‘বাংলাদেশ ফিমেল একাডেমী’ এবং একজন স্বপ্নের কারিগর জামিলুর রেজা চৌধুরী

‘বাংলাদেশ ফিমেল একাডেমী’ এবং একজন স্বপ্নের কারিগর জামিলুর রেজা চৌধুরী

 

জালালউদ্দিন সাগরঃ জামিল, পুরো নাম জামিল বিন খলিল, শৈশবের বন্ধু। মেধাবী একজন ছেলে। পরন্ত বিকেলে রূপালী রোদ গায়ে মেখে জীবনের ২৫ বছর কাটিয়েছি এক সাথে। কত স্বপ্নের বীজ বুনেছি কর্ণফুলীর পারে ! কর্ণফুলীর জলে ভেসে যাওয়া কত স্বপ্নকে জড়ো করেছি দু’হাতে। আজ সে সব স্বপ্ন, কেবলই স্বপ্ন। জীবনের ধুসর পান্ডুলিপির চমৎকার লেহন মাত্র। ইচ্ছে ছিলো দুজন মিলে শিশুদের জন্য একটি স্বর্গরাজ্য গড়বো। আমাদের স্বর্গরাজ্য হবে অসহায়, দরিদ্র,অবহেলীত শিশুদের নিরাপদ অভয়ারণ্য। ইচ্ছেটা এখনো আছে, কিন্তু ইচ্ছে আর স্বপ্নের মধ্যে যোজন যোজন ফাঁরাক।

সিলেটের জেলা পুলিশ সুপার, সাখাওয়াত হোসাইন। মৃদুভাষি, সাংস্কৃতিকমনা এ মানুষটির সাথে পরিচয় মাত্র কয়েক দিনের। হাস্যজ্জল চমৎকার একজন মানুষ তিনি। এক কথায় সাদামনের মানুষ। একজন পুলিশ কখনো যে একজন সাদা মনের মানুষ হতে পারে আমার জানা ছিলো না।

বেশ কিছুদিন আগে আমি একটি ঝামেলায় জড়িয়ে ছিলাম। পুলিশি ঝামেলা। সে ঝামেলা থেকে সহজে পার পাওয়ার জন্য আমার এক পুলিশ বন্ধুকে ফোন করেছিলাম সেদিন। সব ঘটনা শুনে আমার পুলিশ বন্ধু আমাকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলো,‘ If u get something from police, Think that u r good lucked, normally public don’t get help from police, may Allah help u.’  অথচ আমার ওই বন্ধুর কথার সাথে এই মানুষটির কোন মিল খুঁজে পেলাম না আমি।

মার্চ ২০১২ এর মাঝামাঝি সিলেট গিয়েছিলাম। সাংবাদিক সি এম মারুফ এর স্মরণ সভায়। তখনই এসপি সাখাওয়াত ভাইয়ের সাথে দেখা। ‘সাগর সাহেব চলেন, আপনাকে নিয়ে এক জায়গায় যাবো,ভালো লাগবে।’ আমি বললাম কোথায় ? তিনি বললেন,‘ চোরের গ্রাম।’ সুনামগঞ্জের ধেরাজ এ ।

আমার কাছে সিলেট শহরটাকে মরুভুমি মনে হয়। শুধু শহর না  আশে পাশের সব জায়গা। এত জমি, অথচ চাষাবাদ নেই কোথাও। সিলেটের অধিকাংশ জমি পতিত,অনাবাদি। মন খারাপ হবার মত অবস্থা।

গাড়ী চলছে ধেরাজের উদ্ব্যেশে। আমাদের সহযাত্রী এএসপি মাহমুদা বেগম সোনিয়া।

রাস্তার পাশে একজন লোক দাঁড়িয়ে । সাদা পোষাক , হাতে সাদা ছড়ি, চোঁখে কালো চসমা। সাখাওয়াত ভাই গাড়ী থেকে নেমে যত্নকরে ওই লোকটিকে গাড়ীতে উঠালেন। গাড়ী আবার চলতে শুরু করলো। উদ্দেশ্য ‘চোরের গ্রাম’।

আশ্চর্য, হঠাৎ করে বদলে গেলো সব। আশে পাশের পরিবেশ। মুরুভুমির যে চিত্র দেখে দেখে এতক্ষণ ক্লান্ত হয়ে উঠছিলাম সে মুরুভুমির হঠাৎ উধাও। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। সাখাওয়াত ভাই বললেন, ‘সাগর সাহেব, এখান থেকে সুনামগঞ্জ শুরু।’

রাস্তার দু’ধারে সারি সারি গাছ। মাঠে সবুজ ধানের ছড়া ছড়ি। পাশে বসা সাদা পোষাক আর কালো চসমা পড়া ভদ্রলোক  আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। গাড়ী থামাতে বললেন ড্রাইভারকে। রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এই যে ভাই, এই বৃক্ষ গুলি লাগিয়েছে কে, আপনি জানেন? পথিক জবাব দিলেন, ‘ জামিলুর রেজা সাব’।

সাখাওয়াত ভাই বললেন, ‘রাস্তার পাশে এই যে হাজার হাজার গাছ দেখছেন, গাছ গুলো সব ওনার লাগানো। উনি হলেন,‘ জামিলুর রেজা চৌধুরী।

চৌধুরী সাহেব বলেলন, চোরের গ্রাম দেখার আগে  আমার একটি স্বপ্ন দেখাবো আপনাদের। আমি বললাম, আপনার স্বপ্ন, আমাদের দেখাবেন ! এওকি সম্ভব ?

হঠাৎ কারে গাড়ীর বাক ঘুরে গেলো। রাস্তার ঠিক পাশে গেইটে, বড় হরফে লিখা ‘বংলাদেশ ফিমেল একাডেমী’। জামিলুর রেজা চৌধুরীর স্বপ্ন।

৭ একর জায়গা জুড়ে ২০০৬ সালের ১লা এপ্রিল এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন তিনি। অনাথ,দুস্থ্য, অবহেলীত মেয়েদের জন্য সম্পূর্ণ ব্যাক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা তার এ প্রতিষ্ঠান পেরিয়েছে অর্ধযুগ। প্রথম শ্রেনী থেকে মাষ্টর্স। কৃষি থেকে আইটি, সব ধরণের শিক্ষার সুযোগ রয়েছে এখানে, বিনে পয়সায়। রয়েছে থাকা খাওয়ার সুবিধা। প্রতি বছর ২৫-৩০ জন অনাথ মেয়ের আশ্রয় হয় এ একাডেমীতে। মা-বাবা ছাড়া, আত্মীয় স্বজন ছাড়া, রাস্তায় বেড়ে ওঠা অনাথ শিশুদের ঠাই হয় এখানে।

২০০৬ সালে গড়ে উঠা এ একাডেমীতে এখন আশ্রিতার সংখ্যা ১৭৬ জন। এ বছর এসএসসি পরিক্ষায় অংশ নিয়েছে এ একাডেমীর ১৬ জন মেয়ে। বাংলাদেশ মহিলা একাডেমীর কর্ণধার জামিলুর রেজা চৌধুরী অত্যন্ত আশাবাদি, এসএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস কিংবা জিপিএ ৫ নিয়ে পাশ করবে তার মেয়েরা। যারা ভালো ফলাফল করবে তাদের যায়গা হবে লন্ডনে। স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি করাবেন ভালো কোন কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে। এ ব্যাপারে লন্ডনের কয়েকটি কলেজ ইউনিভারসিটির সাথে ইতুমধ্যে যোগাযোগ করছেন তিনি। ১৭৬ জন ছাত্রীর জন্য শিক্ষক, এটেন্ডেন্ট, আয়া সহ কর্মচারী সংখ্যা ২২ জন।

২০০৬ সাল থেকে জাতীয় প্যারেড গ্রাইন্ডে অনুষ্টিত স্বাধীনতা দিবসের জাতীয় প্যারেড এ অংশ নেয় এ একাডেমীর ছাত্রীরা। পুরুস্কারও পেয়েছে একাধীকবার। আর এবার হয়েছেন ৩য়। তাদের এ অর্জনে গর্ববোধ করেন সিলেটের সাধারণ মানুষ।

জামিলুর রেজা বলেন, ‘ বাংলাদেশ সমাজ কল্যান মন্ত্রনালয় থেকে প্রতি বছর এ একাডেমীর জন্য বরাদ্দ হয় ৪ লক্ষ ( প্রায় ) টাকা। সেই সাথে আমার এক পারিবারিক আত্মীয় প্রতিবছর অনুদান দেন ১০ লক্ষ টাকা। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটি চালাতে বৎসরে প্রয়োজন  প্রায় ১ কোটি টাকা।

আমার এক প্রশ্নের জবাবে জামিলুর রেজা বলেন, সম্পূর্ণ ব্যাক্তি উদ্যোগে এ ধরণের একটি প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাওয়া  কষ্টের। তিনি বলেন, ‘আমি একটি বৃক্ষ রোপন করেছি মাত্র, সে বৃক্ষকে পানি দিয়ে, যত্ন করে লালন করা আপনার, আমার সবার দায়ীত্ব। সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে সবার। মুঠো মুঠো চাল দিয়ে যেমন গোলা ভরে উঠে ঠিক তেমনি অল্প অল্প করে এগিয়ে আসতে হবে সবার।

১৭৬ জন মেয়েকে একবেলা খাওযানো কিংবা একটি করে কাপড় দেয়া হয়তো খুব কঠিন কিছু না। আমাদের দেশে সামর্থবান এমন অনেকেই আছেন যাদের ‘ ইচ্ছে’র কাছে অনেক কঠিন কাজ সহজ হয়ে যায়। জামিলুর রেজা চৌধুরী আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। এই অবহেলীত, অনাথ, দরিদ্র মেয়েদের নিয়ে কিছু লিখার জন্য। তার অনুরোধটি এখনো আমার বুকের একপাশে গেঁথে আছে। তিনি বলেছিলেন, সাগর সাহেব দয়াকরে আমার মেয়েদের জন্য কিছূ লিখবেন। আপনার দু’কলম লিখা যদি একটি মেয়ের মুখে একবেলার অন্য দিতে পারে তাতেই আমি কৃতজ্ঞ। অনেক চেষ্টা করেও চৌধুরী সাহেবকে বোঝাতে পারিনি, আমি প্রখ্যাত কোন লেখক না। আমার লেখার কোন প্রভাব পরবেনা এ সমাজে।

স্বপ্নবান মানুষ গুলো খুব বেশী আশাবাদি হয়। তিনি আশা করে  আছেন, আমি তার মেযেদের জন্য কিছু লিখবো। আমি লিখলাম। কিছুটা দ্বায় এবং দায়ীত্ব্য থেকে।

একাডেমীর ছাত্রীদের অপূর্ব ক্রীড়া শৈলী দেখে মুগ্ধ হয়ে সিলেট জেলা পুলিশ সুপার শাখাওয়াত হোসাইন বলেন, ‘অদম্য ইচ্ছে শক্তির কাছে কোন কিছুই যে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা, তার প্রজ্জ্বলন্ত উদাহরণ এ একাডেমীর ছাত্রীরা।’ সমাজে ঝরে পড়া এ সব অবহেলীত মেয়েদের জন্য জামিলুর রেজা চৌধুরীর এ উদ্যোগকে স্বগত জানান তিনি।

একজন জামিল, একজন সাখাওয়াত হোসাইন আর একজন জামিলুর রেজা চৌধূরী, এ তিনের মধ্যে কোথাও যেনো অদ্ভুদ একটি মিল খুঁজে পাই আমি।

একজন জামিল স্বপ্ন দেখেন, একজন সাখাওয়াত হোসাইন আন্ধকারের দ্বিপ শিখা হয়ে আলোর পথ দেখান । আর একজন জামিলুর রেজা চৌধুরী সে স্বপ্নকে    বাস্তবে রূপ দেয়ার অদম্য নেশায় মত্ত্ব। যেনো একটি ত্রিভুজ প্রেমের গল্প।  এ প্রান্ত মিলেছে ও প্রান্তের সাথে। একজনের স্বপ্ন ছুঁয়েছে অন্যজনের স্বপ্নকে।

এ সব স্বপ্ন বিলাসী মানুষ গুলোর স্বপ্ন আছে বলেই আমরা যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করি, বিশ্বাস করি, স্বর্গের দড়জা খুলবে একদিন।

চোরের গ্রাম দেখার যে র্দূদান্ত ইচ্ছে ছিলো আমার। সে ইচ্ছেটা হঠাৎ করে হারিয়ে গেলো অনন্তে, স্বপ্নবান কিছু মানুষের ইচ্ছের কাছে পরাজিত হলো আমার সে কৌতুহল।

ধেরাজ থেকে যখন ফিরছি আমার চোঁখ তখন ছল ছ্ল করছে । হয়তো সবুজের এমন স্নিগ্ধতা সহ্য করতে পারছিলাম না আমি।

যোগাযোগঃ  বাংলাদেশ ফিমেল একাডেমী, ধেরাজ, সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ।

Email : gjkssy@btsnet.net  ফোনঃ ০০৮৮- ০১৭১১৩৮৮৪১২, ০০৮৮- ০১৭১৫৫৭৫১১১১,

( লেখকঃ জালালউদ্দিন সাগর, মানবাধীকার কর্মী )

ফিচার সম্পাদক