তিনটি কারণে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে থাকবে

তিনটি কারণে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে থাকবে
সৈকত রুশদী: পরিণত, সত্তরোর্ধ বয়সে চলে গেলেন রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। যেকোন স্তরের মানুষের সাথে সহজভাবে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর সহজাত। এই গুণটির কারণে তিনি অসংখ্য মানুষকে আপন করে নিতে পেরেছিলেন। এমনকী প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের সাথেও তাঁর স্বাভাবিক কথা-বার্তার সম্পর্ক কখন ছিন্ন হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আর সাংবাদিকদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল ঈর্ষণীয় রকমের ঘনিষ্ঠ।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়াও যে তিনটি কারণে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে, বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে, স্থায়ী হয়ে থাকবে, তার দু’টি ইতিবাচক। আর একটি নেতিবাচক।

প্রথমত: তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকারী সংসদের অন্যতম সদস্য। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের জোয়ারের মধ্যে তিনি মস্কোপন্থী দল হিসেবে পরিচিত ন্যাপ (মোজাফফর)-এর প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ঐবছর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান অংশের জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে যাঁরা জীবিত ছিলেন ও স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন, তাঁদের নিয়ে বাংলাদেশ গণপরিষদ (Constituent Assembly of Bangladesh) গঠন করা হয়। সেই গণপরিষদের ‘শাসনতন্ত্র কমিটি’র একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য হিসেবে তিনি বাংলাদেশের নতুন সংবিধান প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে এই নতুন সংবিধান পাশ ও কার্যকর হয়। এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

দ্বিতীয়ত: ১৯৭০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে যে কয়টি সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং যে কয়টিতে তিনি প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছেন, একটি বাদে তার সব ক’টিতেই তিনি বিজয়ী হয়ে মোট আটবার (১৯৭০, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১, জুন ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪) জনপ্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর চেয়ে বেশিবার সংসদ সদস্য হওয়ার রেকর্ড বাংলাদেশে আর কারও নেই। সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার সন্তান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার একান্ত অনুরাগী ছিলেন। বর্তমান দশম জাতীয় সংসদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন।

তৃতীয়ত: আওয়ামী লীগের তৃতীয় সরকারে রেল মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ২০১২ সালে তাঁর বাসভবনে আসার সময়ে তাঁর একান্ত সহকারী গাড়িতে নগদ ৭০ লাখ টাকাসহ বিডিআর সদর দফতরে ধরা পড়লে তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মী নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বিরোধী দলের দাবি এবং জনমতের চাপে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেও প্রধানমন্ত্রী তাঁকে দফতর বিহীন মন্ত্রী হিসেবে রেখে দেন। এই ঘটনার অল্প কিছুদিন আগে বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে দুর্নীতির ‘কাল বিড়াল’ তাড়াতে হবে ঘোষণা দিয়ে তিনি আলোচিত হয়েছিলেন। আর দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁকেই ‘কাল বিড়াল’ নামে অভিহিত করা হয়। আমৃত্যু সেই কলংকের বোঝা বয়ে চলতে হয় তাঁকে।

রাষ্ট্রপতি হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদের (১৯৮৬-১৯৮৮) সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব পালনের সময় কোন একদিন আওয়ামী লীগের এই সাংসদের সাথে আমার পরিচয় জাতীয় সংসদ ভবনের লবিতে। সম্ভবত: মেহেরপুর-১-এর আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সহিউদ্দীন-এর সাথে লবিতে আলাপের এক পর্যায়ে তিনি কাছে আসলে নিজের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আমি তাঁর সাথে আলাপ করি। তখন আমি দৈনিক খবর-এর প্রতিবেদক। নিরহংকারী, সৎ ও জনদরদী সহিউদ্দীন ছিলেন আমার ফুপুর স্বামী। তিনি আমার আত্মীয়তার পরিচয় দেননি। তবুও আমার মতো একজন তরুণ সাংবাদিকের সাথে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নিরহংকারী আচরণ আমাকে তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখতে উৎসাহ দিয়েছিল। সংসদ অধিবেশন চলার সময়ে এবং অন্য সময়েও সংবাদের জন্য তাঁর সাথে যোগাযোগ রেখেছি।

সেসময়ে প্রস্তাবিত কোন বিল নিয়ে ব্যাখ্যা ও আলোচনার জন্য দৈনিক ইত্তেফাক-এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শফিকুর রহমান (বর্তমানে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি), জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক স্বপন দাশগুপ্ত (তখন কোন পত্রিকায় ছিলেন আজ আর মনে নেই) ও আরও দু’একজনের সাথে আমি মাঝে মাঝে সেনগুপ্তের সাথে আলাপ করতে যেতাম। তিনি প্রাঞ্জল বাংলায় সহজবোধ্য সব ব্যাখ্যা দিতেন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে। চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেন নির্মোহ ভঙ্গীতে। কোন দলীয় দৃষ্টিকোণ ছাড়াই। দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন আইনের প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে। তাঁর এই ব্যাখ্যা ছিল সংসদীয় রীতি-নীতি এবং আইনের ভাল-মন্দ দু’টি দিকই বিশ্লেষণ শেখায় আগ্রহী তরুণ সাংবাদিক হিসেবে আমার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। আমি বাংলাদেশ টাইমস-এ (১৯৮৭) যোগ দেওয়ার পরও তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। পরবর্তীকালে আমি বাংলাদেশে কানাডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান ও সবশেষে ব্রিটিশ হাই কমিশনে সব মিলিয়ে ১১ বছর রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে কাজের সময়েও কোন আইন বা অধ্যাদেশ নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য যখনই যোগাযোগ করেছি, তিনি সাথে সাথেই সময় দিয়েছেন। কথা বলেছেন দীর্ঘ সময় ধরে। দেখেছি সংসদীয় রাজনীতির প্রতি তাঁর অপরিসীম অনুরাগ ও প্রচেষ্টা।

জনগণের অংশগ্রহণমূলক প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র সমুজ্জ্বল রাখা এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা চালু রাখার লক্ষ্যে আজীবন কাজ করে গেছেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও অন্তত: এই একটি কারণে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকবেন, তাঁর অপর সকল দোষগুণ ছাপিয়ে।
ভাল ও মন্দ মিলিয়েই মানুষ। আজ তাঁর জীবনাবসান হয়েছে। তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।

[সৈকত রুশদী: প্রবাসী সাংবাদিক।।]
টরন্টো, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৭

অতিথি লেখক