বন্যার আশঙ্কায় রাজধানী

বন্যার আশঙ্কায় রাজধানী

বিশেষ প্রতিনিধি, এসবিডি নিউজ24 ডট কম: নদী ও সমুদ্র থেকে প্রবাহিত অতিরিক্ত পানির প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস যেনো রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য শহর জুড়ে নির্মাণ করা হয় ‘শহর রক্ষা বাঁধ’। কিন্তু বাঁধ নির্মাণ এবং এটি স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখতে যে পরিমান জমি বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে তার অধিকাংশই রয়েছে বেদখলে। আবার সঠিক নজরদারির অভাবে এবং সংস্কার না করায় কোথাও কোথাও বাঁধের মাটি ধসে পড়েছে। ফলে একদিকে বাঁধের জন্য বরাদ্ধকৃত জমি বেদখলে থাকায় এবং অন্যদিকে সংস্কারের অভাবে মাটি ধসে যাওয়ায় বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্ট বেশ ঝুঁকিতে রয়েছে।


এছাড়া রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলে শহর রক্ষা বাঁধের বাস্তবায়ণ হলেও পূর্বাঞ্চলে শহর রক্ষা বাঁধের বাস্তবায়ণ না হওয়ায় সেটি পুরোটাই অরক্ষিত রয়েছে। এটিকে রক্ষায় সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিলো। রাজধানীর পূর্বাঞ্চল রক্ষায় এ ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বাইপাস’ প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন নেই স্থায়ী কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ। ফলে পশ্চিমাঞ্চলে সংস্কারের অভাবে বাঁধ ধসে পড়া ও বরাদ্দকৃত জমি বেদখলে থাকা এবং পূর্বাঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের বাস্তবায়ণ না হওয়ায় যেকোনো সময় রাজধানী ঢাকা খুব সহজেই বন্যার কবলে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।


রাজধানীকে বন্যা থেকে রক্ষা করার জন্য বাঁধ নির্মাণের কথা বলা হলেও ঢাকার অর্ধেকেরও বেশি এলাকা এখনও অরক্ষিত। রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলে ১৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করায় রাজধানী কিছুটা সুরক্ষিত মনে হলেও পূর্বাঞ্চলের ১২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ না করায় সেটি ততটাই অরক্ষিত। ফলে এ অঞ্চল দিয়ে বন্যার পানি অনায়াসে ঢাকায় ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।


সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত হয় রাজধানী ঢাকা। এরপর বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠার পর ঢাকা রক্ষায় বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। সেই উদ্যোগের ফলে মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছনের অংশ থেকে থেকে রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলের নবাবগঞ্জ, হাজারিবাগ, গাবতলী, মিরপুর হয়ে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত শহর রক্ষা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এর ফলে ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা হলেও রাজধানীতে বন্যার পানি প্রবেশ করতে পারেনি। কিন্তু সংস্কারের অভাবে নবাবগঞ্জের ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কাশিয়াখালী বেড়িবাঁধসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মাটি ধসে গেছে। এতে পুরো বাঁধ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। যেকোনো সময় অতিবৃষ্টি ও জলোচ্ছাসের কবলে পড়ে পুরোপুরি ধসে পড়বে এসব বাঁধ।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণে রাজধানীতে সর্বমোট ৬৪২ দশমিক ২০ একর জমি অধিগ্রহন করা হয়। এর মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে ৪৬৩ দশমিক ৭০ একর। আর অব্যবহৃত থেকে যায় ১৭৮ দশমিক ৫০ একর। অবশিষ্ট অধিগ্রহণকৃত জমির অধিকাংশই অবৈধ দখলদারদের কবলে। অবশ্যই সেটি উদ্ধারে সরকার তৎপর রয়েছে বলে জানিয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়।


সম্প্রতি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে একটি কার্যবিবরণী তুলে ধরা হয়। ওই বিবরণী থেকে জানা গেছে, এক হাজার ৮১ জন অবৈধ দখলদারের তালিকা জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে। ওই বৈঠকে বেদখল হওয়া এসব জমি দ্রুত উদ্ধারে অভিযান শুরুর তাগিদও দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে বাঁধের জমি রক্ষণাবেক্ষণে একটি পৃথক কমিটি গঠনেরও পরামর্শ দেন তারা। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনও বাস্তবায়িত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। চলতি বছরের ২১ জুলাই ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জের কাশিয়াখালীতে শহর রক্ষা বাঁধের সোনাবাজু বাজার অংশে ঢাকা রক্ষা বাঁধ সংস্কার ও স্লুইস গেট নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন ও ক্যাম্পেইন করেছে এলাকাবাসী। তাদের অভিযোগ, ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম নদী ভাঙন ও বন্যা থেকে রক্ষার জন্য নির্মিত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কাশিয়াখালী বেড়িবাঁধের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মাটি ধসে গেছে। টানা বৃষ্টি ও পদ্মার পানির চাপে বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন এলাকাবাসী।


অন্যদিকে, ষাটের দশকে নির্মাণ করা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) বাঁধের কারণে ১৯৮৮ সালের বন্যায় যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, সিদ্ধিরগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, চাষাড়া, ফতুল্লা ও পাগলার বিশাল এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। বর্তমানেও প্রায় সারাবছর এই এলাকা পানিতে তলিয়ে থাকে। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এই বাঁধকে ঘিরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘ঢাকা পূর্বাঞ্চলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বাইপাস’ নামে প্রকল্পের পরিকল্পনা করে। কিন্তু ২০০৫ সালের দিকে বিএনপি সরকারের সময়ে অর্থ না পাওয়ার অজুহাতে সেই প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায়। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার তিনশ ফিট সড়কটি নির্মাণ করে। বর্তমানে পুরো এলাকা অরক্ষিত থাকায় পূর্বাচল উপ-শহর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিশেষ প্রতিনিধি