ভুল নিয়ে হুলস্থুল

ভুল নিয়ে হুলস্থুল
ছবি: প্রণব মজুমদার।

প্রণব মজুমদার:১৯৯৬ সালের প্রারম্ভিক মাসের মধ্যভাগ। ১ নম্বর রামকৃষ্ণ মিশন রোডে অবস্থিত দৈনিক ইত্তেফাক এর নিউজ সেকশন। বাংলা ভাষা নিয়ে কথা হচ্ছিল সেদিনের শীতের বিকেলে। বক্তা ইত্তেফাক এর শিফ্ট ইনচার্জ সৈয়দ এহিয়া বখ্ত। শ্রোতা হিসেবে ডেস্কের সামনে বসা কবি ত্রিদিব দস্তিদারও। ত্রিদিবদা বললেন, বখ্ত ভাই কি বলে শুনুন! নমস্য প্রবীণ সাংবাদিক সুন্দরতম সুপুরুষ সৈয়দ বখ্ত। পুনরায় বললেন, বাংলা ভাষা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষা হিসেবে একদিন চিহ্নিত হবে। এ কথা শুনে কবি হাসলেন। মনে হলো কবির চেতনায় আশাবাদী বখ্ত সাহেবের এমন ভবিতব্য রেখাপাত করল না। অন্ধকারে আলো! সে কি দুরাশা? পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসন এবং হিন্দি ও উর্দু ভাষার যে প্রয়োগ প্রতিনিয়ত সামাজিক জীবনে দেখেছি,তাতে সে আলোর উৎস কোথায়? বললাম, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ বোধ হয় আমরা দেখে যেতে পারব না। এমন কি আগামী প্রজš§ও। এ ব্যাপারে সৈয়দ এহিয়া বখ্তের দৃঢ় প্রত্যয় পর্যবেক্ষণ করলাম। ত্রিদিবদা আমার বক্তব্যে একমত পোষণ করলেন মনে হলো।
পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা নিয়ে বেশ গবেষণা। বাংলা ভাষা চর্চায় সেখানে রয়েছে বাধা। হিন্দির প্রতাপে বাংলা বর্ণমালা, শব্দ  ও বাংলা ভাষা ওপার বাংলায় তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন! অনেকটা কোনঠাসা বাংলা!
আর এ বাংলায় ?

আকাশ সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির অর্থনীতিতে ইংরেজি হিন্দি ও উর্দু সামাজিকভাবে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারাটা যেন আমাদের গর্বের ব্যাপার। ‘বাংলিশ’ (ইংরেজি ও বাংলা মিশ্রিত) প্রক্রিয়ায় কথা বলা আজকাল আমাদের ফ্যাশনও বটে। বাংলা ভাষা যে বিশে^র অন্যতম প্রধান ভাষা বলে পরিগণিত হবে সে রকম আশান্বিত হবার লক্ষণ দেখছি না ?

আমরা বাঙালিরা বড়ই পরশ্রীকাতর। অনুসরণ নয়, অনুকরণে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু অল্প বিদ্যার অধিকারী আমাদের ‘পা-িত্য’ প্রদর্শনের কমতি নেই। ব্যবহারিক জীবনে আমরা আজও বাংলা শুদ্ধভাবে বলতে শিখিনি। লিখতেও পারছি না। প্রতিদিনই লেখা ও বলায় আমাদের ভুলের সমাহার! এ বাংলার রয়েছে বীরত্বগাঁথা ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর সময়ের বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট সময়জুড়ে বাংলা ভাষা উৎসব পালন করি আমরা। সে ভাষার জন্য আমাদের রক্তঝরা ফালগুন! অথচ প্রতি বছর দিনটি উদ্যাপনে ইংরেজি মাস ও তারিখকেই আমরা প্রাধান্য দিয়েই আসছি! বলছি না ৮ ফালগুন! আটই ফালগুন বা একুশে ফেব্রুয়ারির যে চেতনায় আমাদের বীররা আত্মাহুতি দিয়ে বেদীতে অমর হয়ে আছেন, আমরা উত্তরসূরিরা বাংলা ভাষা চর্চা ও এর ব্যবহারে নিজেদের সঠিক রাখতে পারিনি। ভুলের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত করছি এ ভাষাকে অপমান!

