একজন সংবাদ বীরের জীবনযুদ্ধ ও মিনার মাহমুদ

একজন সংবাদ বীরের জীবনযুদ্ধ ও মিনার মাহমুদ

মোমিন মেহেদীঃ

‘‘আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি,  তোমার মতো মেয়ে হয় না। কিন্তু আমি বাঁচতে পারলাম না। অনেকবার চেষ্টা করেছি আত্মহত্যা করার, তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে করতে পারিনি। সর্বশেষ তোমার অগোচরে চলে এসেছি। আমার কাছে মাত্র ৪ হাজার টাকা আছে। কোন সহায়সম্পত্তি নেই। কি করে আমি বাঁচবো? সবাই নতুন করে বাঁচতে চায়, কিন্তু আমি পারলাম না। ১৮ বছরের দাসত্বের জীবন শেষ করে নতুন আশা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলাম। অনেক চেষ্টা করেছিলাম নতুন পত্রিকায় যোগ দিতে, কেউ আমাকে নিতে চায়নি। সবাই চায় নতুন আর নতুন। আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম। এ মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। সুখে  থেকো, ভাল থেকো। আমাকে ক্ষমা করে দিও।’’ এই কথাগুলো সাংবাদিক মিনার মাহমুদের লেখা শেষ চিঠির অংশ বিশেষ। বিশেষ এই অংশে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ভালোবাসার আবহ। যে আবহ আমাদেরকে দ্বায়বদ্ধ করে তুলছে প্রতিনিয়ত। তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী মূলত আমাদের ঘূণে ধরা সমাজ-সরকার আর অর্থনীতি। যা দূর্নীতির অন্ধকারে ক্রমশ মলিন হয়ে উঠছে। অন্ধকারময় সময়ের সাথে সাথে আমরা হারিয়েছি আমাদের একজন আলোকিত মনের মানুষ সাংবাদিক মিনার মাহমুদকে। যাকে আ জবড় বেশি প্রয়োজন ছিল আমার-আমাদের। অতিসম্প্রতি তিনি আমার ঢাকা দÿÿণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বলেছিলেন, ‘একজন লেখক আর যাইহোক অন্যায় করতে পারে না; আপনিও পারবেন না। অতএব বিজয়ী হোন বা না হোন তা নিয়ে কোন আÿÿপ নেই। মানুষতো জানবে যে একজন ভালো মানুষ মঙ্গল করার চেতনা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল।’

কথাগুলো কানে বাজছে প্রতিনিয়ত। সাংবাদিকতার সতত মানুষ মিনার মাহমুদ। আপনি আমার দৃষ্টি কোণ থেকে ছিলেন একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ। যে কারণে কোন অন্যায় করতে পারেননি, আপোষ করেননি কোন অন্যায়ের সাথে। যেকারণে ‘বিচিমত্মা’ বন্ধ হয়ে গেলো; বন্ধ হলো আপনার মত একজন স্বপ্নময় মানুষের জীবন চাকাও। আজকের এই মূহুর্তে অনেক কথাই মনে পড়ছে। মনে পড়ছে যখন দ্বিতীয়বার বিচিমত্মা বাজারে এলো, আমি লেখা পাঠালে একটি সংখ্যায় কভার স্টোরি হিসেবে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হলে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য ফোন দিলে বলেছিলেন, এটা হচ্ছে এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ। এগিয়ে যান, আপনার মত তরম্নণদের জন্য বাংলাদেশ বসে আছে প্রতিÿায়।’ আপনার এমন মৃত্যুর পর বড় জানতে ইচ্ছে করছে, আসলেই কি তাই? তাহলে আপনি  চলে গেলেন কেন  দৈনতার আঘাতে জর্জরিত হয়ে? প্রশ্নের পর প্রশ্ন যখন মনের ঘরে তখন চোখে পড়লো-‘চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন মিনার মাহমুদ’ আমার সাংবাদিকতা শুরম্ন বিচিমত্মায়। এর আগে টুকটাক কাজ করলেও সেগুলো ছিল নিতামত্ম দায়সারা গোছের। মিনার ভাইয়ের সঙ্গে সাপ্তাহিক বিচিত্রা অফিসে প্রথম পরিচয়। তারপর থেকে যোগাযোগ ছিল সব সময়। ১৯৮৭ সালের প্রথম দিকে বিচিত্রা ছেড়ে দেন বিচিন্তা বের করবেন বলে। বিচিত্রা ছাড়ার পর তার মন খুব  খারাপ ছিল। সেদিন বিকালে মিনার ভাই পার্লামেন্টের পেছনের লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন তিনি। বললেন, চলেন আমরা কোথাও গিয়ে বসি। তার মোটরসাইকেলে চড়ে শেরাটনে এলাম। ঘণ্টা দুই গল্প করলাম আমরা। তিনি আমাকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করার কথা বললেন, কিন্তু কি নাম হবে বললেন না ।

সিদ্ধান্ত হলো পত্রিকা বের হওয়ার প্রথম দিন থেকে আমি তার সঙ্গে কাজ করবো। মূলত সেদিন থেকে আমাদের কাজ শুরু হয়ে যায়। এরপর আমি নিয়মিত ফোন করতাম তাকে। এক মাস পর তিনি আমাকে দেখা করতে বললেন। দিলু রোডের একটা বাড়িতে অফিস নেয়া হলো। সেখানে আমাকে সাংবাদিক ফজলুল বারীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতাম। সে সময় ছাত্র সংঘর্ষে ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যায়। তিনি জানতেন ঢাকায় আমার কেউ নেই। আমি কোথায় থাকবো ঠিক ভাবতে পারছিলাম না। তিনি একটা কাজে ফরিদপুর ছিলেন। ফরিদপুর থেকে বারীকে বললেন, আমাকে অফিসে থাকতে দেয়ার জন্য। সেই থেকে আমি ও ফজলুল বারী অফিসেই থাকতাম। প্রথম কয়েকটা সংখ্যা দিয়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে বিচিন্তা। সম্ভবত ডিসেম্বরের দিকে বের হওয়ার তিন মাসের মাথায় পত্রিকাটি সরকারের রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। মিনার ভাইকে জেলে নেয়া হয়। তাকে মুক্ত করার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর।

মিনার ভাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমাদের দু’জনের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক ছিল। আমি প্রবাসী হওয়ার পর যতবার ঢাকায় এসেছি তার সঙ্গে দেখা করেছি। তার সঙ্গে গত নভেম্বরে গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে আমার শেষ দেখা হয়। আমরা দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দেই। তিনি কিছু সাংবাদিকের আচরণ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ  করেন।  আমাকে মন খারাপ করে বললেন বিচিন্তা বন্ধ করে দিলাম। আমি তাকে বললাম ভাল করেছেন। এ মাসের ২৪ তারিখ আমি তাকে এসএমএস পাঠাই- আমি ঢাকায় আছি। তিনি ওয়েলকাম ইন  হোমল্যান্ড রিপস্নাই দেন। একটু অবসর হলেই দু’জন দেখা করতাম। আবার আড্ডায় মাততাম। এর আগেই চলে  গেলেন পরপারে। আমরা সংকীর্ণ মানুষ বেঁচে থাকতে তোমায় ভুলে গেলেও এ দেশের মাটি কোনদিন ভুলবে না। এ দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে মিনার মাহমুদ নামটি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে । সরোজ মেহেদী’র অনুলিখনের এই লেখাটিতে আনোয়ার শাহাদাত যেভাবে তাঁর মনের মায়াবী পর্দা দুলিয়েছেন ঠিক সেভাবে আমিও স্মৃতির আয়নায় মুখ রেখে খুঁজেছি আমার প্রিয় সম্পাদকদের একজন মিনার মাহমুদের মুখ। বিচিন্তা ও মিনার মাহমুদ : ৫০ বছর বয়সী মিনারের জন্ম ফরিদপুর শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের এই ছাত্র আশির দশকের মাঝামাঝি সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় লেখালেখির মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা জগতে পা রাখেন। বানিশান্তার পতিতাপল­x নিয়ে তার একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হয়েছিল বিচিত্রায়। এই প্রতিবেদন পড়ে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ মিনার মাহমুদকে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে খুলনার বানিশান্তা পল­xতে যান।

 এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনামলে ১৯৮৭ সালের ১০ জুন মিনারের সম্পাদনায় প্রকাশ হয় সাপ্তাহিক বিচিন্তা। সামরিক শাসনবিরোধী লেখালেখির কারণে ’৮৮ সালের জানুয়ারিতে তিনি গ্রেফতার হলে সাপ্তাহিকটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।

 ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতন হলে ১৯৯১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আবারও প্রকাশ হয় বিচিন্তা। কিন্তু সে বছরই প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়ে তিনি আমেরিকা চলে যান।

 দীর্ঘ ১৮ বছর পর ২০০৯ সালে তিনি দেশে ফেরেন। জানা গেছে, এই দীর্ঘ সময়ে তিনি একবারের জন্যও দেশে আসেননি। ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর থেকে তিনি আবারও বিচিন্তার প্রকাশনা শুরু করেন।

 গত বছরের মার্চ মাসে তার মস্তিষ্কে একটি বড় ধরনের অস্ত্রোপচার হয়। এরপর চিকিত্সকের পরামর্শে তিনি পূর্ণ বিশ্রামে ছিলেন। ওই সময় থেকেই বন্ধ থাকে বিচিন্তার তৃতীয় দফা প্রকাশনা।

 আশির দশকে তিনি বিয়ে করেন নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে। তখন মিনার মাহমুদ ছিলেন তসলিমা নাসরিনের তৃতীয় স্বামী। কিন্তু সে বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। দু’জনের বিয়ে বিচ্ছেদের পর মিনার আমেরিকা প্রবাসী হলে সেখানে এক বাংলাদেশী মেয়েকে বিয়ে করেন। কিন্তু সে বিয়েও টেকেনি। তার সর্বশেষ স্ত্রী উত্তরায় বসবাস করছেন। আমার প্রিয়জ এই সাংবাদিক দ্বিতীয় দফায় যখন জীবনযুদ্ধে নেমেছিলেন ‘বিচিমত্মা’ নিয়ে; তখন আমার রঙধনুময় লেখাসময় এগিয়ে চলছিল জলজ নেশায়। আর এই নেশায় এগিয়ে চলতে চলতে গড়ে তুলেছিলাম ‘বিচিমত্মা’র সাথে সখ্যতা; সখ্যতা তাঁর সাথেও। যতবার কথা হয়েছে; বলেছেন, লিখে যেতে হবে বাংলাদেশের জন্য, মানুষের জন্য।’ যুদ্ধময় জীবনে তার এই উৎসাহ হয়ে এসেছিল আশির্বাদ আমার। তাঁর সম্পর্কে সকালের মত আলোকিত তথ্য জানতে পেরেছিলাম অনেক আগেই। সেখানে সাংবাদিক মিনার মাহমুদ বিশ্বের আলোচিত লেখক তসলিমা নাসরিনের স্বামী ছিলেন, যতটা গুরম্নত্বপূর্ণ; তাঁর চেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ তিনি সাহসী সাংবাদিক ছিলেন। আপোষ করেননি কখনো। আপোষ আমরাও করবো না। হয়তো বিজয় নয়তো মৃত্যুকেই সাথী করে গেয়ে উঠবো বিজয়ের গান। অনেকটা সেই বীরদের মত যারা দেশের জন্য জীবন  দিয়েছে শত্রম্নর সাথে যুদ্ধ করতে করতে…

মোমিন মেহেদী : কলাম লেখক ও সংগঠক email: mominmahadi@gmail.com

বিভাগীয় প্রধান

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।