আহসান হাবীব: জাতিসত্তার কবি

আহসান হাবীব: জাতিসত্তার কবি

কবি আহসান হাবীবের ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী


শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ:
কবিতা এবং কথাসাহিত্যে তাঁর প্রখর-চেতনা সমাজলগ্নতা ও শৈল্পিক অনুভূতির অভিব্যক্তি সচেতন পাঠকের চিন্তা-প্রবণতাকে আন্দোলিত করে। শিল্পকর্মে রুচিশীলতার লালনকর্তা-প্রশ্রয়দানকারী হিসেবে তাঁর মর্যাদা ঈর্ষণীয়। মধ্যবিত্ত-মানস, দাম্পত্য-পরিসর, সমাজপরিবেশ, কিশোর-স্বভাব, মূল্যবোঁধের অবক্ষয় প্রভৃতি তাঁর চিন্তাভুবনের উপাদান। সমকালীন প্রবণতাকে বাদ দিয়ে শুধু কল্পনা বিলাসে শিল্পের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা অসম্ভব-প্রায়- এ উপলব্ধি তিনি লালন করতেন। কবিতাশিল্পের জন্য তাঁর আকুলতা আর এ পথে পথিক কিংবা সহযাত্রী তৈরিতে তিনি ছিলেন অফুরান অনুপ্রেরণার উৎস।তিনি আহসান হাবীব। যার কবিতায় আমরা পাই সমাজের বিশেষ স্থিতির প্রতি সবিশেষ অভিনিবেশ।


১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি। পিরোজপুরের শংকরপাশা গ্রামে আহসান হাবীবের জন্ম। পিতার নাম হামিজুদ্দীন হাওলাদার। মাতা জমিলা খাতুন।  পাঁচ ভাই চার বোনের মধ্যে তিনি জেষ্ঠ্য।বিবাহিত জীবনে তিনি ছিলেন চার সন্তানের জনক। শ্বশুড় বাড়ি বগুড়া সদর থানার নামাজগড়। স্ত্রীর নাম খাতুন সুফিয়া। সন্তানদের মধ্যে বড় মেয়ে কেয়া চৌধুরী বর্তমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের উজ্জ্বল মুখ। দ্বিতীয় মেয়ে জোহরা নাসরিন গৃহিণী। ছেলে মঈনুল আহসান সাবের পেশায় সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক। ছোট ছেলে মঞ্জুরুল আহসান জাবেদ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।


পারিবারিক ভাবে আহসান হাবীব সাহিত্য সংস্কৃতির আবহের মধ্যে বড় হয়েছেন। সেই সূত্রে বাল্যকাল থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। সেইসময় তাঁর বাড়িতে ছিল আধুনিক সাহিত্যের বইপত্র ও কিছু পুঁথি। যেমন আনোয়ারা, মনোয়ারা, মিলন মন্দির প্রভৃতি। এসব পড়তে পড়তে একসময় নিজেই কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করেন। মাত্র ১৩ বছর বয়েসে  স্কুল ম্যাগাজিনে তাঁর একটি প্রবন্ধ ‘ধরম’ প্রকাশিত হয়। ১৯৩৪ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘মায়ের কবর পাড়ে কিশোর’ পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। পরবর্তী সময়ে ছাত্রাবস্থায় কলকাতার কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হলে নিজের সম্পর্কে আস্থা বেড়ে যায়। স্কুলে পড়াকালীন তিনি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তুকে কবিতায় উপস্থাপিত করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। সাহিত্যের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে ১৯৩৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি চলে আসেন বরিশালে। ভর্তি হন সেখানকার বিখ্যাত বিএম কলেজে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কলেজের পড়াশোনার পাঠ শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত রাখতে হয় তাঁকে। বিএম কলেজে দেড় বছর পড়ার পর ১৯৩৬ সালের শেষার্ধে কাজের খোঁজে তিনি রাজধানী কলকাতায় পাড়ি জমান।


কলকাতা গিয়ে শুরু হয় আহসান হাবীবের সংগ্রামমুখর জীবনের পথচলা। ১৯৩৭ সাল। মাত্র ১৭ টাকা বেতনে প্রথমে চাকরি নেন ফজলুল হক সেলবর্ষী সম্পাদিত ‘দৈনিক তকবীর’ পত্রিকায়। পরবর্তীতে তিনি ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার ‘বুলবুল’ পত্রিকা ও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মাসিক ‘সওগাত’ পত্রিকায় কাজ করেন। এছাড়া তিনি আকাশবাণীতে কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট পদে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন।


কবি হিসেবে আহসান হাবীবের যাত্রা শুরু হয় অবিভক্ত বাংলায়। বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল তখনো ছিল অখণ্ড আকাশের মতো। ধূর্ত ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর কূটচালে তখনও সীমান্তে আজকের মতো কাটাতাঁরের বেড়া কিংবা সীমানা চিহ্ন বসেনি। তবে রাজনীতির মঞ্চে তখন বিভাজনের হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। ঠিক সে সময় যে কজন মুসলমান তরুণ আধুনিকতাকে আত্মস্থ করে বাংলা কবিতার গতিপথে ঢুকে পড়েছেন তার মধ্যে আহসান হাবীবের নাম অগ্রগণ্য। ১৯৪৭ সালে দ্বিখন্ডিত বাংলায় তিনি ফিরে এলেন ঢাকায়। উপমহাদেশের রাজনীতির টালমাটাল করা পাগলা হাওয়ার কবলে তিনি পতিত হননি। অথচ তত্কালীন মধ্যবিত্ত সমাজ সেদিন স্বাধীনতার স্বপ্ন আর ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। স্ব স্ব ধর্মের কবিরা সচেতন ভাবে রাজনীতি ও ধর্ম উত্সারিত কবিতা লিখতে শুরু করেন। এমন পরিস্থিতিতে আহসান হাবীব সরাসরি রাজনীতি কিংবা ধর্ম উত্সারিত একটি লাইনও রচনা করেননি। দেশ বিভাগের পরবর্তী সময়েও তাঁর এই নির্বিকার মনোভাব অব্যাহত ছিল। সাহিত্য, রাজনীতি, দলবাজিতা কিংবা ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি তিনি পছন্দ করতেন না। সচেতন ভাবেই তিনি এ ধরনের প্রচেষ্টা থেকে নিজেকে রেখেছেন মুক্ত। অন্যদিকে নিজের কবিতাকেও রেখেছেন নিরাপদ দূরত্বে। তাঁর এমন নির্মোহতা প্রচণ্ড প্রাণ শক্তির পরিচয় বহন করে। দেশভাগের পর আহসান হাবীব রাজধানী ঢাকা আসেন ১৯৫০ এর দশকে। এখানে এসেও চাকরি নেন ‘দৈনিক আজাদ’ ও ‘মাসিক মোহাম্মদী’তে। পরে ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’, ‘সাপ্তাহিক প্রবাহ’-ও কাজ করেন। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি ‘ফ্রাঙ্কলিন বুক প্রোগামস’-এ উপদেষ্টা হিসেবে চাকরি করেন। এক সময় তিনি নিজেও একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সর্বশেষ কাজ করেছেন ‘দৈনিক বাংলা’-য় (সাবেক ‘দৈনিক পাকিস্তান’)। এ পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই (১৯৬৪) এর সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।


তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস , ছড়াগান ও অনুবাদকার্য ছড়িয়ে থাকলেও আহসান হাবীব মূলত কবি। সময়ের প্রয়োজনে সাহিত্যের অন্যান্য শাখাগুলোয় আগ্রহী হয়ে উঠলেও কবিতায়ই ছিল তার মূল আগ্রহের জায়গা। শৈশবে, কৈশোরে ও পারিবারিক অনুকূল আবহে সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালবাসা ছিল এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর এই ভালবাসা ছিল মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘রাত্রি শেষে’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে কমরেড পাবলিশার্স থেকে। প্রকাশক ছিলেন বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ।


শিশুতোষ লেখায়ও আহসান হাবীবের সাবলীল বিচরণ ছিল। সত্তর দশকে শিশু সাহিত্য রচনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। শিশুকিশোর রচনার ঢং, বক্তব্য ও চিন্তা-চেতনায় তিনি নিয়ে আসেন নতুন ব্যঞ্জনা। ‘ছুটির দিনদুপুরে’, ‘পাখিরা ফিরে আসে’ এ দুটি বাংলা শিশু সাহিত্যে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়া শিশুকিশোরদের জন্য লেখা তাঁর অন্য গ্রন্থগুলি হলো ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’, ‘রেলগাড়ি ঝমাঝমে’, ‘রাণীখালের সাঁকো’, ‘জো্ত্স্না রাতের গল্প’, ‘ছোট মামা দি গ্রেট’ ইত্যাদি।


১৯৬১ সালে সাহিত্য সাধনায় স্বীকৃতি স্বরূপ আহসান হাবীব ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়াও একাডেমী পুরস্কার,আদমজী পুরস্কার, নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক,একুশে পদক ও আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই। ৬৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পঞ্চাশ দশকের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি।


আহসান হাবীব। তৎকালীন পূর্ববাংলা, বর্তমান বাংলাদেশের জাতিসত্তার কবি। তিনি বিভ্রান্তি-বিবরণের কবি; জীবনের আঁধার-আলোক তাঁর কবিতার বিষয়াবলি। সকল প্রতিকূলতা আর পঙ্কিলতার স্তুপের আড়ালে তিনি সম্ভাবনার মঞ্চ তৈরি করতে আগ্রহী এবং আগ্রহ জাগাতে উৎসাহী। এ ভূখণ্ডের জাতীয় চেতনার প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বস্ততা আর এ অঞ্চলের মানুষের অধিকার-মর্যাদা এবং স্বপ্নবিভোরতা বিবরণের কবি। তাঁর কবিতাশিল্পের মহিমা ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা, শিল্পের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আর প্রজন্ম-প্রহর নিবিড়তা আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে বহু যুগ, বহুকাল।

[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।]
jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক