বন্ধু দিবসে সকল বন্ধুদের শুভেচ্ছা

বন্ধু দিবসে সকল বন্ধুদের শুভেচ্ছা

::শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ::  সাম্য গ্রামের ছেলে। গ্রামের পথ ঘাট, নদী- নৌকা, মাঠ- ঘাট এসব তার চিরচেনা। সারাদিন দ্বিগবিদিক ছুটে বেড়ানো আর খেলাধুলা তার দারুণ লাগে। আর ভালো লাগে বন্ধুদের। বন্ধু ছাড়া কি আর এসব জমে নাকি। সারাদিনের দুরন্ত খেলা, ডুব-সাঁতার, সবুজ মাঠে ভোঁ দৌড়, সবকিছুতেই সাথি হলো বন্ধুরা। আম বাগানে সবাই মিলে বনভোজনে বা গোয়েন্দার মত কোন অভিযানে সবখানেই দরকার বন্ধুদের। বন্ধু ছাড়া নতুন ফুটবলটা ঘরের কোনেই পড়ে থাকে, নতুন যে ক্রিকেট ব্যাট বা বল কিংবা মেলায় কেনা শখের রঙিন ঘুড়িটা উঠানেই পড়ে থাকে। তবু কিছুতেই নড়তে ইচ্ছে করে না। বন্ধু ছাড়া সবকিছু কেমন অর্থহীন মনে হয়। বন্ধুরা যখন কোন কারণে দূরে থাকে তখনই বোঝা যায় বন্ধুর আসল মর্ম। শুধু সাম্যর জন্যই নয় আসলে প্রত্যেক মানুষের জন্যই প্রয়োজন অন্তত একজন ভালো বন্ধু। যার কাছে মনের সব কথা বলা যায় নির্দ্বিধায়, যার সাথে সব সুখ- দুঃখ ভাগ করে নেয়া যায়। সুখের দিনে সেই তো পাশে থাকে, আবার দুঃখেও থাকে ছায়ার মতো। একজন ভালো বন্ধু আসলে মানুষের অদৃশ্য বিবেকের মতো। কারণ সে ভালো কাজে উৎসাহ দেয় আর খারাপ কাজে নিরুৎসাহিত করে সবসময়। তাই তো, ভালো বন্ধু টিকে থাকে সারাজীবন। সবুজ ঘাস সজীবতার প্রতীক। সেই আবার তারুণ্যের প্রতীক, জীবনের প্রতীক। বন্ধু বা বন্ধুত্ব মানেও যেন একরাশ সবুজ। একজন ভালো বন্ধুর ছোঁয়ায় আমাদের জীবন হয়ে ওঠে সবুজ আর সুন্দরতম। বিশ্ব বন্ধু দিবসে সব বন্ধুকে শুভেচ্ছা।

