প্রিয় ফেব্রুয়ারি, তুমি কি কালো মাস হয়েই রইবে?

প্রিয় ফেব্রুয়ারি, তুমি কি কালো মাস হয়েই রইবে?
ছবি: সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ।

সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ: ঠিক দশ বছর আগের কথা। অল্প পানির মাছ তখন গভীর পানিতে পড়ে গেছি। হেসে খেলে তালিতাপ্পা মারা জিন্সের প্যান্ট পরে  ইউনিভার্সিটি জীবন প্রায় কাটিয়ে দিয়েছি। শেষের লগ্নে ইন্টার্ন শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে হলো পিলখানার বিডিআর স্কুলে। আদর্শ শিক্ষকের পোশাক হিসেবে এলিফ্যান্ট রোড থেকে এক জোড়া ফরমাল প্যান্ট বানালাম। এক জোড়া শার্ট।


ভার্সিটি জীবনে শিখে এসেছিলাম- শিক্ষার্থীদের পড়াতে হবে আনন্দের সাথে, মমতা নিয়ে। শিক্ষার্থী নিজেই শিখবে, শিক্ষক তাকে পথ দেখাবেন মাত্র। প্রথম ক্লাসে পাড়া দিয়েই বাস্তবতা টের পেলাম। মমতা-ফমতা সব বাজে কথা। ক্লাসের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করতে হবে। ত্রাস সৃষ্টিতে ইন্টার্ন টিচারদের সামান্যতম দুর্বলতা  পেলেই শিক্ষার্থীরা ঘাড়ে উঠবে। আর কীসের পাশে থেকে পথ দেখানো? হিটলারের মতোন ডিক্টেটর হিসেবে ঘাড়ে ধরে পড়াতে হবে। নাহলে এদের মানুষ করার উপায় নাই!


তৃতীয় দিন নবম শ্রেণীতে ক্লাস নিতে গেছি। ছেলেদের ক্লাস। ত্রিকোণমিতির একটা জটিল ক্লাস। এক ছেলে হাউমাউ করে ছুটে এসেছে। কী ব্যাপার? পেছনে বসা ছেলে কোত্থেকে এক মার্কার যোগাড় করেছে। তারপর তার ইউনিফর্মের পিছে বড় করে SEX লিখে দিয়েছে! এখন কী উপায়?


ঘটনা দেখে আমার গা দুলিয়ে হাসি এলো। অনেক কষ্টে ঠেকালাম। হাসলেই আমার ক্যারিয়ার শেষ। অপশন এক হলো প্রচণ্ড ধমক দেয়া। লঘু দণ্ড, বাদ। অপশন দুই, হাতের স্কেল দিয়ে কয়েকটা বাড়ি দেয়া। বেত্রাঘাতে নিষেধাজ্ঞা আছে, বাদ। তখন অপশন থ্রি মাথায় এলো। ছেলে দুটার সাইজ তো একই রকম। বললাম- দুইজন শার্ট চেইঞ্জ করো!


আসামী পুরো বজ্রাহত! আমাকে মিনমিনিয়ে বললো- আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবে স্যার! আমি বললাম- বের করে দিলে আমার বাসায় চলে এসো। নো প্রবলেম। স্যারের প্রতিভায় পুরো ক্লাস মুগ্ধ, আমি নিজেও মুগ্ধ! এইভাবে আস্তে আস্তে পিচ্চিগুলো কখন যে আপন হয়ে গেলো টেরই পেলাম না।


চব্বিশে ফেব্রুয়ারি ছুটির পর বের হয়েছি। আগামীকাল বিডিআর কুচকাওয়াজ। প্রধানমন্ত্রী এসে সালাম গ্রহণ করবেন। সারা পিলখানা জুড়ে তার তোড়জোড় চলছে। কী সুশৃঙ্খল একেকটা বাহিনী! কী নয়ন জুড়ানো একেকটা ভেন্যু! হাটতে হাটতেই পুরো পিলখানা চষে ফেললাম। কী যে সুন্দর দেখতে এই মিনি ক্যান্টনমেন্ট। কে জানতো, এই সুন্দরের মাঝেই তখন দানা বাধছে চরম এক অসুন্দরের প্রস্তুতি?


পরেরদিন আমার ঈদের দিন। স্কুল ছুটি। বিডিআর কুচকাওয়াজ। নাস্তা করে জিগাতলার বাসা থেকে বের হয়েছি। চারদিকে গুলির আওয়াজ! হওয়াটাই স্বাভাবিক। গতকাল যে প্রস্তুতি দেখলাম কুচকাওয়াজের, এইটুক গুলি-পটকা তো ফাটবেই!


জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডের মোড়ে এসে মনে হলো ঘটনা কিছু একটা হয়েছে। গেটের সামনে সশস্ত্র সব সৈন্য, গেটের বাইরে কবরের শুনশান। ভেতরে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে! হচ্ছেটা আসলে কী? এরমধ্যে পুলিশ কিছু জড়ো হয়েছে। আমাদের দিকে হাক দিলো- পালান…আমরা পালানো শুরু করলাম। গেটের বাইরেও গুলির ছাট এসে পড়ছে।


বিকেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। আমার তখন একেবারেই তরুণ বয়স। ভীষণ একটা অভিমানে বুক ফেটে আসছিলো। এতো সুন্দর একটা জায়গায় এখন নারকীয়তা চলছে? কীসের জন্য? কীসের আশায়?


বাতাসে গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। শত শত লাশ ছড়িয়ে পড়ে আছে পিলখানায়। কাদের লাশ? ভিতরে কারা ঢুকে পড়েছে? সন্ধ্যেবেলায় দেখা গেলো দলেবলে লোক বাসা ছাড়ছে। আর্মি নাকি আসছে। যুদ্ধ বাধবে যে কোন সময়! বাসা ছাড়াটাই উত্তম! আমরা সদলবলে বাসা ত্যাগ করলাম। আম্মার কিছু গয়না ছিলো বাসায়, পুটলিতে বেধে নেয়া হলো। যুদ্ধাবস্থায় বাসার কী হয় ঠিক নেই।


আমরা গিয়ে উঠলাম যাত্রাবাড়িতে খালার বাসায়। ছোটভাইকে বলছিলাম- যুদ্ধের সময়, দুর্যোগের সময় লঙ্গরখানা খোলা হয়। তাতে খিচুড়ি খেয়ে খেয়ে পেটে চর পড়ে যায়। আমরা তো সেই তুলনায় ভালো আছি। রাত্রিবেলা পরিবেশন করা হলো খিচুড়ি! আমরা দুই ভাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। অবশ্যই লঙ্গরখানার খিচুড়ি না, তবে ইন্সিডেন্টটা মিলে গেলো! প্রকৃতির ব্ল্যাক হিউমার?


৫৭ জন সামরিক অফিসারের প্রাণ ঝরে গেলো, মারা গেলেন সবমিলিয়ে ৭৮ জন। অফিসারদের পরিবারের লোকজনের ওপর চালানো হলো অবর্ণনীয় অত্যাচার। সারাদেশের অনেক বিডিআর ক্যাম্প থেকেই রিভোল্টের খবর আসতে লাগলো। উৎকণ্ঠার এক কালো রাত!


পরেরদিন আর্মি ঢুকে দখল নিলো পিলখানার। ছয়হাজার সেনা বন্দী হলো। সামরিক আদালত বসলো। ১২০ জনের ফাঁসীর আদেশ হলো। যাবজ্জীবন হলো আরও অনেকের। আমাদের স্কুল বন্ধ রইলো তিন মাসেরও বেশি। লাভটা হলো আসলে কার?


প্রিয় ফেব্রুয়ারি, তুমি কি ঠিক করেছো একটা কালো মাসই হয়ে রইবে বছর বছর?


{লেখক: প্রাবন্ধিক।}
[লেখাটি লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত।]

অতিথি লেখক