পহেলা আষাঢ়: বর্ষা ঋতু’র আগমন

পহেলা আষাঢ়: বর্ষা ঋতু’র আগমন

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: পহেলা আষাঢ়। ক্যালেন্ডারের পাতা অনুসারে আজই বাংলার সৌন্দর্যের রানীর আগমন। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ আর মারাত্মক লোডশেডিংয়ে যখন মানুষের ত্রাহি অবস্থা, ঠিক এ মুহূর্তেই ঋতু পরিক্রমার দরজায় কড়া নাড়ছে বর্ষা। নবধারাজলে স্নান করে শীতল হওয়ার আহ্বান এখন প্রকৃতিতে। আজ থেকে শুরু হয়ে গেছে বর্ষাকাল। রিমঝিম বৃষ্টি, কখনওবা মুষলধারে ভারি বর্ষণ। মাঠ, নদী-নালা, পুকুর সব টইটম্বুর হবে বর্ষার বৃষ্টিতে।

জ্যৈষ্ঠের শেষে প্রায় দু’সপ্তাহের তীব্র খরতাপে মানুষ ও প্রাণিকূল হাঁপিয়ে উঠেছে। আবহাওয়া অধিদফতর বলছে বৃষ্টি হবে। কমবে তাপমাত্রা।
বাংলা     বর্ষপরিক্রমায় বর্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ঋতু। আষাঢ়ের প্রথম দিন শুরু হয়ে এই ঋতু চলবে শ্রাবণের শেষ দিন পর্যন্ত। কারণ আষাঢ়-শ্রাবণ দু’মাস বর্ষাকাল। এ সময় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু (বর্ষা) সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টি হয়। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। তাই চারপাশের পরিবেশ বদলে যায়।

ভাটি বাংলার লোককবিরা, বাউলরা এ ঋতু দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত। বাউলদের তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিত সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এই সাতটি জেলার লোককবিরা বর্ষা নিয়ে বিশেষ প্রভাবিত হয়ে থাকেন। তাদের কালজয়ী সৃষ্টির ভাণ্ডার এর প্রমাণ। হাওর এলাকার চেহারাও একেবারে বদলে যায় বর্ষায়। গ্রীষ্মে হাওরের যে অংশ পায়ে হাঁটার পথ, বর্ষায় তা অথৈ জল-নদী। শুকনো মৌসুমে যে জায়গায় হালচাষ করেন কৃষক, ভরা বর্ষায় সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরেন জেলেরা। এ সময় ভাটি অঞ্চলের বাবা-মায়েরা নৌকায় করে তাদের মেয়েকে নাইওর আনেন। বিয়েশাদিও হয় প্রচুর। নৌকায় চড়েই বিয়ে করতে যান বর। ফসল উৎপাদনেও বিশেষ ভূমিকা রাখে বর্ষা। তাইতো ওস্তাদ মমতাজ আলী খান সুরে সুরে বলেন আইলো আষাঢ় লইয়া আশা/ চাষির মনে বান্ধে বাসা…।

অবশ্য বর্ষার সবই উপভোগ্য, উপকারের এমনটি বললে কিছু বেশি বলা হবে বৈকি! ভারি বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল গ্রামের পর গ্রাম যে ভাসিয়ে নেয়, এই বর্ষা! বন্যাকবলিত নিচু এলাকার মানুষ তাই আতঙ্কে পার করে বর্ষা। একই কারণে সারা বছরের অর্জন ফসল তলিয়ে যায়। সে অবস্থা তুলে ধরে ভাটিবাংলার সাধক পুরুষ বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম গান রচনা করেনÑ আসে যখন বর্ষার পানি, ঢেউ করে হানাহানি/ গরিবের যায় দিন রজনী দুর্ভাবনায়/ ঘরে বসে ভাবাগুনা নৌকা বিনা চলা যায় না/ বর্ষায় মজুরি পায় না গরিব নিরুপায়…।শৈশবের স্মৃতিচারণ করে প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা বলেন, ‘পুকুর ভরে উঠলে, মাছ লাফালাফি করত। ছোট মাছগুলো পুকুর থেকে বেরিয়ে যেত, তখন আমরা নালার মতো করে দিয়ে মাছ ধরতাম।’ বাংলা গানে, কবিতায়, সাহিত্যে বর্ষা আর বিরহবেদনা যেন এক সুতোয় গাঁথা। কোন সুদূর অতীতে কালিদাস মেঘদূত লিখেছিলেন কেই বা জানে! সেই মহাকাব্যের প্রভাবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল তো বটেই, বাংলার সব রথী-মহারথীই করেছেন বৃষ্টি-বন্দনা। আজও অঝোর বর্ষণের দিনে মন যেন কেমন করে।

বর্ষার শুরুতে কদম ফুটে না। আগেই ফুটে যায়। আবার শরৎ কালেও ফুটে। এই যে অনিয়ম, এটি জলবায়ুর পরিবর্তনের সূচক। এই বরষা ভিজিয়ে দিক মানুষের মনকেও। প্রকৃতির সাথে সাথে উচ্ছ্বসিত উদ্বেলিত হোক মানুষের হৃদয়। মনে লাগুক সজীবতার ছোঁয়া।

প্রধান সম্পাদক