বন্ধু দিবসের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, প্রাচীনকালে মানুষের জীবনযাত্রা ছিলো খুবই কঠিন। তখন কাঁচা মাংস বা ফলমূলই ছিলো তাদের দৈনন্দিন খাবার। তাদের ভালো কোন পোশাক ছিলো না, আশ্রয়ের জন্য ছিলো না ভালো কোন বাসস্থান। আস্তে আস্তে মানুষ আবিস্কার করে আগুন, চাকা, নানা ধরনের অস্ত্র সহ আরও কত কিছু্‌। সে সময় মানুষকে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে ঝড়ে কষ্ট পেতে হয়েছে। খাবারের জন্য পশু শিকার করতে হয়েছে। আবার হিংস্র পশুর হাত থেকে বাচাঁর জন্যে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এতসব বিপদের মাঝে তারা একটা জিনিস খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছে যে মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে, ভালোভাবে বাঁচতে হলে একসঙ্গে থাকতে হবে। তাই তারা নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। তাদের মধ্যে ভাবের বিনিময় হয়। একে অপরের প্রয়োজনে, বিপদে আপদে, দুঃখে কষ্টে যেমন এগিয়ে আসতে শুরু করে তেমনি আনন্দটাও উপভোগ করতে থাকে একসাথেই। আর তখনই সবার মাঝে গড়ে ওঠে একটা সম্পর্ক। যে সম্পর্কের নাম বন্ধুত্ব। তারা বুঝতে শুরু করে, বন্ধুত্বের মানে পরষ্পরের মাঝে সহযোগিতা, বন্ধুত্বের মানে সুখে-দুঃখে এক থাকা, বন্ধুত্ব মানে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব মানে বিশ্বাস, বন্ধুত্ব মানে একজনকে আরেকজনের ভালোলাগা। বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো সেই মানুষ থেকে আজকের এই আধুনিক মানুষের মাঝে অনেক কিছুই বদল হয়েছে। বদল হয়েছে তাদের পোশাক-আশাক, চলাফেরা, খাওয়া- দাওয়া সবকিছুই। তবে কিছু জিনিস তাদের ভিতর এখনও সেই আগের মতই রয়েছে। তারই একটা হল বন্ধুত্ব। মানুষে মানুষে যে আকর্ষণ তারই অপর নাম হলো বন্ধুত্ব। একজন যখন অন্য একজনের কাছে থাকতে পছন্দ করে, পারস্পরিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসে আর আনন্দে এক সাথে হাসে তখনই বোঝা যায় বন্ধুত্ব কী। আধুনিক মানুষ বড় ব্যস্ত। কিন্তু তাই বলে বন্ধুর প্রতি কোন টান নেই? তেমনটা কিন্তু না। বরং বন্ধুত্বটাকে আরও গাঢ় করার জন্যে, বন্ধুর জন্য কিছু করার জন্যে, বন্ধুর সঙ্গে আয়োজন করে একটা দিন কাটানোর জন্যে আমেরিকাতে প্রথম প্রবর্তিত হয় বন্ধু দিবস। ১৯৩৫ সালের দিকে আমেরিকার সরকার তাদের কংগ্রেসে আগষ্ট মাসের প্রথম রবিবারকে ‘বন্ধু দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। তবে চিলিতে অক্টোবরের প্রথম শুক্রবারকে বন্ধু দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। প্রথমদিকে আমেরিকাতেই শুধু উদযাপিত হত বন্ধুত্ব দিবস। আস্তে আস্তে অন্য দেশগুলোতে, এরপর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে বন্ধু দিবসের ধারণা। সেই স্রোত এসেছে আমাদের দেশেও। আমাদের দেশেও এখন সমান্তরালে প্রতিবছরই পালন করা হয় এই দিবস।

কথায় বলে বিদেশি ভাষার বুলি, দেশি ভাষায় গালি। তাই না জেনে না বুঝে বিদেশি ভাষা না ব্যবহার করাই সঙ্গত। তবে আজ বাংলাভাষায় বন্ধু শব্দের কিছু বিদেশি প্রতিশব্দ জানিয়ে দিচ্ছি। বন্ধু দিবসের দিন বন্ধুদের একটু অন্য ভাষাতে ডেকে চমকে দিতে পারা যায়। বন্ধুরাও ভাববে এ আবার কোন ভাষা! বাঙ্গালি জাতি বৈচিত্র প্রেমী। ভাষাগত এই বৈচিত্রও হয়তো কারো কারো কাছে আকষর্ণীয় হয়ে উঠতে পারে।


আলবেনিয়া- মিল্ক
আফ্রিকা- ভ্রেন্ড
চীন- পেনজিউ
ডাচ- ভ্রেন্ড, ভ্রেঞ্জ
ডেনিশ- ভেন
ফ্রেঞ্চ- আমি
জার্মানী – ফ্রিউন্ড
জর্জিয়ান- মেগোবারি
হাংগেরিয়ান – বারাট
হিন্দি- দোস-
ইটালিয়ান- আমিকো
আইরিশ- কারা
জাপানি- টমোডাচি
কোরিয়ান- জিঙ্গু
ল্যাটিন-আ্যামিকাস
রাশিয়ান- প্রিজাটেল
সংস্কৃত- মিত্রা
স্পেনিশ – আমিগো


একটা কথা হলো, আমাদের প্রিয় বন্ধু হয়তো এই মুহূর্তে আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। কর্ম ক্ষেত্রে কিংবা অনান্য কারণে যান্ত্রিক জীবনে ব্যস্ত থাকাটাই স্বভাবিক। ইচ্ছে থাকা সত্বেও এখন আর অনেকের সাথেই যোগাযোগ রক্ষা করা যায় না। তবে তাই বলে বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা কিন্তু কিন্তু কমে যায় না। বন্ধু তো একদিনের জন্য নয়। বন্ধু হচ্ছে সারা জীবনের পথ চলার অনুপ্রেরণা।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বন্ধু উৎসব:

