ধ্বনি, প্রতিধ্বনি

ধ্বনি, প্রতিধ্বনি
ছবি: সৈকত রুশদী।

সৈকত রুশদী: রিমান্ডে অর্থাৎ সরকারী হেফাজতে গুলিতে নিহত নাগরিক সন্দেহভাজন ‘জঙ্গী’ ফাহিমকে হত্যার পরোক্ষ দায় স্বীকার সরকার প্রধানের, জাতীয় সংসদে!


রাষ্ট্র, সরকার ও পুলিশ এক জিনিস নয়। রাষ্ট্র পরিচালনা করে সরকার। আর আইন প্রয়োগ ও শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের প্রশাসনিক শাখা পুলিশ বিভাগ। আইন প্রয়োগ বা শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে পুলিশ বিভাগ বা তার কর্মচারীরা ভুল করতে পারে। সেই ভুল নির্ণয়, ভুলের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত, সংশোধন ও শাস্তি বিধান এবং ভুলের পুনরাবৃত্তি রোধে আইন ও বিধি পরিবর্তন ও পুন:প্রশিক্ষণ সহ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশের কার্যক্রমে অপ্রত্যাশিত কোন ঘটনা বা মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনাকে সরকার ভুল মনে করছে কীনা।

কোন অপরাধের জন্য গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষে পুলিশের জিম্মায় নেওয়া হচ্ছে রিমান্ড। জিজ্ঞাসাবাদের নামে কাউকে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার নয়। বিনা বিচারে কোন মানুষ হত্যা তো নয়ই।

ঊনিশ বছরের তরুণ ফয়জুল্লাহ ফাহিমকে রিমান্ডে নেওয়া হয় মাদারীপুরের কলেজ শিক্ষক রিপন চত্রবর্তীকে খুনের উদ্দেশ্যে হামলা চালিয়ে আহত করার অপরাধে জড়িত অপর ব্যক্তিদের ও মূল নির্দেশ দাতাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে তার উপর যে শারীরিক অত্যাচার চালানো হচ্ছিল, আটক হওয়ার দিন এবং পরবর্তীতে তোলা তাঁর ছবির পার্থক্য থেকে তা’ স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। পরদিন হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় বুকে গুলিবিদ্ধ লাশ হিসেবে ফাহিমকে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর পুলিশের তরফ থেকে ঘোষণা করা হলো, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ফাহিম নিহত হয়েছেন। তাঁকে রিমান্ডের জন্য আদালতে দিনের আলোয় হাজির করা হয়েছিল মাথায় হেলমেট ও শরীরে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরিয়ে। আর তথাকথিত অপর ‘জঙ্গী’ ও ‘অস্ত্র’ অনুসন্ধানে গভীর রাতের অভিযানে ফাহিমকে সাথে নিয়ে ঘুরতে বের হলো পুলিশ তাঁর নিরাপত্তার সুরক্ষা না।করেই!

সরকারী হেফাজতে, পুলিশের জিম্মায় থাকা অবস্থায় কেন দেশের একজন নাগরিক হাতকড়া পরিহিত অবস্থায়ী গুলিতে নিহত হলো এবং আদালত থেকে নিজ হেফাজতে নেওয়ার পরও পুলিশ কেন তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলোনা, রিমান্ড মঞ্জুরকারী আদালতের সেই প্রশ্ন তোলা উচিত ছিল। রিমান্ড আবেদনকারী পুলিশ কর্মকর্তা, উর্ধ্বতন পুলিশ কর্তা ব্যক্তি, পুলিশ প্রধান, স্বরাষ্ট্র সচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে কারণ দর্শাও নোটিশ জারী করাটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তা’ হয়নি। নিম্ন আদালত না পারলে, হাইকোর্ট বিভাগ থেকে স্বত:প্রণোদিত হয়ে সুয়েমোটো রুল জারী করা উচিত ছিল। একজন নাগরিককে খুনের প্রচেষ্টার মতো অপরাধের জন্য গ্রেফতার করে, আইনসঙ্গত পন্থায় রিমান্ডে নেওয়ার পর সেই নাগরিক গুলিতে নিহত হলো হাতকড়া পরিহিত অবস্থায়। অর্থাৎ তাঁর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়নি। তাহলে ফাহিম কার গুলিতে মারা গেলেন, কে হত্যাকারী ও কার গাফিলতিতে এই হত্যাকান্ড, তা’ তদন্তের জন্য তো আদালতের বা বিচার বিভাগের একটি ভূমিকা থাকা প্রয়োজন ছিল। আপাত: ‘স্বাধীন’ বিচার বিভাগ তা’ করেনি। অথচ নাগরিক হত্যা, গুম ও আহত হওয়ার চেয়ে অনেক তুচ্ছ কোন কোন বিষয়ে, যেমন রাজপথে বিচারপতির গাড়িকে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের সময় অগ্রাধিকার না দেওয়ার জন্য প্রকাশ্য রাজপথে পুলিশ সদস্যকে অপমান ও শাস্তি দেওয়া হয়েছে, হাইকোর্টের বিচারক বা আদালতের পক্ষ থেকে স্বত:প্রণোদিত হয়ে এই বাংলাদেশে।

সেক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পক্ষ থেকে একটি বিচার বিভাগীয় বা উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক তদন্তের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ছিল। একটি সভ্য দেশে সেটিই প্রত্যাশিত। কিন্তু এক্ষেত্রে বা তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও ‘ক্রসফায়ারে’ রাষ্ট্রের নাগরিককে বিনা বিচারে হত্যার পরও প্রকৃত হত্যাকারী কে, তা’ তদন্ত ও চিহ্নিত করা হচ্ছেনা। বরং ফাহিম হত্যার বিচার দাবীকারী অসংখ্য নাগরিকের একজন, বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যে ২৯ জুন জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “ফাহিমের জন্য ‘মায়াকান্না’ কেন” শীর্ষক বক্তব্য ফাহিম হত্যার বিচারের দাবীর প্রতি সমর্থনের পরিবর্তে সরকারের হেফাজতে নাগরিক হত্যার দায় স্বীকারের সমার্থক হয়ে দাঁড়ালো।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয় ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারী সরকারী হেফাজতে গুলিতে পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির প্রধান সিরাজ সিকদার নিহত হওয়ার পর সেই জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উক্তি ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’

সরকারের হেফাজতে নাগরিক হত্যার ক্ষেত্রে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া নিজেও নিষ্কলুষ নন। তিনি সরকার প্রধান থাকাকালে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট” নামে সশস্ত্রবাহিনী ও পুলিশের যৌথ অভিযানে আটক বহু নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন বিনা বিচারে। তবে সে দায় তিনি স্বীকার করেননি জাতীয় সংসদে বা তার বাইরে। এজন্য কোন এক সময়ে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে।

জবাবদিহি করতে হবে বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকেও। সরকারী হেফাজতে বিনা বিচারে ফাহিমের মতো নাগরিকদের হত্যার জন্য এবং তার প্রতিকারের ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য।

[সৈকত রুশদী: প্রবাসী সাংবাদিক।]
টরন্টো ৩০ জুন ২০১৬

অতিথি লেখক