উজ্জ্বল আলোকবর্তিকায় দৃঢ়তার প্রতীক

উজ্জ্বল আলোকবর্তিকায় দৃঢ়তার প্রতীক

।।সুফিয়া কামালের ১০৫ তম জন্মবার্ষিকী।।

 

::শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ:: ২০ জুন। কবি, বুদ্ধিজীবী,সমাজনেত্রী,নারী ব্যক্তিত্ব এবং নারী জাগরেণের পথিকৃৎ কবি বেগম সুফিয়া কামালের ১০৫ তম জন্মবার্ষিকী। ১৯১১ সালের এ দিনে বরিশালের শায়েস্তাবাদে এক অভিজাত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি।

সুফিয়া কামাল ছিলেন মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে এবং যাবতীয অন্যায়, দুর্নীতি ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার একজন সমাজসেবী ও নারী নেত্রী। তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। সুফিয়া কামাল তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তাঁর বাবা সৈয়দ আবদুল বারি ছিলেন উকিল। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি তার বাবাকে হারান। মাত্র ১২ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯২৩ সালে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিবাহ হয়। তখনকার পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে বাস করেও নিজস্ব চেষ্টায় এবং মায়ের স্নেহ ও পরিচর্যায় তিনি স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত হন। বিয়ের পর তিনি জাকজমকপূর্ণ পোশাক পরা বন্ধ করে তাতের শাড়ি পরা শুরু করেন। এ সময় তিনি নারী কল্যাণমূলক সংগঠন মাতৃমঙ্গল-এ যোগ দেন। ১৯২৩ সালে সুফিয়া কামাল রচনা করেন তার প্রথম গল্প সৈনিক বধূ যা বরিশালের তরুণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা বাসন্তী প্রকাশিত হয়।

 …

১৯২৯ সালে সুফিয়া কামাল যোগ দেন বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমান-ই-খাওয়া তিন-ই-ইসলামে। এখানে নারী শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারসহ নারীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হতো। বেগম রোকেয়ার আদর্শ সুফিয়াকে প্রভাবিত করেছে। ১৯৩১ সালে সুফিয়া কামাল মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম ইন্ডিয়ান মহিলা ফেডারেশনের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৩-৪১ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা কর্পরেশন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। স্কুলের চাকরির পাশাপাশি তার সাহিত্য চর্চাও চলতে থাকে। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তার সাঁঝের মায়া কাব্যগ্রন্থটি। এর ভূমিকা লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এটির প্রশংসা করেন। ১৯৪৭-এ সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা প্রকাশিত হলে তিনি তার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ বছরই তিনি সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৩২ সালে তাঁর স্বামীর আকশ্মিক মৃত্যু হয়। ১৯৩৩-১৯৪১ সাল পর্যন্ত কলকাতা কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পাশে দাঁড়ান। পরের বছর তিনি কলকাতায় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন।

মহীয়সী নারী, জননী সাহসিকা, সমাজের মুক্তির পথ রচয়িতাদের অন্যতম পথিকৃৎ সুফিয়া কামাল অকুতোভয় বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, মানব মুক্তি, নারী মুক্তি, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে, নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সব সময়ই ছিলেন সামনের সারিতে। ১৯৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি আয়োজিত ‘শান্তি মিছিলে’ সুফিয়া কামাল সম্মুখভাবেই ছিলেন। তিনি ছায়নট, কচিকাঁচার মেলা ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। তাঁর দুই মেয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে আগরতলায় হসপিটাল স্থাপন করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- সাঁঝের মায়া (১৯৩৮), একাত্তরের ডায়েরী, মোর যাদুদের সমাধি পরে, একালে আমাদের কাল, মায়া কাজল (১৯৫১),কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭) ইত্যাদি। ২০০২ সালে বাংলা একডেমী সুফিয়া কামালের রচনাসমগ্র প্রকাশ করে। সাহিত্যচর্চার জন্য সুফিয়া কামাল অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক জাতীয় পুরস্কার ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ লাভ করেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তা বর্জন করেন। এ ছাড়াও তিনি বাংলা একডেমী পুরস্কার (১৯৬২), একুশে পদক (১৯৭৬), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), উইমেনস ফেডারেশন ফর ওয়ার্ল্ড পিস ক্রেস্ট (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক (১৯৯৬), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭) লাভ করেন।

বস্তুতপক্ষে সামাজিক ও সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন এক বিশাল শক্তির প্রতীক। এই সমাজ সম্পৃক্ততায় তিনি নিজেই নিজেকে অতিক্রম করে হয়ে উঠেছেন আরো বড় মাপের মানুষ। বিপুল মানুষের সঙ্গে আত্মিক সংযোগ এবং বিপুলতর নিঃসহায় জনের জন্য গভীরতর ভালোবাসা ও নিরন্তর উদ্বেগই সুফিয়া কামালকে অসামান্য উচ্চতায় স্থাপন করেছে। এই সামগ্রিক উচ্চতা সমকালীন বাংলাদেশে আর কেউ অর্জন করেননি। সে জন্যই তিনি সমকালীন বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।  জীবন যে কত বড় এবং তা যে সাধনায়, ত্যাগে, সদিচ্ছায়, শ্রমে, অঙ্গীকারে কত সুন্দর ও তাৎপর্যপূর্ণভাবে নির্মাণ করা যায় তার নজির বেগম সুফিয়া কামাল। যে রক্ষণশীল মুসলমান সমাজে তার জন্ম সেখান থেকে তিনি শুধু উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে বেরিয়ে আসেননি দুঃসহ নিগড়ে আবদ্ধ বাঙালি মুসলমান নারী সমাজকে তিনি জাগরণের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন শৃঙ্খলমুক্ত জীবনের স্বাদ দিয়েছেন।

১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ৮৮ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়।

[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম ।।]
jsb.shuvo@gmail.com

 

প্রধান সম্পাদক