শিক্ষার মান নিশ্চিত করা সময়ের দাবি

শিক্ষার মান নিশ্চিত করা সময়ের দাবি

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ বাংলাদেশে বর্তমানে ২০ ধরনের আমত্মর্জাতিক বিদ্যালয় আছে। অভিভাবকগন স্থানীয় ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় বাদ দিয়ে তাদের সমত্মানদের এইসব আমত্মর্জাতিক ইংলিশ মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন কেন? প্রথমত, এখানকার  শিক্ষকগন স্থানীয় ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের চেয়ে অনেক বেশী মানসম্পন্ন। তাছাড়া এসব স্কুলের কারিকুলাম ও কোর্সসমূহ বিদেশী শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত হয়, ব্যবস্থাপনাও বিদেশীদের। বিদেশীদের ব্যবস্থাপনা মানে দক্ষ ব্যবস্থাপনা বলে ধরে নেয়া হয় । দ্বিতীয়ত, বাসত্মবজীবনে সমস্যাবলী কিভাবে সমাধান করা যায় এসব স্কুলে সেগুলো শেখানো হয় অর্থাৎ এখানকার শিক্ষা অনেকটাই বাসত্মবমুখী। শিক্ষার্থীরা এখানে গণিত ও প্রকৌশলগত দক্ষতাও অর্জন করে। দলে ও জুটিতে  কাজ করে কিভাবে বাসত্মবজীবনের প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো অর্জন করা যায় সে শিক্ষা তারা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়ে থাকে। তারা আরও শিখে কোন একটি ব্যাপার বা বিষয়কে কিভাবে জটিলভাবে ও সৃজনশীল উপায়ে  চিমত্মা করতে হয়। দেশে বিদেশে চাকুরী করে এখানকার গ্রাজুয়েটগন ইতিমধ্যে সুনাম অর্জন করেছে।

তাদের যোগাযোগ দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা, প্রশংসনীয়। তাছাড়া এসব স্কুল থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা উত্তর আমেরিকা, যুক্তরাজ্য এবং অষ্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে  সহজেই ভর্তি হতে পারে। এসব স্কুলে যারা পড়ে তারা বিশ্বের বিভিন্নপ্রামেত্মর শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ ও মেলামেশার সুযোগ পায়। বড় হয়ে বাসত্মব জীবনে অন্যের সাথে কিভাবে মিশতে হয় তা জানার সুযোগ পায়। এসব কারনে স্কুলে পড়ার খরচ অন্যান্য ইংরেজি মাধ্যমের চেয়ে বেশী তারপরও অভিভাবকগন এখানে তাদের সমত্মানদের পাঠাচ্ছেন। এখানকার শিক্ষার্থীরা বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতো টিচিং অ্যাসিসট্যান্টশীপ পেয়ে থাকে। সমস্যা বিশ্লেষন করার ও গ্রুপ আলোচনা করার সুযোগ পায়। আর একটি বড় ব্যাপার হচ্ছে অভিভাবকদের প্রাইভেট পড়ানোর চিমত্মা করতে হয়না। অভিভাবকদেরকে শিক্ষার্থীদের  নিয়ে শিক্ষকদের বাসায় বাসায় যেতে  হয়না যা দেশী ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম এবং ইংরেজি ভার্সনের ক্ষেত্রে করতে হয়। ট্রাফিক জামে আটকে থাকার চিমত্মা করতে হয়না। এসব বিদ্যালয়গুলো হচ্ছেঃ- কানানিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ইত্যাদি।

আমত্মর্জাতিক এসব ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের ডিগ্রী দেয়া হয়ে থাকে। অর্ডিনারী ও অ্যাডভান্সড লেভেল, জুনিয়র ও সিনিয়র ক্যামব্রীজ, আমেরিকান হাইস্কুল ডিপ্লোমা, অষ্ট্রেলিয়ান হায়ার স্কুল সার্টিফিকেট, আমত্মর্জাতিক ব্যাকালরেট ইত্যাদি। এসব ডিগ্রী নেয়ার পর একজন শিক্ষার্থী উত্তর আমেরিকার, অস্ট্রেলিয়া ও গ্রেট ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে ভর্তির সুযোগ পায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এসব ডিগ্রীকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। ফলে এসব স্কুল থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে পারছেনা। সবাই যে বিদেশে যাচ্ছে বা যেতে পারছে তারও কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। অভিভাবকগনও এসব বিষয়ে খুব একটা সচেতন নন। ইউ জিসি-র বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখা দরকার। ইউ জিসি-র এসব ডিগ্রী  গ্রহন করার অর্থ হচ্ছে এসব স্কুলগুলো থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের উচচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির  সুযোগ পাবে, দেশও তাদের সেবা পাবে, বাঁচবে বহু দেশী মুদ্রা।

এগুলো ছাড়াও আমাদের রয়েছে দেশী অসংখ্য ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়। এগুলো নিয়ে বেশ কিছু নেতিবাচক কথাবার্তাও প্রচলিত আছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সালাম বা আদাব দেয়ার তোয়াক্কা করেনা। ক্লাসে যে কোন সময়, প্রথম পিরিয়ড শেষেও ক্লাসে ঢুকতে পারে, তবে তাদের কিছু বলা যাবেনা, কারণ কোন ধরনের শাসিত্ম এখানে প্রযোজ্য নয়। তৃতীয় শ্রেণী পর্যমত্ম শিক্ষার্থীরা মোটামুটি ফিটফাট পোশাক পরে, তৃতীয় গ্রেডের পর তাদের ড্রেস নীচে নামতে থাকে অর্থাৎ অশালীণভাবে পোষাক-পরিচ্ছেদ পরিধান করে। আমাদের দেশীয় কালচারের সাথে যা বেমানান। এসব বিদ্যালয়ে  শারীরিক শাসিত্মর কোন বিধান নেই। কোন কোন শিক্ষক বলেন শারিরীক শাসিত্ম দেয়ার দরকার নেই, শারিরীক শাসিত্মর ভয় তাদের অনেক কিছু শেখাতো। যাই হোক এটি একটি বিতর্কিত বিষয়। তবে এটি সত্য যে, ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনেকটাই উগ্র এবং আমাদের সংস্কৃতির সাথে খাপ খায়না এমন অনেক আচরণই করে থাকে। আবার এও সত্য যে, ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোতে শিÿার্থীরা আনন্দের মধ্যে দিয়ে শেখে। কিন্তু স্কুলে তো শুধু পড়ালেখা শেখাই উদ্দেশ্য নয়। তারা কাস্টম, ব্যবহার, কালচার, মানবিক আচরণ ও ব্যবহার স্কুলে শিখবে। কিন্তু এই বিদ্যালয়গুলো এসব কিছুর তোয়াক্কা করেনা। তারা সব সময়েই চেষ্টা করে কিভাবে অন্যের চেয়ে স্মার্ট হওয়া যায়। আর এই স্মার্টের পেছনে ছুটছে সব গার্ডিয়ান ও শিক্ষার্থীগন। তবে সবাই যে শুধু সমত্মানদের স্মার্ট বানানোর জন্যই ইংরেজি মাধ্যমে পাঠাচ্ছে তা নয়। বাংলা মাধ্যম বা ইংরেজি ভার্সনের অবস্থা যে খুব ভাল তা তো নয়। এসব স্কুলের লেখাপড়া এখনও আধুনিকতা থেকে অনেক দুরে। এখানে ক্রিয়েটিভি এবং উদ্ভানীর চর্চা বা প্রাকটিস নেই বললেই চলে। পড়া গিলা, খাতায় ঢেলে দেয়া আর গ্রেড অর্জন করাই মুখ্য। শিক্ষার্থীরা কি শিখলো বা তাদের বাসত্মব জীবনে এগুলো কতটা কাজে লাগবে তার কোন চেষ্টা বা চিমত্মা নেই। কাজেই সচেতন এবং সচ্ছল অভিভাবকগন তাদের সমত্মানদের ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন। এ ছাড়াও বাংলা মাধ্যমে হাতে গোন কয়েকটি বিদ্যালয় আছে, সেগুলোতে ভর্তি করানোর চেষ্টা করা মানে এক প্রকার যুদ্ধ করা। এই যুদ্ধ এড়াতে এবং কোচিং এড়াতে অনেক অসচ্ছল অভিভাবকগনও তাদের সমত্মানদের ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে থাকেন। আমত্মর্জাতিক ইংরেজি মাধ্যম তো হলো একেবারে উচ্চবিত্তের খেলা কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমে তো তা নয়। অথচ ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সরকারের তরফ থেকে তেমন কোন প্রশংসীয় উদ্যোগ বা চেষ্টা নেই। ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীরা জাস্টিন বুইবেন বা  অ্যাকর্ন-এর গান শোনে, তারা রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন এবং লালনগীতি জানেনা, জানেনা মমতাজ কে। ইংরেজি মাধ্যমের একটি ছেলে বা মেয়েকে শুধুমাত্র ইংরেজি বলতে পারা এবং উপস্থাপন দক্ষতা ছাড়া প্রশংসা করার মতো তেমন আর কিছু নেই। তারপরও তারা যে শুদ্ধ ইংরেজি বলছে তা কিন্তু নয়।তারা আমাদের নিজস্ব কালচার সম্পর্কে অজ্ঞ, আমাদের সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করেনা বা শ্রদ্ধা দেখায় না। শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য তা কিমত্ম এখানে  হচ্ছে না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের অভিভাবকগন কেন ছেলে মেয়েদের ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোতে পাঠাচ্ছেন? এর কয়েকটি কারণ আছে। একটি হচ্ছে আধুনিক যুগ ইংরেজি ও কম্পিউটারের যুগ, ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলো এই চাহিদা পূরন করছে বলে অনেক অভিভাবক এখানে তাদের ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে থাকেন। দ্বিতীয়ত, বাংলা মাধ্যমে হাতে গোনা দু একটি বিদ্যালয় ছাড়া বাকীগুলোর শিক্ষার পরিবেশ ও মান ভালো নয়। জনসংখ্যার অনুপাতে ঢাক শহরে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নিতামত্মই অপ্রতুল। আর হতে গোন নামীদামী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া এক ধরনের পাগলামীর মতো পরীক্ষা এবং প্রতিযোগিতা। কিছু অর্থনৈতিকভাবে বেশ সচ্ছল অভিভাবকগন টাকা খরচ করা এবং ইংরেজি মাধ্যমে বাচচা পড়ানো এক ধররেন প্রেস্টিজ মনে করেন। ইংরেজি মাধ্যমের পড়া-লেখার ধরন ও পরীক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদেরকে ক্রিয়েটিভ হতে বাধ্য করে যা বাংলা মাধ্যমে প্রায় পুরোটাই অনুপস্থিত । এইসব কারণগুলোর জন্য ইংরেজি মাধ্যমের লেখাপড়া এবং বিদ্যালয়ের সংখ্যা দিন দিনই বেড়ে যাচ্ছে আর তা ছড়িয়ে পড়ছে সিটি থেকে শহর, শহর থেকে উপজেলা এমনকি গ্রামেও। কাজেই সময় এসেছে এসব বিভিন্ন ধরনের বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা এবং দেশীয় কালচারের সাথে মিল রেখে বাসত্মবমুখী শিক্ষাদান করার সঠিক ব্যবস্থা গ্রহন করা।

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম.

প্রধান সম্পাদক