বেশ ক’বছর আগে জনপ্রিয় বিটিভি উপস্থাপক হানিফ সংকেত তাঁর নিয়মিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে আমাদের ভাষাগত ভুলকে চিহ্নিত করতে গিয়ে নিজেই ভুল বাক্য ব্যবহার করেছেন! ওই অনুষ্ঠানে শিশুবিষয়ক পর্বে হানিফ বললেনÑ আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আগামী আর ভবিষ্যৎ শব্দ দুটি কি পরস্পরের সমর্থক নয়? হানিফ ভুল শোধরাতে গিয়ে নিজেই ভুলের আশ্রয় নিলেন। দর্শক অনেকে ভুলটাই জানলেন! যদিও অনুশীলনে শব্দ ও ভাষা পরিশীলিত হয়। কিন্তু বারবার ভুল উচ্চারণ এমন এক উপাদান, তা হোক না কথ্য বা লিখিত ভাষার, সেটা যদি বারবার হতে থাকে তাহলে তা হৃদয়ে প্রোথিত হয়ে যায়। তাই শুদ্ধতার দিকে অধিক যতœবান হওয়া আমাদের জরুরি!

বাংলা ভাষা ও শব্দের ভুল ব্যবহার বহুদিন ধরে চলে আসছে। আমরা অনেকেই বলি অনেকগুলি ও সবগুলি। অনেক বা সব শব্দটাই বহুবচন। সুতরাং গুলির আর প্রয়োজন নেই। তাই হবে অনেক বা সব মানুষ কিংবা মানুষগুলি। তেমনি- বাস্তব সত্যি। বাস্তব এর ভেতর ‘সত্য’ লুকিয়ে আছে। অন্যান্যের মত আমরাও বলি ‘অন্যান্যদের মধ্যে’। ‘অন্যান্য’ মানেই অনেক। সুতরাং ‘দের’ যোগ করা দরকার নেই। অমুকে বক্তব্য রাখেন। এমন বাক্যও প্রায়ই বলছি। যিনি বক্তা তিনি কিন্তু বক্তব্য ধরে রাখেন না। প্রকাশ করেন শ্রোতার কাছে। বক্তব্য রাখেন বাক্যটি শুদ্ধ নয়। পত্র-পত্রিকার সংবাদে আরেকটি বাক্য প্রায়ই চোখে পড়ে। সংবাদপত্রে লেখা হয় শম্বুক গতিতে এগিয়ে চলছে। শম্বুকের গতিতো ধীর! তা এগিয়ে চলে কিভাবে? বলতে হবে কাজের শম্বুক গতি। প্রায়ই আমরা বলছি ভুল শব্দ – কেবলমাত্র বা শুধুমাত্র। সুতরাং কেবল বা শুধুর সঙ্গে ‘মাত্র’ যোগ করার প্রয়োজন নেই।

একটি দৈনিকে পড়লাম সর্বশীর্ষে শব্দের একটি বাক্য। শীর্ষের অর্থ অগ্রভাগ। তাহলে ‘শীর্ষ’ এর আগে ‘সর্ব’ যোগ করার যৌক্তিকতা কোথায়? মৃত্যুর সংবাদে লেখা হয় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন! হৃদযন্ত্র বন্ধ হওয়া ছাড়া কি কেউ মরতে পারে? সঙ্গীত পরিবেশনের উপাদান নয়। অথচ আমরা সবসময়ই বলছি সঙ্গীত পরিবেশনের বাক্যটা। খাদ্য পরিবেশনের উপাদান। কিন্তু সঙ্গীত নয়। বলা উচিত অমুকে গান গেয়ে শোনান। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতও বলছি। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত যদি বলা হয়, তাহলে সমাজে নি¤œাঙ্গ সঙ্গীতও রয়েছে। কোথায় সেটা? তাই উচ্চাঙ্গের পরিবর্তে আমরা ব্যবহার করতে পারি ধ্রুপদ বা ধ্রুপদী শব্দটি। কর্মক্ষেত্রে নির্বাহী কাজে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলছি ! কর্তৃপক্ষ মানেই ঊর্ধ্বতনকে বুঝায়। এর মানে হলো শব্দের দ্বিরুক্তি করা। অফিস-আদালতের বিজ্ঞপ্তি ঘোষণায় এখনো লেখা হয় ‘এতদ্বারা সর্বসাধারণ জনগণদিগকে জানানো যাইতেছে যে ‘সর্বসাধারণ’ আবার ‘জনগণদিগকে’। দিবালোকে মানেই প্রকাশ্য। অথচ গোটা সংবাদপত্রে প্রকাশ্য দিবালোকে এমনটা এখনও বলা হচ্ছে।

দেশের প্রথম শ্রেণীর জাতীয় একটি দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ‘ডাবল’ কলাম খবরের একটি শিরোনাম – ‘আকাশ পথে এয়ারবাস চালু’ । আচ্ছা বলুনতো, বিমান কি আকাশ পথ ছাড়া সড়ক, রেল বা জলপথ দিয়ে চলে কখনো? সে কাগজে উপসম্পাদকীয় কলামে লেখক পরিচিতির স্থানে প্রায়ই দেখি সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব বাক্য। সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এখনও বহাল। চাকুরী থেকে সচিব অবসর নিয়েছেন। তাই সঠিক বাক্য হবে মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব।

নিজে ব্যক্তিগত গাড়ি চালান এমন একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক সেদিন আমাকে বললেন, আপনার গাড়িটা সরাবেন, আমার গাড়িটা পিছনে ‘ব্যাক’ করবো ? ‘ব্যাক’ আবার ‘রিভার্স’ মানে পিছনে! এখানেও দেখুন একই শব্দের একাধিক ব্যবহার। যা বাহুল্য বা বেশি বলা তা বলবো কেন ? অথচ আমরা প্রায়ই বলি বলাবাহুল্য।

ঈদুল-আজহার সময় লেখা ও বলা হয় কোরবানি উপলক্ষে বিরাট গরু ছাগলের হাট। বাক্যটিতে – হাটটি বড় তাই বুঝানো হয়েছে। বলা উচিত গরু ছাগলের বিরাট হাট। তেমনি খাঁটি গরুর দুধের জায়গায় হবে গরুর খাঁটি দুধ। কেননা, ভেজাল দুধেই থাকে বেশি! মিডিয়ায় রাজনৈতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশব্যাপী হরতাল পালিত! সারা মানেই সকল বা সব জায়গায়। আবার দেশব্যাপী! দ্বিরুক্তির আরেক উদাহরণ হলো, অনেক কাগজের খবরে দেখা যায়- হরতালকালীন সময়ে অমুক জায়গায় পুলিশের ধাওয়া বা লাটিপেটা এরকম বাক্য! শুদ্ধ হচ্ছে হরতালের সময় অথবা হরতালকালীন। যে কোনো একটিকে সঙ্গে করে বাক্য বলা বা লেখা উচিত। কয়েক বছর আগে চোখে পড়লো রাজধানীর জিপিও’র সামনে ইসলামী একটি জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশাল সাইনবোর্ড! তাতে লেখা – সফলতার ১২ বছর। অথচ প্রতিষ্ঠানটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিজেকে বীমার প-িত এবং বিশিষ্ট চিন্তাবিদ বলে সকলের কাছে পরিচয় দেন!  সঠিক বাক্যটি হলো – সাফল্যের ১২ বছর!

বাংলা শব্দ বা ভাষার এমন অশুদ্ধ উচ্চারণ আমরা প্রতিদিনই করছি। ই-কার বা ঈ-কারের প্রভেদ এখন আর দেখি না! বাংলা বর্ণের ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় হলো ‘ণ’ আর ‘ন’ এবং ‘শ’ আর ‘স’ ব্যবহারে আমাদের অবাধ স্বাধীনতা! বাংলা বর্ণমালা, শব্দ, বাক্য, ভাষা এবং বাংলার সঙ্গে এ দেশের মানুষের অস্তিত্ব আদিকালের। সংস্কৃতি, ফার্সি, আরবি, উর্দু, হিন্দি, ল্যাটিন ও ইংরেজি ইত্যাদি নানান ভাষার সংমিশ্রণে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধতর হয়েছে।

১৯৫২তে বাংলা ভাষার জন্যে যে বৃহৎ আন্দোলন এদেশে হয়েছিল তা বিশে^ আর দ্বিতীয়টি নেই! এককথায় নজীরবিহীন! বিশে^ ভাষার জন্যে এতো আত্মত্যাগ ও রক্ত বিসর্জন কোনো জাতি দেয়নি। আমাদের সেই সগৌরবের বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমরা পেয়ে গেছি! কিন্তু শুদ্ধভাবে বাংলা বলা এবং লেখার মাধ্যমে কি আমরা নিজ ভূমে ভাষার জন্য আত্মদানকারী শহীদের মর্যাদা ধরে রাখতে পারছি? শুদ্ধাচারের মাধ্যমে তা যদি পারি, তাহলেই সে পূর্বসূরিদের প্রতি আমাদের সত্যিকার শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব হবে! আর পরশ্রীকারতা ও অন্ধ বিশ্বাস বন্ধ হলে সৈয়দ এহিয়া বখ্তের প্রত্যাশার জায়গাটাকে আমরা পূরণ করতে পারবো? বিশ্বাকাশে উদিত হবে উজ্জ্বলতম সোনালি সূর্য। বিশ্বলয়ে তখন বাংলা ভাষা হবে সত্যি অপরাজেয় এবং অপ্রতিরোধ্য এক শক্তি!

[প্রণব মজুমদার: সাহিত্যিক, দৈনিক শিরোনাম (কুমিল্লা)-এর ঢাকা ব্যুরো প্রধান এবং পাক্ষিক অর্থকাগজ এর সম্পাদক]
reporterpranab@gmail.com

অতিথি লেখক