আমেরিকায় প্রথম চালু হলেও বন্ধু দিবস এখন আর আমেরিকার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। কারণ বিশ্বের অনেক দেশই এই দিবসটি পালন করছে তাদের নিজের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির সাথে মিল রেখে। তাই বন্ধু দিবস এখন আর্ন্তজাতিক একটি উৎসব।

আমেরিকায় বন্ধুত্বের উৎসব: আমেরিকায় অনেক বড় আকারে পালন করা হয় বন্ধু দিবস । ছোট বড় সবাই সমান উৎসাহে মহাসমারোহে পালন করে এই দিনটি। সবাই তার প্রিয় বন্ধুকে শুভেচ্ছা জানানোর একটা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে এই উৎসবকে। সারা শহরজুড়ে যেন একটা সাজ সাজ রব পড়ে যায়। সবাই তাদের প্রিয় বন্ধুর জন্য উপহার কিনতে ঘুরতে থাকে মার্কেটে মার্কেটে।
দিনটাকে আনন্দময় করতে তারা আয়োজন করে নানা ধরনের পার্টির। সবাই মিলে প্ল্যান করতে থাকে কিভাবে কাটানো যায় দিনটা। বন্ধু দিবস উপলক্ষে এই দেশের বিভিন্ন হোটেল নানা ধরনের সুযোগ সুবিধার ঘোষণা দিয়ে থাকে। মার্কেটগুলোও বন্ধুত্ব দিবসের উপহার সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসে। চারিদিকের পরিবেশ যেন বন্ধুকে আরও কাছে পাবার, বন্ধুর জন্য আরও কিছু করার জন্য উৎসাহিত করে।


ভারতে বন্ধুত্বের উৎসব: বন্ধু দিবস ভারতে নতুন কোন ধারণা নয়। বিভিন্ন গ্রন্থে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। তবে বন্ধু্ব দিবসটাকে আলাদা করে উদযাপনের প্রথা উপমহাদেশে পূর্বে ছিল না। উপহার বিনিময়, কার্ড আদান প্রদান, বন্ধুর হাতে রাখি বাঁধা, মোবাইলে এসএমএস বিনিময়, অনলাইনে ই-কার্ড দেয়া-নেয়া প্রভৃতির মাধ্যমে উদযাপন করা হয় বন্ধু দিবসটি। বন্ধু দিবস আসার আগেই সপ্তাহব্যাপী দোকানগুলো নানা রকম উপহার সামগ্রী আর কার্ড সাজিয়ে রাখে। কিছু কিছু রেস্তোরা বিশেষ বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে। আর বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয় বন্ধুত্ব দিবসের কথা। সব মিলিয়ে শহরগুলোতে বন্ধুত্ব দিবসের আয়োজনটা বেশ ভালোই হয়।

 

মেক্সিকোতে বন্ধুত্বের উৎসব: সারা দুনিয়ায় যেখানে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালন করা হয় সেখানে মেক্সিকোতে এ‌ই দিন পালন করা হয় বন্ধু দিবস । এই দিন একই সাথে ভালোবাসা দিবস আবার বন্ধু দিবস পালন করা হয়। বন্ধু্ব দিবস উপলক্ষে সেখানের রেস্টুরেন্টগুলো আয়োজন করে নানা পদের মজাদার খাবারের। বিভিন্ন দোকানেও দেখা যায় এ উপলক্ষে বিশেষ বিশেষ উপহারের ঘোষনা।


আর্জেন্টিনা বন্ধুত্বের উৎসব: ফুটবল খেলার সুবাদে আর্জেন্টিনাকে মোটামুটি এদেশে বিশেষভাবে পরিচিত। খেলার পাশাপাশি কিন্তু তারা বন্ধু্ব দিবসও পালন করে। এই দিন তারা দল বেঁধে কোন রেস্টুরেন্টে খেতে যায় বা ঘুরতে যায়। আবার কখনো এমনও যে সবাই মিলে কারো বাড়িতেই আয়োজন করা হয় একটা বন্ধুত্ব দিবসের পার্টি। তারপর সে পার্টিতে একজন আরেক জনের সঙ্গে খোশ গল্পে মেতে ওঠে। এমন অনেক বন্ধু আছে যাদের সঙ্গে এমনিতে খুব একটা দেখা হয় না। বন্ধুত্ব দিবসের উছিলায় তাদের সঙ্গেও দেখা হয়ে যায় তাদের। এজন্য সে দেশে বন্ধুত্ব দিবসটাকে বেশ আয়োজন করেই পালন করা হয়।

জাপানে বন্ধুত্বের উৎসব: বন্ধু দিবসে জাপানিরা বেশ জাঁকজমকের সাথে পালন করে। পুরো পরিবার নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে যায় তারা। রেস্টুরেন্টগুলো তাদের দরজা বন্ধ করে খাবারগুলো বিক্রির জন্য বাইরে নিয়ে আসে। টেবিল পেতে থরে থরে সাজিয়ে রাখে নানা ধরনের খাবার। সে দেশে পিৎজা বেশ প্রিয়। বন্ধু দিবসের দিন পিৎজার জন্য লাইনে ঘন্টার ঘন্টার পর দাঁড়িয়ে থাকে। শহরের লোকদের হাতে হাতে পিৎজা নিয়ে ঘুরতে দেখা যায় হরদম।

বাংলাদেশে বন্ধু দিবস: শুধু বড় বড় দেশগুলোও নয় আমাদের দেশেও পালিত হয় বন্ধুত্ব দিবস । তবে এখনও সীমিত আকারেই রয়েছেই এটি। অন্যভাবে বলতে গেলে প্রাথমিক অবস্থাতেই রয়েছে এর উদযাপন। সমষ্ঠিগতভাবে তেমন উল্ল্যেখযোগ্যভাবে এর উদযাপন হয় না। তবে ব্যাক্তিগতভাবে উদযাপন একেবারে কম নয়। ব্যাক্তিগত পর্যায়ে এসএমএস আদান প্রদান, কার্ড আদান প্রদান, বই বা অন্য কোন উপহার বিনিময় করতে দেখা যায় বেশ। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বেশ কিছু রেস্তোরা এ উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন করে থাকে। আবার কিছু বিপনী বিতানে বিভিন্ন পণ্যের উপর বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। ভারতের মত বাংলাদেশেও মূলত তরুণদের মধ্যেই এই সংস্কৃতির লালন বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশের ছোট বড় সব শহরের তরুণরা এই দিনে তাদের বন্ধুদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকে। তবে গ্রামের দিকে এর উদযাপন লক্ষ করা যায় না বললেও চলে।

একজন বিখ্যাত মনীষী বলেছিলেন, “আত্মীয়-স্বজন জন্মসুত্রেই পাওয়া যায়, কিন্তু বন্ধু বেছে নেয়ার সুযোগ আছে। এজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।” সত্যিই কোন রকম রক্ত সম্পর্কের না হওয়া সত্ত্বেও একজন মানুষ আরেকজন মানুষের এতো আপন হতে পারে এবং নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে সেটা একজন সত্যিকার বন্ধুর মাধ্যমেই উপলদ্ধি করা যায়। তাই একজন ভালো বন্ধু পাওয়া এবং কারও ভালো বন্ধু হওয়া মানে অনেক বড় অর্জন। তাই সময় থাকতে সত্যিকার বন্ধুকে চিনে নিতে ভুল করা মানে চরম বোকামি। হয়তো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই বোকামির জন্য কষ্ট পেতে হতে পারে।

আর শুধু বন্ধু দিবসেই নয় বছরের সবদিনই বন্ধুর জন্য ভালোবাসা প্রকাশ করা যায়। আবারও বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা রইলো সকল বন্ধুদের প্রতি। আমাদের সকলের মাঝে যেন বন্ধুত্ব চির সবুজ এবং সতেজ থাকুক সারা বেলা, সারা জীবন…। পরিশেষে আমার সবচেয়ে কাছের এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে স্মরণ করছি। যিনি আজ আমার দৃষ্টির সীমানার বাইরে, হৃদয়ের অন্তরালে। তিনি হলেন, আমার বাবা প্রয়াত বিশিষ্ট সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জি। হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে বাবা…!

[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ:  প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।]

jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক