দুর্ঘটনা: প্রতিরোধ নেই, প্রতিকারও নেই!

দুর্ঘটনা: প্রতিরোধ নেই, প্রতিকারও নেই!

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: দেশে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। সড়ক, নৌ এবং রেলপথে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পাশাপাশি অনেকে হয়ে পড়েছে পঙ্গু। কিন্তু তারপরও থেমে নেই দুর্ঘটনা। চালকের অসচেতনতা, অজ্ঞতা কিংবা ফিটনেসহীন যানের কারণে দুর্ঘটনায় মৃত্যু এখন নিত্যদিনের ঘটনা। রেল ও নৌ-দুর্ঘটনার তুলনায় এগিয়ে আছে সড়ক দুর্ঘটনা।


১৩ আগস্ট। ২০১১ সালের এই দিনে সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছিলো বাংলাদেশের ২ প্রতিভাবানের প্রাণ। বাংলাদেশী চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং সাংবাদিক মিশুক মুনীর। শুটিং স্পট থেকে ফেরার পথে মানিকগঞ্জে প্রাণ হারান তারা। তাদের মৃত্যুর পর বহু আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। শত শত মিটিং হয়েছে। কীভাবে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এসব মিটিং ছিলো সেই বিষয়ক। প্রশ্ন হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা কী কমেছে?

ডব্লিউএইচওর এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা বিশ্বে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনা নিহত হয় প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মানুষ। সংস্থাটির মহাসচিব মার্গারেট চ্যান বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ক্ষতি অপূরণীয়, বিশেষ করে দরিদ্র দেশের গরিব মানুষের জন্য। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মৃত্যুর হার ৮৫ দশমিক ৬। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছাড়াও আহত ও স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ববরণের হারও কম নহে। এই সমস্যা একটি সোশ্যাল বা সামাজিক ট্রাজেডিতে পরিণত হয়েছে। দেশে নগরায়ন ও যানবাহনের যান্ত্রীকরণের হার যত বাড়ছে, সেটার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। যেমন ২০১০ সালে বার্ষিক নগরায়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪%, সেখানে মোটরগাড়ির প্রবৃদ্ধি ছিল ৮%। বিশ্বব্যাংকের আরেকটি তথ্য থেতে জানা যায়, জাতীয়, হাইওয়ে ও জেলার প্রধান সড়কগুলোর ৪০% ভালো। বাকি ৬০ ভাগ রাস্তাই খারাপ। তাছাড়া লক্কড়-ঝক্কর মার্কা যানবাহন, অননুমোদিত যানবাহন এবং অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অদক্ষ তথা লাইসেন্সধারী বিহীন চালকের সংখ্যাই বেশি এই দেশে। এই যখন অবস্থা, তখন সড়ক দুর্ঘটনা না ঘটাটাই যেন অস্বাভাবিক।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)-এর তথ্য অনুযায়ী, বছরে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণ করেন। গড়ে প্রতিদিন ৯ থেকে ১০ জন পঙ্গুত্ববরণ করছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। বছরে ৫ হাজার ৭০০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত হন। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পঙ্গুত্ববরণ করেন। যদিও বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা ৩-৪ গুণ বেশী বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ যানবাহনের মধ্যে ফিটনেসবিহীন যানবাহন রয়েছে ৩ লাখের বেশি। আর যেসব যানবাহনের ফিটনেস আছে, সেগুলোও যথাযথভাবে নেয়া হয় না। কারণ, ৪০ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি যানবাহনের সনদ দেয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ খালি চোখে একটু দেখেই ফিটনেস দিয়ে দেয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিটনেস সনদ দেয়ার যন্ত্র বিকল হয়ে আছে এক যুগ ধরে। দেশে চালকের লাইসেন্স আছে সাড়ে ১৫ লাখ। এরও একটা বড় অংশ দেয়া হয়েছে যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া, শ্রমিক ইউনিয়নের দেয়া তালিকা ধরে। অর্থাৎ প্রায় ৮ লাখ যানবাহনের কোনো চালক নেই। অথচ বাণিজ্যিক যানবাহনের প্রতিটির জন্য দু’জন চালক দরকার হয়। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ভাঙাচোরা ও ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক, অতিরিক্ত গতি, ওভার টেকিং, নিয়ম না মানার প্রবণতা এবং জনসচেতনতার অভাবকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।


বুয়েটের এআরআই’র সেফ ড্রাইভিং ম্যানুয়ালে পুলিশের রেকর্ড তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ বছরে (১৯৯৮-২০১৪) দুর্ঘটনায় ৪৫ হাজার ৯৪০ প্রাণ হারিয়েছেন। বছরে গড়ে ২ হাজার ৭০২ জন লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এই সময়ে আহত হয়েছেন ৪২ হাজার ২৯৭ জন। দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৩ হাজার ১৯১টি। প্রকৃতপক্ষে প্রাণহানির সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৮ থেকে ১২ হাজার। সড়ক দুর্ঘটনায় দেশ ও জাতি প্রতিবছরে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, যা দেশের জিডিপি’র শতকরা ২ থেকে ৩ ভাগ।


রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় গত ৫ বছরে প্রাণ হারিয়েছেন ৭ জন সাংবাদিক। ২০১১ সাল থেকে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন দৈনিক কালেরকণ্ঠের সাবেক উপ-সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল ফারুক। ট্রাকের ধাক্কায় নিহত হন তিনি। এর আগে ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন সাংবাদিক জগলুল হায়দার চৌধুরী। ২০১২ সালের ১১ মে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বাসচাপায় নিহত হন ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের সিনিয়র রিপোর্টার বিভাস চন্দ্র সাহা। একই দিন শাহবাগে বাসচাপায় নিহত হন বরিশালের আঞ্চলিক দৈনিক মতবাদের ফটোসাংবাদিক শহীদুজ্জামান টিটু। এর আগে একই বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর নিউমার্কেটের সামনে ফুটওভার ব্রিজের কাছে বাসচাপায় দৈনিক প্রান্ত পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার ফখরুল হোসেন নিহত হন। ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি মেয়ে অথৈকে স্কুলে রেখে মোটরসাইকেলে করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে যাওয়ার পথে সরকারি বাণিজ্যিক সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যান দৈনিক আমাদের সময়ের সাংবাদিক দীনেশ দাস। ২০১১ সালের ১৬ জুলাই রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিসিএস কম্পিউটার সিটির সামনে বাসের ধাক্কায় মারা যান সময় টেলিভিশনের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক বেলাল হোসেন।


এআরআই’র পরিসংখ্যান মতে, ২০১৪ সালে মারা গেছে ১ হাজার ৬৩২ জন। আহত হয়েছেন ৭৯৯ জন। ২০১৩ সালে মারা গেছেন ১ হাজার ৭৮২ জন। আহত হয়েছেন ৯২৭ জন, ২০১২ সালে প্রাণ হারান এক হাজার ৯৫৩ জন এবং আহতের সংখ্যা ১ হাজার ৩৪২ জন। ২০১১ সালে নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৭২ জন এবং আহতের সংখ্যা ১ হাজার ৪৪৮ জন, ২০১০ সালে মারা যান ২ হাজার ৪৪৩ জন এবং আহত হন ১ হাজার ৭০৬ জন। ২০০৯ সালে মারা গেছেন ২ হাজার ৭০৩ জন এবং আহতের সংখ্যা ১ হাজার ৭৪৬ জন।

এআরআই মতে, সড়ক দুর্ঘটনার ৬৪ শতাংশ সংঘটিত হয় গ্রামাঞ্চলে। আবার গ্রামের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে মহাসড়কগুলোয়। বিভিন্ন ধরনের সড়ক দুর্ঘটনার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট দুর্ঘটনার শতকরা প্রায় ৫৪ ভাগই পথচারীর সঙ্গে সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনা। এআরআই মনে করে, পুলিশ দুর্ঘটনা ও হতাহতের যে হিসাব দেয়, প্রকৃত সংখ্যা এর ৩ গুণ।


বুয়েটের এআরআই ২০১০ সালের জুনে সারা দেশের ২০৯টি স্থানকে অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ (ব্ল্যাক স্পট) হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সওজের কাছে চিঠি দেয়। এতে কিছু কিছু জায়গায় কাজও হয়েছে বলে জানা যায়। তবে পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দেশে সারা বছর যত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, এর ৩৫ শতাংশ ঘটে জাতীয় মহাসড়কের ৪ শতাংশ এলাকায়।


২০০৮-২০১০ সালে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০টি ব্ল্যাক স্পটের ১২টির অবস্থান স্থানীয় বাজার। এরকম একটি স্পটে উল্লিখিত সময়ে ১২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এআরআই সূত্র বলছে, একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে বছরে ৩ বার বা তারও বেশি দুর্ঘটনা ঘটলে এটাকে ব্ল্যাক স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ব্ল্যাক স্পটগুলোতে সড়কের অস্বাভাবিক বাঁক থাকে, সড়কের পাশে হাটবাজার গড়ে ওঠে এবং সড়ক সংকেত থাকে না। সংশ্লিষ্টরা বলছে, ভাঙাচোরা ও ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক, গাড়ির অতিরিক্ত গতি, ওভার টেকিং, নিয়ম না মানার প্রবণতা এবং জনসচেতনতার অভাবে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।

অর্থাৎ আইন মানে না। আইনের প্রয়োগ হয় না। সচেতনতা বৃদ্ধি, চালকের প্রশিক্ষণ, আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে ৫০ শতাংশের উপরে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব।পরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণ, ত্রুটিমুক্ত যানবাহন নিশ্চিত করা এবং এ খাতে গবেষণা-পরিকল্পনার মাধ্যমে দুর্ঘটনা একেবারে কমিয়ে আনাও অসম্ভব নয় বলে গবেষকরা অভিমত দিয়েছেন। তবে এজন্য সকলের মধ্যে সমন্বয় থাকা আবশ্যক। রাস্তার ডিজাইন পরিবর্তন এবং রাস্তার বাঁক পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে হবে। রাস্তাগুলোয় চিহ্ন ব্যবহার করতে হবে।

বাংলাদেশে যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, ২০১৫ সালে ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬ হাজার ৫৮১টি। এই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৮ হাজার ৬৪২ জন, আহত হন ২১ হাজার ৮৫৫ জন। দেশে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ৫ হাজার ৯২৮টি। এই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৮ হাজার ৫৮৯ জন। গড়ে প্রতিদিন ২৪ জন লোক মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ১৭ হাজার ৫২৪ জন। ঈদকেন্দ্রিক দুর্ঘটনায়  ১৮৬ জন মারা গেছেন।


জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর সাম্প্রতিক এক জরিপ মতে, মাত্র ১ বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২১ হাজারের বেশি মানুষ। এর মধ্যে ৩২ শতাংশ পথচারী। এই হিসেব ২০১২ সালের। প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরে ডব্লিউএইচও বলেছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতি মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৬ শতাংশের সমান।


তবে বাংলাদেশের সরকারি হিসেব মতে, সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিমাণ দিন দিন কমছে। সরকারি হিসেবে, ২০১২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২ হাজার ৫৩৮ জন। ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ২ হাজার ৬৩৬টি। ২০১৩ সালে দুর্ঘটনা ঘটে ২ হাজার ২৯টি। নিহত হন ১ হাজার ৯৫৭ জন। আর ২০১৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ২ হাজার ৬৭ জন।


বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক তানভীর হাসান বলেন, পুলিশের হিসাবে ঘাটতি আছে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবের পদ্ধতিও পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাঁর ধারণা, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষ মারা যায়।


অনুসন্ধানে দেখা যায়, পুলিশের হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গেছে। কিন্তু এজন্য যে কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দরকার, সেটা নেয়ার কোন নজির নেই। সুস্পষ্ট কর্মসূচি ছাড়া দুর্ঘটনা কমে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সরাসরি কোনো তথ্য সংগ্রহ করে না। বিভিন্ন মাধ্যম বা উৎস থেকে তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে।


ডব্লিউএইচওর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হযয়েছে, সারা বিশ্বে যানবাহনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে মানুষ। এরপরও সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা মোটামুটি আগের মতোই আছে। গত ৩ বছরে বিশ্বের ৭৯টি দেশে দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা কমেছে। তবে ৬৮টি দেশের আবার এই সংখ্যা বেড়েছে। দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা কমিয়ে আনার দিক দিয়ে যেসব দেশ ভালো সাফল্য দেখিয়েছে, তারা সেটি করেছে আইন জোরদার করা ও তা বাস্তবায়ন এবং সড়ক ও যানবাহন আরও নিরাপদ করার মাধ্যমে।


ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান বলেন, ‘এই প্রতিবেদন থেকে এটা পরিষ্কার যে, সড়ক নিরাপত্তা কৌশল জীবন রক্ষা করছে। কিন্তু একই সঙ্গে এটা আমাদের দেখিয়েছে, এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি খুব মন্থর।’ জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ সদস্যদেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে উল্টো ঘটনা। দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় দিনে গড়ে ২৪ জন মারা গেছেন। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালের চিত্রও ছিল একই। যদিও পুলিশের হিসাবে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান গড়ে ৬ জন


সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে জাতিসংঘের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ সই করেছে। বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব সড়ক পরিবহন, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের। এসব মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, কিছু সড়কের বাঁক সোজা করা এবং মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ছাড়া সরকারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। গত বছর সরকার ১৪৪টি সড়কের বাঁক সোজা করার প্রকল্প নিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গত বছরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ২০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়।


সরকারের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনার হিসেব রাখে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশ গত বছরের হিসাব এখনো চূড়ান্ত করেনি। তবে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ২ হাজার ৪০০ মানুষ মারা গেছেন। এর আগের বছর মারা গিয়েছিলেন ২ হাজার ৬৭ জন। দুর্ঘটনার সংখ্যা গড়ে ২ হাজার।


সম্প্রতি, যাত্রী কল্যাণ সমিতি দেশের ১০টি জাতীয় দৈনিক, ৬টি স্থানীয় সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলসমূহে প্রচারিত সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ পর্যবেক্ষণ শেষে এই প্রতিবেদন তৈরি করে। সংগঠনটির প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১ হাজার ৮০ জন ছাত্রছাত্রী, ৩০৫ জন শিক্ষক, ১৩৩ জন সাংবাদিক, ১০৯ জন চিকিৎসক, ১২৪ জন আইনজীবী, ১০৬ জন প্রকৌশলী, ৫৩৫ জন পরিবহনশ্রমিক, ৪১৯ জন চালক ও ২৮০ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য (পুলিশ, সেনাসদস্য, বিজিবি ও আনসার সদস্য) এবং ২ হাজার ২৪১ জন পথচারী রয়েছেন।

বাস্তব প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায়, পুলিশের কাছে সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে অভিযোগ বা মামলা করেও প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা মেলে না। দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তির পাশে দাঁড়ান না বিত্তবানেরাও। এই অবহেলা-অবজ্ঞার মাঝে দিন দিন বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। বাড়ছে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা, যা মধ্যম আয়ের দেশে যাত্রার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। মেধাবী ও কর্মক্ষম জনসম্পদ হারিয়ে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। বিশষজ্ঞদের মতে, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে প্রতিবছর আলাদা লক্ষ্য ঠিক করে কর্মসূচি নিতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি ধরনের পরিকল্পনা অদ্যাবধি নেয়া হয়নি।।


[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।]

jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক

Related articles