকিস্তান নামক দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের কাহিনী। টেনে আনেন মওলানা মওদুদীর ১৯৫৩ সালে কাদিয়ানী হত্যার প্রসঙ্গ। শওকত ওসমান ‘রাজসাক্ষী’ উপন্যাসেও কৌশল করে মৌলবাদ তথা সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরোধিতা করেছেন। সমাজ প্রগতির ছুরি দিয়ে গোড়ামিকে ফালা ফালা করেছেন। রক্ত-মাংসের বাস্তব জীবনকে চূড়ান্ত মূল্য দিয়েছেন।
শওকত ওসমানের একটি ব্যতিক্রমধর্মীগ্রন্থ ‘ভাব ভাষা ভাবনা’। অনেকেই বইটির খবর রাখেন না। জাতীয় গ্রন্থ ১৯৭৪ সালে বইটি প্রকাশ করেছে। ঔপন্যাসিক সর্দার জয়েনউদ্দীনের অনুরোধে ধারাবাহিকভাবে লেখাটি তৈরি করেছিলেন।
ভাষার ব্যবহার নিয়ে এখানে শওকত ওসমান ব্যঙ্গ নিপুণ কায়দায় অসামান্য পান্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন।
শওকত ওসমানের প্রাপ্ত উলে−খ যোগ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, স¡াধীনতা পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ আরো অনেক পুরস্কার।

আজকের এই যুদ্ধাপরাধী আলবদরদের দাঁতাল বৈরী সময়ের দুঃসহ যন্ত্রণার দিনে শওকত ওসমানের মতো অনির্বাণ প্রমিথিউসকে অবনতচিত্তে স্মরণ করছি।

[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।]
jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক