গানের গুরু আজম খান

গানের গুরু আজম খান

মোমিন মেহেদীঃ

‘স্বাধীনতার পর তিনিই প্রথম বাংলা রক গান গাওয়া শুরম্ন করলেন। তখন তো ইংরেজি গানের চর্চাই বেশি ছিল। গুরম্ন বাংলা রক গানকে শহরে, হাটে-ঘাটে-মাঠে নিয়ে এলেন। এরই ধারাবাহিকতা চলছে এখনো। তাঁর দেখিয়ে দেওয়া পথে আমরা সবাই হাঁটছি। আমি এবার একটা দিকে গুরম্নর পরিবারের সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। গুরম্নর মৃত্যুর পর গত এক বছরে তাঁর গান একেবারেই শুনিনি। আজম খানের গানকে ছড়িয়ে দিতে হবে। একটা দিকে খেয়াল রাখতে হবে সবাইকে গুরম্নর গানের কথা ও সুর  যেন বিকৃত না হয়। গুরম্নর গান গেয়ে আর তাঁর গান শুনেই তাঁকে সম্মান জানাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।’ রকস্টার আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের এই হৃদয় নিংড়ানো কথাগুলোর সাথে আমিও একমত। কেননা, আমাদের গানের গুরম্ন আজম খান মায়ের মত বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রাইফেল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। স্বাধীন দেশে রাইফেল ছেড়ে ফিরে যান গানের জগতে। সত্তরের দশকে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এদেশে পপসঙ্গীতের সূচনা করেন। ভিন্ন মাত্রার গায়কী ও পরিবেশনা দিয়ে অল্পদিনেই শ্রোতাপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। সেসময় তার সঙ্গে দেশের সঙ্গীতের এ নতুন ধারায় যুক্ত হন শিল্পী ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, নাজমা জামানসহ সদ্যপ্রয়াত পিলু মমতাজের মতো সময়ের একঝাঁক তরম্নণ প্রতিভা। পপগানে তুমুল জনপ্রিয়তা আজম খানকে এনে দেয় পপসম্রাটের খেতাব। পপগানের এই রাজাকে কেউ কেউ পপগুরম্ন বলে সম্বোধন করতেও পছন্দ করতেন। এদেশে পপ তথা ব্যান্ড সঙ্গীতের অগ্রপথিক ও কিংবদমিত্ম শিল্পী আজম খান। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০ সালে তিনি ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টার, আজিমপুর কলোনিতে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৫৫ সালে প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে  বেবিতে ভর্তি হন। এরপর ১৯৫৬ সালে কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাইমারিতে ভর্তি হন। তারপর ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধের পর পড়ালেখায় আর অগ্রসর হতে পারেননি। বাবা মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান ও মা জোবেদা বেগম। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী ও মা ছিলেন সংগীতশিল্পী। মায়ের মুখেই গান শুনতে শুনতেই গড়ে ওঠে গানের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক । ১৯৫৬ সালে আজিমপুরের সরকারি বাসা ছেড়ে কমলাপুরের জসীমউদ্দীন রোডে নিজেদের বাড়িতে বসবাস শুরম্ন করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৬৮ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। উঠতি বয়সে বড় ভাইদের গানের চর্চা দেখে তীব্রভাবে ঝুঁকে পড়েন সঙ্গীতের মায়াজালে। বিভিন্ন এলাকার বন্ধুদের বাড়ির ছাদে বসে জমে উঠতো গানের আসর। হেমমত্ম, শ্যামল মিত্র, মুখেশ, মুহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার সহ দেশ-বিদেশের নানান শিল্পীর গানে মাতিয়ে রাখতেন আসর। ১৯৮১ সালের ১৪ই জানুয়ারি তিনি সাহেদা বেগমকে বিয়ে করেন। ১৯৭২ সালে নটরডেম কলেজের একটি অনুষ্ঠানে প্রথম মঞ্চে গান শোনান পপগুরম্ন আজম খান। তখনও এদেশে প্রচলিত হয়নি কনসার্ট নামের সঙ্গীতানুষ্ঠান। ১৯৭৩ সালের ১ এপ্রিল প্রথম কনার্ট হয় ওয়াপদা মিলনায়তনে। সেখানে এক মঞ্চে গান গেয়েছিলেন আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফকির আলমগির ও পিলু মমতাজ। ১৯৮২ সালে বের হয় তাঁর প্রথম ক্যাসেট ‘এক যুগ’। সব মিলিয়ে তাঁর অডিও ক্যাসেট ও সিডির সংখ্যা ১৭টি। সত্তর, আশি ও নববইয়ের দশকে বৈচিত্র্যময় কথার নানা পপগান গেয়ে তারম্নণ্যের হৃদয়ে উন্মাতাল আনন্দের ঝড় তুলেছেন। তার অগণিত জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, আলাল ও দুলাল, ওরে সালেকা ওরে মালেকা, অভিমানী, আমি যারে চাইরে, হাইকোটের্র মাজারে, এত সুন্দর দুনিয়ায়, জীবনে কিছু পাব নারে, পাঁপড়ি কেন বুঝে না, চার কলেমা সাক্ষী দিবে এবং ও চাঁদ সুন্দর রূপ তোমার ইত্যাদি। আমাদের আলোকিত দেশ গড়ার জন্য,স্বাধীনতার জন্য যে যুদ্ধ; সেই মুক্তিযুদ্ধেও বীরোচিত ভূমিকা রেখেছেন পপসম্রাট আজম খান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরম্ন হলে জীবনকে বাজি রেখে অংশ নিয়েছেন অসংখ্য গেরিলা যুদ্ধে। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার মেলাঘরে। প্রশিক্ষণ শেষে দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন দখলদার পাকিসত্মাানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। অস্ত্র হাতে প্রথম লড়াই করেন কুমিলস্নার সালদাহে। এরপর ঢাকার ডেমরা, যাত্রাবাড়ী হয়ে লক্ষানদী, বালুনদী, গুলশান, ইসাপুর ও ক্যন্টনমেন্টের পাশ পর্যন্ত নানা স্থানে অংশ নিয়েছেন গেরিলা অপারেশনে। যুদ্ধকালীন সময় ডেমরার তিতাস মিশন শেষ করে ফেরার পথে নৌকাডুবিতে বিপর্যয়ে পড়েন তিনি। নদীর তলদেশের লতায় পা আটকে যাবার ফলে সাঁতার কাটা দুরহ হয়ে পরে। অস্ত্র টানার নৌকা জড়িয়ে ধরে আত্নরক্ষা করেন তিনি। সেই সাহস মানুষ গানে গানে তানে তানে মুক্তিযুদ্ধ শেষে আবার মগ্ন হয়েছিলেন গানের ভূবনে। এখানে তিনি তাঁর পুরো জীবনই ব্যায় করেছেন। যার বিনিময়ে সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ পেয়েছে আজম খানের রঙধনুময় অসংখ্য গান। যে গানে বাংলাদেশ, ভালোবাসা উঠে এসেছে নিমগ্ন শ্রদ্ধায়।  খেয়ালি মানুষ ছিলেন আজম খান। গানের বাইরে বিভিন্ন জনের অনুরোধে অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে হীরামনে কালা বাউলের চরিত্রে অভিনয় করেন। ২০০৩ সালে ‘গডফাদার’ সিনেমায় ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ২০১০ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা নামক মুখগহবরের ক্যান্সারে আক্রামত্ম হন আজম খান। প্রথমে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৪ জুলাই তিনি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে ইএনটি হেড-নেক সার্জন বিভাগের প্রধান অ্যান্ড্রু লয় হেং চেংয়ের তত্ত্বাবধানে আজম খানের মুখে সফল অস্ত্রোপচার করা হয়। ৭ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় তাকে পুনরায় সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে মোট ৩০টি রেডিওথেরাপি ও ৫টি কেমোথেরাপি দেয়ার কথা থাকলেও আজম খান ২১টি রেডিওথেরাপি ও ১টি কেমোথেরাপি নিয়ে ২৭ ডিসেম্বর দেশে ফিরেন আসেন। সম্পূর্ণ কোর্সটি সম্পন্ন করা সমর্থন করেনি তাঁর শরীর। ২০১১ সালের ২২ মে হঠাৎ বাম হাতে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলে তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৭ মে গুরম্নতর অসুস্থ হলে তাঁকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়। এরপর স্কয়ার থেকে ১ জুন সিএমএইচে স্থানামত্মর করা হয় তাঁকে। ৫ জুন রবিবার সকাল ১০.২০ মিনিটে ঢাকা সেনানিবাসের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদমিত্ম এ শিল্পী। বাংলাদেশের পপ গান মানেই আজম খান, বাংলাদেশের কনসার্ট মানেই আজম খান, বাংলাদেশের রঙধনু মানেই আজম খান। তার প্রতি প্রতয়ের সাথে বলছি- আমরা স্বাধীনতার চেতনায় আবার আমাদের বাংলাদেশকে গড়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ হবো, নতুন মত নতুন পথ তৈরি হবে বাংলাদেশের সুরে সুরে, আপনার তানে তানে গানে গানে…

 মোমিন মেহেদী : কবি ও সাংবাদিক  mominmahadi@gmail.com

অতিথি লেখক