সাঁঝের রূপকথা…

সাঁঝের রূপকথা…

-রুমানা বৈশাখীঃ

এক

ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল ফটোগ্রাফটা খুঁজে পাওয়া দিয়েই।

সাদা-কালো ছবিটার বুকে ফুটে আছে ফুটফুটে এক বালিকার মুখ। অবশ্য মুখখানা এখন বাস্তবিক

সাদা-কালোই বটে। কেননা বর্তমানের এই রঙিন, কোলাহল মুখর পৃথিবীটায় তার জন্যে আর অবশিষ্ট

নেই কোনো স্থান। নিজের জায়গাটুকুন ফেলে রেখে অনেক অনেক কাল আগেই সে হারিয়ে গেছে

মৃত্যুলোকের ওপারে, পারি জমিয়েছে কখনও না ফেরার সেই দীর্ঘ দীর্ঘতম পথে।

অথচ বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া এই মৃত বালিকার এক টুকরো ছবি পেয়েই রায়হানের একান্ত

নিজস্ব পৃথিবীর ভৌগোলিক চিত্রটা কেমন যেন একদম বদলে গেল। কোনো এক গ্রীষ্মের দুপুরে আম্মার

চিলেকোঠার ঘরে জমানো হাজারো শৈশব স্মৃতির মাঝ থেকে হঠাৎ করেই যেন জীবনের কোলের ওপরে

এসে পড়লো সাদাকালো ছবিখানা। এতকাল তো চুপচাপ লুকিয়ে ছিলো ষষ্ঠ শ্রেনীর স্কুল নোটবুকটার

শরীর ভাঁজে, লুকিয়ে ছিলো স্মৃতির অতলের কোনো অন্ধকার গলি-ঘুপচির ফাঁকে। তবে আজ কেন

সামনে আসতে হলো? কেন এত সহস্র-অযুত-নিযুত প্রহর পেরিয়ে যাবার পর ফিরে আসতে হলো সেই

ভুলে যাওয়া স্মৃতিগুলোর, যাদেরকে কেবল এতকাল ভুলে যাবার চেষ্টাই করেছে ছোট্ট এক বালক?

কত না বছর পেরিয়ে গেছে.. ..পেরিয়ে গেছে সময়ের বুক বেয়ে!

চোদ্দ বছরের বালকের বয়স এখন চোদ্দ দুগুণে আটাশের পর এগিয়ে গেছে আরও দু’ বছর সামনে।

ভীষন রকম সফল জীবনের অধিকারী যুবাপুরুষ এক- যার আছে ডাক্তারী বিদ্যায় উচ্চ শিক্ষা, ঈর্ষনীয়

চাকরী, নিজের একটা গাড়ি, এমনকি ভালোবাসার একজন নারী পর্যন্ত। যে আজকাল বিয়ে করে

সন্তানের বাবা হওয়ার স্বপড়ব দেখে, ইচ্ছা রাখে অচিরেই উত্তরায় একটি ফ্ল্যাট কেনার।

বাড়িতে জোরেসোরে চলছে বিয়ের কেনাকাটা। পাঁচতারা হোটেলের পার্টি হল বুকিং দেয়া হয়ে গেছে,

ছাপা হয়ে গেছে বিয়ের কার্ড, এমনকি প্রেমিকা তপাকে কিনে দিয়েছে বিয়ের শাড়িখানাও। নিজে পছন্দ

করে কিনে দিয়েছে।

কিন্তু তারপর.. ..

অসহ্য ছবিটা সবকিছু কেমন যেন বদলে দিয়েছে নিমেষেই। ত্রিশের রায়হানকে ক্রমশ আবার বানিয়ে

দিয়েছে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর সেই স্কুল বালক, শীতের এক ভোরে একটি ভয়াবহ দৃশ্য যাকে তাড়া করে এনেছিল

মায়ের বুক পর্যন্ত।

গ্রামের পাটখেতে ধর্ষিতা বালিকার পড়ে থাকার দৃশ্য!

একটা রক্তাক্ত নগড়ব মৃতদেহ পড়ে থাকার দৃশ্য!

নিজের সবচাইতে কাছের মানুষটির অাঁচড়ে-কামড়ে ক্ষতবিক্ষত মৃত শরীরটাকে বেআব্রু পড়ে থাকতে

দেখে রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে সেই ভোরে বাড়ি ফিরেছিল বালক, ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মায়ের শরীরে।

 

স্কুল যেতে হবে, চিরটা কালের চিরচেনা খেলার সাথীটিকে তাই খুঁজতে

বেরিয়েছিল বালক প্রতিদিনের মতোই। পেয়েছিল ঠিকই, তবে জমাট বাঁধা রক্তের মাঝে শীতল পড়ে

থাকা একটা অপরিণত নারী শরীরকে। অপূর্ণ শরীরটাও যাকে রেহাই জুগিয়ে দিতে পারেনি কোনো

একদল জানোয়ারের লালসার বিষবাষ্প থেকে।

সেদিন যেন ওই পাটক্ষেতের শূন্যস্থানে বালিকার নয়, নিজের মৃতদেহই আবিষ্কার করেছিল রায়হান।

আর সদা উচ্ছল বালক নিমেষেই পরিণত হয়েছিল নির্বাক কোনো জড়বস্ত্ততে। হয়তো বালিকার শোকে

মরেই যেত তার বালক প্রেমিক, কিন্তু কেবল সন্তানকে বাঁচিয়ে তুলতে গ্রামের পাট চুকিয়ে পুরো পরিবার

পাড়ি জমাল শহরে। এই আশা নিয়ে যে রাজধানীর ঝকঝকে-চকচকে ব্যস্ত জীবন বালককে আবার

সবাক করে তুলবে।

কি হয়েছিল জানা নেই। বোধহয় নতুন জায়গা আর নতুন পরিবেশের প্রভাবটাই হবে যার কারণে

বালক গ্রামের স্মৃতিগুলোর সাথে আজন্মের সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে-বুকিয়ে আবার হয়ে উঠেছিল উচ্ছল

বালক। বেড়ে উঠেছিল ক্রমশ বুকের মাঝে শোকের মাতমটাকে কংক্রিট চাপা দিয়ে।

কিন্তু ফটোগ্রাফটা .. .. পোড়ার ফটোগ্রাফটা যেন কংক্রিটের কবর খুঁড়ে বের করে এনেছে বালকের

সেই পাগল পারা শোক। ত্রিশের পুরুষ বালিকা-প্রেমিকার জন্য কাঁদে না, কাঁদতে পারেনা। পারে চৌদ্দ

বছরের বালক। কাঁদে তাই নিজেকে নিংড়ে। অশ্রুদের আহবানে বালিকাকে ফিরে আসতে বলে যেন।

দুপুরে পাওয়া ছবিটা বুকে নিয়ে সারাটারাত চোখের জলে কেটেছিল রায়হানের। এবং তারপরের

আরও অনেকগুলো রাত। একসময় অফিস কামাই হতে লাগলো দিনের পর দিন, কমতে শুরু করলো

সকলের সাথে যোগাযোগ। মোবাইল ফোনটা কেবল বেজে যেতো নিজের মতন, জবাব দেবার এতটুকু

প্রয়োজন বোধ করতো না রায়হান। ভুলে যেতে শুরু করলো যেন নিজেকে সে। নিত্য নৈমিত্তিক কাজ,

এমনকি খাওয়াটাও যেন বোঝা হয়ে দাঁড়ালো জীবনে তখন।

সমস্ত দিন-রাত্রি কেবল আর কেবল একই ভাবনা। শুধু সাততলার ফ্ল্যাটে নিজেকে আটকে আপন

চোখে অপরাধী বালকের অন্তহীন শোকের মাতম। অপরাধী তো বটেই! না সেদিন ঝগড়াটা হত, আর

না কাঁদতে কাঁদতে একলা ছুটে চলে যেত অবুঝ বালিকা গ্রামের অন্ধকার পথে.. ..

ঝগড়াটা না হলে বুঝি আজও বেঁচে থাকত বকুল।

বকুল! হ্যাঁ, সেটাই নাম ছিল বালিকার। বালকের বিরামহীন শোকের মাতমের পর যে বালিকা

একদিন সাঁঝের আধো অন্ধকার আকাশের মায়ায় প্রবেশ করেছিল বালকের পৃথিবীতে। ঠিক বালিকা

নয়- ঝুমঝুম শব্দে নূপুর বাজিয়ে ব্যালকনী পেরিয়ে ঘরে এসে ঢুকেছিল এক তরুণী। যেন অবুঝ বালকের

কানড়বা তাকে ডেকে এনেছিল মৃত্যুলোকের ওপার থেকে। অস্পষ্ট, ভাসা ভাসা এক টুকরো ছায়া অবয়ব

কেবল। দাঁড়িয়েছিল এক কোণো বড় সংকোচ নিয়ে। এবং তাকিয়েছিল। কী বিষণড়ব দৃষ্টিতেই না

তাকিয়েছিল!

তরুণ ডাক্তার রায়হান হাবীব খুব ভালো করে জানে যে সবই তার চোখের ধোঁকা-

হ্যালিউসিনেইশন। মনের গহীনে আসন গেড়ে বসা নিদারুন অপরাধ বোধকে দূর করতে মস্তিষ্ক কর্তৃক

 

প্রদত্ত সমাধান।

তবুও…

তবুও সেই ছায়াকেই অাঁকড়ে ধরে বালক। আঁকড়ে ধরে নিজের সমস্ত স্বত্তা জুড়ে। যেন ফিরে যায়

সোনালি ধানক্ষেতের কোল ঘেঁষে ছুটে চলা সেই কৈশোরে। যেখানে সে ফেলে এসেছে নিজের আসল

সত্তাকে!

দুই

এরপর?

সাত তলা ফ্ল্যাটের খোলা ব্যালকনির কার্নিসে বসে অনেক কষ্টে একটু মলিন হাসে রায়হান, হাতের

ফটোগ্রাফটার দিকে তাকিয়ে।

এরপর তাই হলো, যা পৃথিবীর যে কোন জায়গায় হতে পারে। এবং হয়ও। রায়হানকে নেয়া হলো

সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে। প্রতিভাবান একজন চিকিৎসাবিদ নিজেকে চারদেয়ালের মাঝে বন্ধ করে রেখে

উন্মাদের মতন মাতম করছে ষোলো বছর আগে মৃত বালিকা-প্রেমিকার জন্যে, সর্বক্ষণ যার ফ্ল্যাট থেকে

ভেসে আসছে দ্বৈত কণ্ঠের উদ্ভট কথোপকথন- তাকে নিয়ে পরিবারের সকলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তো হবেই।

একে কী যেন বলল সেই সাইকিয়াট্রিস্ট? …কী যেন বলল…ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে! মানসিক চিকিৎসকদের

ভাষায় এই সমস্যাকে বলা হয় ‘‘দ্বৈত স্বত্তা’’। রোগী নিজের ভিতরেই তৈরি করে নেয় আরেকটি

অস্তিত্বকে। কখনও একই সাথে অভিনয় করে চলে দুটি চরিত্রে, একাই কথোপকথন চালিয়ে যায় ভিনড়ব

ভিনড়ব কণ্ঠস্বরে। রায়হান নামের তরুণটিও সে রোগের শিকার- তেমনটাই অভিমত দেন মনোবিজ্ঞানী।

অবশ্য তারই বা কী দোষ? রায়হান নিজেও কি জানে যে কোনটা সত্যি আর কোন অংশটুকু ভ্রম?

রোজ সাঁঝের বেলায় যে ছায়া এসে তার পাশে বসে, তাকে যে বড় আপন মনে হয়। তাকে যে ছেড়ে

দিতে মন চায় না! চলে যেতে দিতে মন চায় না! আরেকবার হারিয়ে ফেলতে মন চায় না এতটুকুও।

হাসপাতালের চাকরিটা চলে গেছে। দূরে সরে গেছে প্রেমিকা, ভেঙে গেছে বিয়ের সম্বন্ধটাও। মা

নাকি দিনরাত কানড়বাকাটি করেন, তাবিজ কবজ আনতে ছুটে ছুটে যান পীরদের দরবারে এই আশায় যে

কোনো অলৌকিকতা সারিয়ে তুলবে পুত্রকে। রায়হান নিজেও কিন্তু জানে যে জীবনটা এভাবে চলে না,

চলতে পারে না। বোঝে সে নিজের অস্বাভাবিকতা। না বুঝলে কি আজকাল বিকেল হতেই

মনোবিজ্ঞানীর দেয়া ঘুমের ওষুধগুলোর ব্যবহার করে?

কড়া ডোজের সিডেটিভগুলো ঘুম নিয়ে আসে। আর ঘুম আসে বলেই গত এক সপ্তাহ বকুল আসেনি!

রায়হানের সাঁঝবেলা গুলো পার হয়েছে সংজ্ঞাহীন মানুষের মতন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে।

বিকেল পড়ে আসছে দ্রুত.. ..

শুভ্র সাদা বর্ণের সিডেটিভগুলো হাতের তালুতে নিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে রায়হান। নিজের

ভবিষ্যৎকে বাঁচাতে হলে এই ওষুধগুলো তাকে এখনই খেয়ে নিতে হবে, খেয়ে নিতে হবে প্রকৃতির বুকে

সাঁঝ বেলাটা উপস্থিত হবার আগেই । জীবনের পথে পাড়ি জমাতে হবে এখনও অনেকটা পথ, অনেক

 

বড় হতে হবে তাকে। অ-নে-ক বড়! মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে উন্মাদ হলে তো

তার চলবে না। এখনও তো কত কাজ বাকি- নিজের বাড়ি করতে হবে, সংসার পাততে হবে,

সন্তানের বাবা হতে হবে, একটা হাসপাতালের স্রষ্টা হতে হবে। সেই তাকে কি এক ছায়ার পেছনে

অযথা ছুটোছুটি করা মানায়?

সবই জানে, বোঝেও সবই। তবুও ওষুধগুলো আজ মুখে পুরতে পারে না। কেবল মনে হয় আসুক

না বকুল! আসুক না। শেষ একটিবার দেখা হোক সেই ছায়ামানবীর সাথে কখনও যে বালক রায়হানের

সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে ছিল।

মাথার উপরে শেষ বিকেলের সুবিশাল আকাশ আর অনেক অনেকটা নীচে রাজধানী শহরের ব্যস্ত

সড়কের যান্ত্রিক কোলাহল। কি ভীষণ সজীব একটা পৃথিবী, বাস্তব একটা পৃথিবী। বিশ্বাস করতেও কষ্ট

হয় যে সূর্যটা মিলিয়ে যেতেই একটা অতিলৌকিক ছায়া এসে প্রবেশ করবে জীবনে। বসবে পাশে,

হাসবে, কথা বলবে, ঝুমঝুম শব্দে নূপুর বাজিয়ে হাঁটবে এঘর-ওঘর। মাঝে মাঝেই এখন মনে হয়

মাথাটা হয়তো সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে। একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে এমন উদ্ভট ঘটনায় কেউ বিশ্বাস

করে? অতিলৌকিকতা বলে কিছু নেই ধরনীর বুকে, সবই তার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা।

এত সব ভাবনায়ও অবশ্য মুঠোবন্দী ঘুমের ট্যাবলেটগুলোর কোন গতি হয় না। কী এক অমোঘ

আকর্ষণে রায়হান চোখ মেলে রাখে ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসা ঘরগুলোর শূন্যতায়। আকাশে মিলিয়ে

যাচ্ছে গোধূলির শেষ চিহ্নটুকুন, আলো-অাঁধারির রহস্যময়তা শরীরে মেখে একটু একটু করে এগিয়ে

আসছে সন্ধ্যা…

শোবার ঘরের ফিনফিনে পর্দাগুলো বুঝি একটু দুলে উঠল! সত্যি কি?

হৃৎপিন্ডের গতি সহসাই যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়। সত্যিই কি পর্দা দুলে উঠেছে? নাকি হাওয়ার মৃদু কাঁপন

শুধু? বকুৃল কি তবে আর সত্যি আসবে না? বিদায় নিয়েছে চিরতরে?

না, এসেছে বকুল! এসেছে তার প্রতীক্ষার আহবানে সাড়া দিয়ে। ওই তো পর্দার আড়ালে উঁকি

দিচ্ছে সবুজ শাড়িটার প্রান্ত, লাল কাঁচের চুড়ির রঙিন ঝিলিক। বাতাস ভারী তার অস্তিত্বের তীব্র মিষ্টি

গন্ধে।

বকুল এসেছে!

একটা সপ্তাহ পর আজ বকুলকে আসতে দিয়েছে সে। পরিবারের সকল অনুরোধ উপেক্ষা করে,

চিকিৎসকের সকল উপদেশ ভুলে গিয়ে, ভবিষ্যত পরিণতির ভাবনাগুলোকে পাশে সরিয়ে।

আলতা পরা নগড়ব একজোড়া পা মাতাল করা ঝুম ঝুম শব্দ তুলে এগিয়ে আসে। জোড়া নূপুরের

ঝংকার নয়, যেন রায়হানের হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ। শুনতে শুনতে ঘোর লাগে মনে, ঝিম ঝিম করতে

শুরু করে শরীর। তবু মন লাগিয়ে শোনে পুরুষ, গ্রহণ করে স্মৃতির সংগ্রহে।

এই তো শেষবার, এই তো শেষ স্মৃতি। আর কখনও তো শোনা হবে না হৃৎস্পন্দনসম এই ঝংকার।

কেননা আর কখনও বকুলকে ডাকবে না সে। কখনো.. ..কখনো না।

কিন্তু পারবে কি? কাটবে কি জীবন এই ছায়ামানবীকে ছাড়া?

 

পারতে হবে- মনস্থির করে নেয় রায়হান। তাকে যে পারতেই হবে! মায়ের

জন্যে, পরিবারের জন্যে, যে মেয়েটিয়ে সংসারের ওয়াদা করেছে তার জন্যে। সর্বোপরি… নিজের

ভবিষ্যতের জন্যে!

ছায়াটা কাছে এসে দাঁড়ায় ধীরপায়ে, ঠিক যেন জীবন্ত মানুষ কোনো। এত জীবন্ত যে তরুণী শরীরের

অন্যরকম অনুভবটাকেও স্পষ্ট অনুভব করে রায়হান। কিন্তু ছায়া-তরুণী যে আজ হাসে না একবারও।

উচ্চারণ করেনা একটি শব্দও। তাকিয়ে থাকে কেবল…. কী এক প্রচন্ড অভিমান দুচোখে নিয়ে তাকিয়ে

থাকে কেবল।

রায়হান জানে সব কল্পনা। স-অ-ব। কিন্তু বড় সুন্দর এই কল্পনা! দিন শেষের মায়াবী অন্ধকারে

অভিমান করে দাঁড়িয়ে আছে প্রতীক্ষায় অধীর প্রেমিকা। ভেজা চুলের পানি ফর্সা গাল বেয়ে গড়িয়ে নেমে

জমা হয়েছে কমলার কোয়ার মত অধরে। কালো চোখের তারায় ভর করেছে আকাশের সবটুকুন

নীলচে-অাঁধার।

জীবনটাকে যে কি ভীষণ সুন্দর মনে হয়!

পরক্ষণেই অবশ্য মনে পড়ে যায় হাতের মুঠোয় বন্দী সিডেটিভগুলোর কথা। পুরুষ জানে সেটাই শুধু

বাস্তব, বাকি সব মায়া। অর্থহীন ভ্রম, অসুস্থ মস্থিষ্কের রহস্যময় খেলা। মায়া, মায়া, মায়া সব!

‘আমি তো মায়া নই।’ এতক্ষণে বেজে ওঠে জলতরঙ্গের বাজনার মত সেই কণ্ঠস্বর, ছেলেবেলায় যা

প্রহরের পর প্রহর মুগ্ধ করে রেখেছে স্কুল পড়ুয়া বালককে। ‘আমি মায়া নই, গো। আমি তোমার বকুল!

তুমি ডেকেছ বলে আমি এসেছি।’

বুকচেরা দীর্ঘশ্বাসটা ভীষণ কষ্টে গোপন করে রায়হান, ‘তুমি বকুল নও, আমার হ্যালিউসিনেইশন।

বকুল মরে গেছে। ষোলো বছর আগে বকুল মরে গেছে।’

‘হ্যাঁ, আমি মরে গেছি! কিন্তু শেষ তো হয়ে যাইনি। মরে গেলেই বুঝি মানুষ ফুরিয়ে যায়? শেষ হয়ে

যায় আপন জনদের সাথে তার সকল দেনা-পাওনা?’

‘হ্যাঁ, শেষ হয়ে যায়।’ নিষ্ঠুরতম জবাব পুরুষের। ‘তুমি মরে গেছো, বকুল। তোমার সাথে সকল

দেনা পাওনা শেষ আমার।’

‘ তুমি জানো, ষোলোটা বছর তোমার অপেক্ষা করেছি আমি?’ মরিয়া যেন ছায়া তরুনী। ‘একটা

একটা দিন ভেবেছি কবে তোমার মনে পড়বে আমাকে? কবে আমায় ডাকবে তুমি? তোমার একটা

ডাকের অপেক্ষায় আমি ষোলোটা বছর অপেক্ষা করেছি।’

‘তুমি আমার কল্পনা। স্রেফ আর স্রেফ কল্পনা। চলে যাও, বকুল। পিজ চলে যাও। পিজ!’

অশ্রু গড়ায় ছায়া-তরুণীর আয়ত চোখ জোড়া বেয়ে। ‘ চলে যাবো আমি। সত্যি চলে যাবো। হাজার

ডেকেও কিন্তু আর ফিরে পাবেনা।’

‘ডাকবো না তোমাকে আর। যাও! পিজ যাও!’ অযথাই চিৎকার করে যেন রায়হান।

‘তুমি না চাইলে একটা মুহূর্তও থাকব না আমি, থাকতে পারব না। তুমি না চাইলে আমাকে তো

যেতেই হবে।’

 

অশ্রু বিন্দুগুলো থেকে নির্দয়ের মতন চোখ ফিরিয়ে রাখে পুরুষ। নিজেকে ষোলো বছর আগেকার

মত পুনরায় কংক্রিট চাপা দিতে দিতে বলে, ‘কেন এসেছ তুমি? এত বছর পর কেন এসেছ? কী দরকার

ছিল? সব কিছু কী চমৎকার ছিল আমার জীবনে। কেন এলে তুমি?’

‘আমি তো আসিনি! তুমি নিজে আমাকে ডেকে এনেছিলে। আমি এখনও যে দাঁড়িয়ে আছি, সেও

শুধু তোমার ইচ্ছের কারণেই। তোমার আহবান আমাকে বাধ্য করে।’

‘এখন আমি-ই বলছি.. ..চলে যাও!’

‘সত্যি চলে যাব?’

‘অবশ্যই যাবে! এভাবে আমি কল্পনার পেছনে জীবন নষ্ট করব না। কিছুতেই না।’

‘আমি কল্পনা নই, গো। আমি তোমার বকুল!’

এবার আর চোখ ফিরিয়ে রাখতে পারে না বালকের মন। হ্যাঁ, এই সেই বকুল। ছেলেবেলায় যাকে

সঙ্গী করে ঘর-কনড়বা খেলত সে, বাবা-মাকে নকল করে দাম্পত্য কলহও করা হতো পা্রয়ই। ভাবত,

একদিন অ-নে-ক বড় হবে সে। আর অনেক বড় হয়ে যখন ডাক্তার হয়ে যাবে, বকুলকে গাঢ় সবুজ

একটা শাড়ি কিনে দেবে তখন। পতাকার রঙের মতন শাড়ি, সাথে লাল টুকটুকে চুড়ি অনেক গুলি। তখন

নিশ্চই আর বকুল ঝগড়া করবে না তার সাথে।

‘চলে যাও, বকুল সোনা,’ বলে চোদ্দ বছরের বালক। ‘আমি তোমাকে সেই সবুজ শাড়িটা কিনে দিতে

পারিনি, কিন্তু আমি তোমাকে ভালবাসি। সত্যি ভালবাসি! তবু তুমি চলে যাও। চলে যাও, বকুল সোনা।’

‘তবে তুমি আমাকে মুক্ত করে দাও!’ অতল বিষণড়ব বালিকার কণ্ঠস্বর। ‘তোমার হৃদয় থেকে আমাকে

মুক্ত করে দাও। সমস্ত বাঁধন ছিনড়ব করে দাও। না হয় আমার যাওয়া হবে না। .. ..মুক্ত করে দাও

আমাকে!’

হায়! সে ক্ষমতা যদি বালকের থাকত!

বালকের বরং ইচ্ছে হয় বালিকাকে বুকের পাঁজরে বন্দী করে রাখতে। হৃদয়ের গহীনতম কোণে

লুকিয়ে রেখে চারপাশে গ্র্যানিটের দেয়াল তুলে দিতে এক। ইচ্ছে হয় দু’হাতে বুকে জড়িয়ে বলে, ‘তুমি

সব ভুলে যাও, বকুল সোনা। স-অ-ব ভুলে যাও। কিচ্ছু নেই পৃথিবীতে শুধু আমরা ছাড়া। তুমি আর

আমি-আর কিচ্ছু নেই!’

সহ্য হয়না আর। বালিকার আয়ত চোখে আহবান সহ্য হয়না বালকের এতটুকুও। আগুপিছু না ভেবে

পানি ছাড়াই সিডেটিভগুলো মুখে পুরে দেয় রায়হান। যেন এ ওষুধ গুলোই তার অন্তর গহীন থেকে মুছে

দেবে বুকল নামের এই ছায়ামানবীর চিহ্ন গুলো।

এ ছাড়া আর কি-ই বা উপায় আছে তার? চোখের আড়াল হয়ে হয়তো গেলে মনের আড়ালও হয়ে

যাবে। আর কখনও সাঁঝের বেলায় জেগে থাকবে না সে। কক্ষনো না, কোনদিনও না। এই ছায়া অশরীরি

আর কখনও ফিরে আসবার সুযোগ পাবেনা তার পৃথিবীতে, এণোমেলো করে দেবে না তার সাজানো

গোছানো জগৎটাকে।

 

… তাৎক্ষণিক রিঅ্যাকশনে মস্তিষ্ক অচল হয়ে আসে, চোখের সীমানায় ছায়া-তরুণী ক্রমশ ঝাপসা

হয়ে ওঠে। তবু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাকিয়ে থাকে বালক। আর তো দেখা হবে না…আর কখনোই তো

দেখা হবে না…কখনও তো দেখা হবে না এই জীবনে…

অস্তিত্বের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে রায়হান অনুভব করে কে যেন দু’হাতে বুকে টেনে নিল তাকে।

পরম মমতায় কপালে রাখল একটা হাত!

আহ শান্তি! অবশেষে।

পরিশিষ্ট

সন্ধ্যা হয়ে আসে।

কিন্তু আজ আর ছাদ থেকে নামার তাড়া জাগে না বাবুলের মনে। মা যে বাড়ি নেই! একটু দেরি করে

নামলে বকুনী দেবার মানুষটা নেই আজ।

আচ্ছা, নীচে যাবার আগে দোতলায় একবার যাবে নাকি?

না, থাক্! সন্ধ্যা হবার পর দোতলায় গেলে মা তো খুব বকবেই, রায়হান দাদুও বকবে। দাদু সারাদিন

তো খুব ভাল, মানে ঘুমানো বাদে দিনের যতটুকুন জেগে থাকে আর কী। সকালে ঘুম ভাঙতেই বাবুল

বাবুল করে বাড়ি গরম করে ফেলবে, একসাথে খাওয়া হবে, গোসল হকে, লুডু খেলা হবে। কিন্তু সন্ধ্যার

পর সিঁড়িতে একটু শব্দ পেলেও খুব রাগ করবে দাদু। চিৎকার করে ধমক লাগিয়ে দেবে সাথে সাথে।

তবুও! তবুও মনটাকে আটকে যে রাখা যাচ্ছে না! মা যে বলে দাদুর সঙ্গে পরী থাকে…সত্যি নাকি?

গিয়ে দেখে আসবে একবার? কিন্তু যদি বকে?

দাদু তো আর আপন দাদু নয়। বাবার দূর সম্পর্কের চাচা। মা বলে দাদুর নাকি মাথা খারাপ হয়ে

গেছিল কি একটা পরীর আসরে। তারপর থেকে এই গ্রামে এসে আছেন। ডাক্তার হলে কি হবে, মাথা

নাকি এখনও খারাপ।

ধুরো্! মায়ের কথাগুলো কখনোই যেন ঠিক বিশ্বাস হয় না বাবুলের। দাদু কী ভাল! সকালের নাশতার

সময়ে দোতলায় ডেকে নিয়ে যায়, বাবার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ সারতে সারতে নৌকা-ঘুড়ি কত

কী বানিয়ে দেয়। বাবার চোখ লুকিয়ে ৫/১০টাকাও দেয় প্রতিদিন স্কুলে যাবার সময়ে। এমন মানুষের

মাথা খারাপ হতে পারে? দাদু দেখতেও কত সুন্দর! মাথার অল্প অল্প পাক ধরা চুলে দাদুকে কেমন জ্ঞানী

জ্ঞানী লাগে।

কথাগুলো মনে পড়তে পা টিপে টিপে দোতলায় নেমে আসে বাবুল। বন্ধ দরজার ওপাশে কী আছে

দেখবার জন্য চোখ রাখে ছোট্ট একটা ফুটোয়। সকালের পর সারাদিন দাদু ঘুমোয়, নাওয়া খাওয়া সব

বাদ দিয়ে ঘুমোয় শুধু। এখন তো সন্ধ্যা। নিশ্চয়ই জেগে উঠেছে।

…আরে, ওই তো দাদু! বসে আছে বিছানায়।…কিন্তু উনি কে? দাদীমা? কী সুন্দর দাদীমা, যেন

পরী!…ধ্যুৎ! দাদু তো বিয়েই করেনি। তা হলে কি…

 

তা হলে কি সেই পরীটা? সত্যিকারের পরী?…কিন্তু পরীরা কি শাড়ি পরে? শাড়ি পরে দাদুদেরকে

পানির গাস এনে দেয়? পরীদের চুলও কি অল্প অল্প পাকা থাকে? আর পায়ে থাকে নূপুর?

শরীরের মাঝে অজানা শিরশিরানি অনুভবটা তীব্র হতেই দৌড়ে নীচে নেমে যায় বাবুল। থাক্ বাবা,

অত বীরত্ব করে কাজ নেই। মা যদি জানতে পারে যে পরীটাকে দেখতে গিয়েছিল, তা হলে কিন্তু একটা

কিল-ও আর মাটিতে পড়বে না।

অবশ্য মা জানবে কী করে? বাবুল কাউকে বললে তো!

অতিথি লেখক