আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় ও আমাদের বর্তমান প্রজন্ম ভাবনা…

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় ও আমাদের বর্তমান প্রজন্ম ভাবনা…

জবরুল আলম সুমনঃ প্রতিটা স্বাধীন রাষ্ট্রের একটা নিজস্ব সমৃদ্ধশালী ইতিহাস আছে ঠিক তেমনি ভাবে আমাদের এই স্বাধীন রাষ্ট্রেরও আছে সমৃদ্ধশালী ইতিহাস। যে ইতিহাসের সূচনা হয়েছিলো মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আর তা নানান পথ পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে পূর্ণতা পেয়েছিলো কিন্তু আমরা বা আমাদের প্রজন্ম নিজের চোখে মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। আমরা মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হয়েই একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। আমাদের স্বীয় চোখে অদেখা ছিলো সাধারণ বাঙ্গালীর উপর পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠির দমন পীড়ন শোষণ নির্যাতন অতঃপর ঐক্যবদ্ধ মুক্তিকামী বাঙ্গালীর বলিষ্ঠ প্রতিবাদ আর জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া, ফলাফলে প্রিয় মাতৃভূমিকে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা। আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি বিকৃত গ্রন্থকীট গিলে গিলে আর বায়োজ্যেষ্ঠদের চোখে। পাঠ্য বইয়ে কোন শিক্ষা বর্ষে পা রেখে পড়েছি স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান। সে বর্ষের পাঠ্য বইয়ে জিয়াউর রহমানকে দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের শুরু আর তাকে দিয়েই শেষ, সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আবার কখনো অন্য কোন শিক্ষা বর্ষে গিয়ে পড়েছি কেবলমাত্র জাতির জনকের সুযোগ্য নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের রক্তপথ পাড়ি দিয়ে আমাদের এই দেশ বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে নিজেকে অঙ্কিত করেছে, সে বর্ষে কেবলই জাতির জনক বন্দনা, অন্যদের অবদান ঠিক আগের মতোই ছিলো অনুপস্থিত। আমি এই স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কোন বিতর্কে এই মুহুর্তে নিজেকে জড়াতে চাইনা। সত্যিটা বললে বলবো আমি অক্ষম! কারণ ক্ষমতার গদিতে যার পাছা ভর করেছে সে-ই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ছুরি চাকু চালিয়ে তারমতো করে নিয়েছে। তাই আমাদের এই প্রজন্ম, বয়সের বা শিক্ষার একেক ধাপে এসে একই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস গিলেছি, গিলে গিলে বড় হয়েছি।

টেলিভিশনের সাদা-কালো কিংবা রঙিন পর্দায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র আর ৭ই মার্চের মঞ্চটা-ই ঘুরে ফিরে আমাদের চোখের সামনে এসেছে বারবার, আমাদের প্রজন্মের সিংহ ভাগই এই দুটো দৃশ্যের কোন একদিকে ঝুঁকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গলাধঃকরণ করছেন আর কেউ কেউ হয়তো কোন দিকেই না গিয়েই শুরু থেকেই জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েছেন আর কেউ কেউ দুটো দৃশ্যের ভারসাম্য রক্ষা করেই নিজের মতো করে নিয়েছেন। কিন্তু আমাদেরকে প্রকৃত ইতিহাস থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে খুবই সুক্ষ্ণ ভাবেই। কেন করা হলো বা এর দায় কার, এ প্রশ্নটাই শুধু পড়ে থাকে উত্তর মিলেনা কখনোই, আদৌ মিলবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গেছে আমাদের প্রজন্মের মাঝে। সময়ের স্রোতে আমরাও গা ভাসিয়ে দিয়েছি উত্তর না খুঁজেই। একারণেই হয়তো মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কাছে কেবলই একটা অনুষ্ঠানিকতা মাত্র! মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট দিবসগুলো দায়সারা ভাবে বা কোন এক ভাবে পালন করেই যেন এই দেশে জন্মাবার দায় এড়াতে চাই। তারপর মুক্তিযুদ্ধ ভুলে গিয়ে জড়িয়ে পড়ি জীবনযুদ্ধে, জীবন এভাবেই ছুটে চলছে তিল তিল করেই।

যারা এই দেশকে জন্ম দিয়েছেন কেবল তারাই জানেন এই দেশকে পৃথিবীর আলোয় আনতে কতটা অবর্ণনীয় দূর্ভোগ তাদের পোহাতে হয়েছে, আমরা তা সঠিক ভাবে জানিনা বলেই কারণে অকারণে দেশকে ছোট করে ফেলি বিশ্বের কাছে। প্রসব বেদনায় কাতর একজন মা-ই কেবল জানেন একজন সন্তান জন্ম দিতে কতটা কষ্ট সহ্য করতে হয়। অতঃপর ভূমিষ্ট সন্তানের দিকে তাকিয়ে সব যন্ত্রণা হাসি মুখে ভুলে যান এবং সেই সন্তানকে জীবনের চেয়েও ভালোবেসে সারাজীবন আগলে রাখেন। কিন্তু আমাদের কাছে সেই কষ্টানুভূতি পৌছায়নি বলেই ছোট ছোট কারণেই আমরা তুচ্ছ তাচ্ছিলো করে ফেলি। আমাদের কাছে সেই কষ্টানুভূতি পৌছায়নি বলেই এখনো বাংলাদেশ পাকিস্থানের ক্রিকেট ম্যাচে স্বীয় মাতৃভূমি প্রিয় বাংলাদেশকে তুচ্ছ করে পাকিস্থানকে সমর্থন দিয়ে দিই, নির্লজ্জের মতো “আফ্রিদি, প্লিজ ম্যারি মি” প্লে-কার্ডে লিখে খেলার মাঠে হাজির হই। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস আমাদের কাছে পৌছায়নি বলেই আমাদের পূর্বসূরীদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা আমাদেরকে নাড়া দেয়না, আমাদের মহান বিজয় আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে উল্লাসিত করেনা, উজ্জীবিত করেনা। শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই নয়, আমাদের নবীন প্রজন্মদের অনেকেই জানেনা আমাদের বাংলা সংস্কৃতি, সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবেই তারা বড় হচ্ছে বিজাতীয় সংস্কৃতিতেই এই দেশে জন্মে এই দেশের আলো বাতাস গায়ে মেখে। তারা জানেনা ষড়ঋতু মানে কি বা কয়টি ঋতু আছে আমাদের, তারা জানেনা বাংলা বারো মাসের নাম তবুও তারা বিশ্বাস করে তারা বাঙ্গালী, তারা বাংলাদেশী।

আমাদের জীবনে ধর্ম যেমন একটা বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তেমনি করে আমাদের প্রজন্মের কাছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাও এখন যেন একটা বিশ্বাসের উপর হাত পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেহেতু আমারা প্রকৃত ইতিহাস থেকে বঞ্চিত তাই যে যেভাবে আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছেন আমাদেরকেও ঠিক সেভাবেই বিশ্বাস করতে হচ্ছে। নানান ধর্মে যেমন নানা রকম বিশ্বাস প্রচলিত ঠিক তেমনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও যেন নানান রকম বিশ্বাস প্রচলিত হয়ে আসছে আর এমনটা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধকে দলীয়করণ করে। একটা সময় শুনতাম ব্যক্তির চেয়ে দল বড় আর দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু সেই প্রবাদটা আজ বড়ই শেকেলে হয়ে গেছে, আর শেকেলে হয়ে আজ তা রিভার্স (reverse) হয়ে গেছে তাই দেশের চেয়ে দল বড় আর দলের চেয়ে দলের কর্তা ব্যক্তিরাই বড় হয়ে গেছেন। যেকারণে দলের কর্তা ব্যক্তিরা যা-ই বলবেন, নির্লজ্জের মতো কোন অনুসন্ধানে না গিয়ে তা-ই সত্য বলে আমাদেরকে ধরে নিতে হবে এবং নিচ্ছিও। আর তাই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীসহ প্রমূখ নেতৃবৃন্দরা আজ প্রচার যন্ত্রের আড়ালেই থেকে গেছেন। আড়ালে থেকে থেকে কোন একটা সময় হয়তো ইতিহাসের পাতা থেকেও হারিয়েই যাবেন, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মরা হয়তো কোনদিন জানতেই পারবেনা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিলো উল্লেখিত এইসব মহান নেতাদের হাত ধরেই।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের খুচরা ইতিহাস না জানলেও আমরা কিছুটা জানি, আর নিশ্চিত ভাবে যা জানি সেগুলোর মধ্যে হলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিলো ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চে, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে  ৮ মাস ২০ দিন বা প্রায় নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়ের প্রধান ফটকে পৌছে যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ছিলো বিজয়ের দিন, সেদিন বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্থানী সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক লেঃ জেঃ এ. এ. কে নিয়াজী হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার সামনে  প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্থানী সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন, বাংলাদেশের পক্ষে  ভারতীয় লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অররা আত্মসমর্পনের নির্দশনপত্র গ্রহণ করেন। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করলেও সারা দেশে সকল পাকিস্থানীদের আত্মসমর্পণ করাতে ২২শে ডিসেম্বর পর্যন্ত লেগে যায়।

বিশ্বের ইতিহাসে এতো কম সময়ে কোন দেশ স্বাধীন হওয়ার ঘটনা খুবই বিরল এটাও আমরা জানি কিন্তু আমরা যা জানিনা তা হলো জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্থানী বাহিনীর আত্মসমর্পনের দিনে তিনি কেন সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন? জেনারেল ওসমানীর মতো আরোও অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হয়তো সেদিন অনুপস্থিত ছিলেন, কিন্তু কেন? আমরা আরোও যা জানি তা হলো সারাদেশ জুড়ে রাজাকার, আল বদর, শান্তি কমিটি, বিহারী ও যুদ্ধাপরাধীদের একটা তালিকা তৈরী করা হয়েছিলো, সেখানে তাদের নাম ঠিকানাসহ নির্ধারিত সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের সঠিক তালিকা কেন আজ পর্যন্ত করা হয়নি? কেন আমাদেরকে ধারণা করতে হবে বা অনুমান করে বলতে হবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন? এতো বছর পরেও মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করতে পারছিনা কেন? তবে কি এই সংখ্যা আরোও অনেক বেশি ছিলো বা আরোও অনেক কম ছিলো যা সঠিক ভাবে প্রকাশ করলে কোন দল বা বিশেষ গোষ্ঠির ভাবমূর্তী ক্ষুণ্ণ হতে পারে?

শহীদদের সংখ্যা এক্সাক্টলি ৩০লক্ষ অনেকে মেনে না নিলেও ভিন্ন কোন সংখ্যা আমাদের সামনে উপস্থাপন হতে দেখিনি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সম্ভ্রম হারানো আমাদের মা-বোনদের সংখ্যা নিয়ে মতপার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে। তাই ত কেউ কেউ বলেন ২লক্ষ আর কেউ কেউ বলেন ৩লক্ষ। সেখানেও কেন সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি? এখানে অবশ্য আমার কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন আছে। আমি ধরে নিলাম মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের ৩ লক্ষ মা-বোন পাকিস্থানী বাহিনী, রাজাকার, আল-বদর ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের দ্বারা সম্ভ্রম হারা হয়েছিলেন। বর্তমান সময়ের মতো সেই সময়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণের এতো ভালো কোন ব্যবস্থা ছিলো না এবং যা ছিলো তাও খুব একটা সহজলভ্য ছিলোনা। তাই কেউ কেউ ধর্ষণের শিকার হয়ে সম্ভ্রম হারানোর জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন কিন্তু সেই সংখ্যা খুব বেশি হবেনা বলে আমার ধারণা, কেউ কেউ ধর্ষিতা হওয়ার পর পাক বাহিনী ও তাদের মিত্র দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছিলেন কিন্তু বিশাল একটা সংখ্যা নিশ্চয় বেঁচে গিয়েছিলেন। যেকোন অংকেই আমি খুবই দূর্বল তারপরও বেকায়দায় পড়ে পাটি গণিতের নিয়মানুসারে ধরা ধরির একটা অংকের চাল চালতে বাধ্য হলাম।

ধরে নিলাম আত্মহত্যা ও হত্যার শিকার হয়ে ৩লক্ষ থেকে ১লক্ষ মা-বোন মৃত্যু বরণ করলেন তারপরও ২লক্ষ বেঁচে থাকলেন। যেহেতু সে সময় জন্ম নিয়ন্ত্রণের ভালো কোন ব্যবস্থা ছিলো না তাই ধরে নিলাম ২লক্ষ থেকে ১.৫লক্ষ মা-বোন গর্ভ ধারণ করে ফেলেন। ধরে নিই সেই গর্ভবতী দেড় লক্ষ মা-বোন তাদের সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে বা তারও আগে বিবিধ কারণে আরোও ৫০হাজার মারা গেলেন তারপরও ১লক্ষ মা-বোন নিশ্চয় সুস্থ্যভাবেই সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। এখানে আমার প্রশ্ন মূলতঃ দুটো। প্রথম প্রশ্নঃ মাঝে মাঝে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে সুবিধা বঞ্চিত ও ভাগ্যবান মুক্তিযোদ্ধাদের জনসম্মুখে উপস্থাপন করে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হলেও আজ পর্যন্ত কেন আমাদের প্রাণপ্রিয় বীরাঙ্গনা মা-বোনদের নিয়ে সেরকম কোন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। সংখ্যার বিভেদে তাদেরকে কেন আটকে রেখে পাইকারী হারে স্বীকৃতি দিয়ে সত্যিকার অর্থে তাদেরকে আড়াল রাখা হয়েছে? কেন তাদেরকেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হয়নি? দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে তাদের  কি কোন অবদান নেই? দ্বিতীয় প্রশ্নঃ যদি দেড় লক্ষ মা-বোন যুদ্ধশিশু জন্ম দিয়ে থাকেন তবে স্বাধীনতার একচল্লিশ বছর পর সেদিনের সেই দেড় লক্ষ যুদ্ধশিশু থেকে তাদের বংশধর হিসেবে আরোও তিন থেকে চার লক্ষ ইতিমধ্যে যোগ হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু তারাও কেন গণ মাধ্যমের বাইরে থেকে গেলেন? এখানে কি কারণ থাকতে পারে? মূল সংখ্যাটা যদি প্রকৃত না হয়ে থাকে তবে বিশ্বের দরবারে কেন এই সংখ্যাটা প্রকাশ করা হলো? এবং উল্লেখ্য সংখ্যা প্রকাশ করে কেন ইঙ্গিত করা হবে আমাদের দেশে আনুমানিক এতো সংখ্যক যুদ্ধ শিশু ও তাদের বংশধর রয়েছেন? কেন আমরা অনুমানের উপর নির্ভর করে যুদ্ধশিশু ও তাদের বংশধরের সংখ্যা নির্ধারণ করে বিশ্ব দরবারে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্য থাকবো?

অতীতের ছোট খাটো ভুল ভ্রান্তির কারণেই কেবল আমরা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে নেই, বর্তমান নেতা নেত্রীর লাগামহীন কথা বার্তা ও কর্মকান্ডেও আমরা বেশ অস্বস্তিও আশঙ্কার মধ্যে আছি। সাবেক বনমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের এক মতবিনিময় সভায় দাবি করেছেন, বাংলাদেশের মালিক আওয়ামী লীগ। বিজয়ের মাস উদযাপন উপলক্ষে ধানমন্ডিতে দলীয় সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মোঃ নাসিমের সভাপতিত্বে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই দেশ আমরা স্বাধীন করেছি। বি.এন.পি দেশ স্বাধীন করেনি। সুতরাং তারা এই দেশের মালিক নন। আমরা এ দেশের মালিক। এই দেশে আমরাই থাকব, তারা নন।’ সংসদ উপনেতার এই হুমকি ধামকিতে বি.এন.পি তাদের অঙ্গ সংঘটন ও নেতা কর্মীদের নিয়ে লেজ গুটিয়ে দেশ ছেড়ে পালাবে কিনা তা তাদের ব্যপার কিন্তু সংসদ উপনেতার এহেন হুমকিতে আমাদের প্রজন্ম বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। আমরাও এই দেশ স্বাধীন করিনি, স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের কোন অবদান নেই, কোন সুযোগও ছিলোনা। কারণ আমরা জন্মেছি দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক পরে। তাহলে কি আমরাও এই দেশ আমাদের বলে দাবী করতে পারবোনা? আমাদেরকেও কি এই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে? প্রশ্নটা রেখে গেলাম আমার সম্মানিত বিদগ্ধ পাঠকদের কাছে।

একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদের এই প্রাণ প্রিয় বাংলাদেশ বিশ্বের মাত্রচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এটা আমাদের জন্য কম গর্বের কথা নয়, কম অহংকারের নয় আর এই গর্ব ও অহংকারের সূচনা হয়েছিলো আমাদে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে, কিন্তু চল্লিশ বছর আগে বিজয় অর্জন করেও কি সত্যিকার অর্থে আমরা বিজয়ী হতে পেরেছি? আমরা কি পেরেছি স্বাধীনতার সুফল সবার কাছে পৌছে দিতে? আমরা কি পেরেছি সরকারী প্রচার মাধ্যমগুলোকে সরকারের অবৈধ হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত করতে? সরকারী কোন অফিসে বা আদালতে উৎকোচ ছাড়া কোন কাজ সঠিক সময়ে সফল ভাবে সম্পাদন করতে পেরেছি কি কখনো? আমাদের বিজয়, আমাদের অহংকার আজ কেবল কাগজে কলমে কিন্তু বাস্তবে নয়। বাস্তবে এখনো আমরা পরাধীন হয়ে আছি ক্ষমতাসীন দল বা গুটি কয়েক কর্তা ব্যক্তির কাছে। পাড়ার ছিঁচকে চোর থেকে গুন্ডা-মাস্তান, চাঁদাবাজ, দখলবাজ, অসাধু ব্যবসায়ী ও দূর্নীতিবাজদের কাছে এখনো আমরা জিম্মি হয়ে আছি। কার কাছে আমরা বিচার প্রার্থনা করবো? বিচারকেরাও যে আজকাল ছিঁচকে চোর মাস্তানদের মতো অপরাধী হয়ে উঠছেন। সামান্য কয়েকটি টাকার কারণেই মাননীয় বিচারকেরাও তাদের নীতি বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছেন অবলীলায়।

সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটা খবরে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই, বিচারকদের এই নৈতিকতার স্খলন দেখে স্তম্ভিত হলাম। খবরে প্রকাশঃ রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের সামনে থেকে আজ শনিবার সন্ধ্যায় অস্ত্র ও ফেনসিডিলসহ এক জ্যেষ্ঠ সহকারী জজকে গ্রেপ্তার করেছে নিউমার্কেট থানার পুলিশ। তার নাম জাবেদ ইমাম। তিনি ভোলায় জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ হিসেবে কর্মরত। পুলিশের রমনা অঞ্চলের উপ-কমিশনার (ডিসি) নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ইডেন মহিলা কলেজের সামনে থেকে একটি মাইক্রোবাস ও ফেনসিডিলসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। মাইক্রোবাসটিতে ৩৪২ বোতল ফেনসিডিল ছিল। তিনি মাইক্রোবাস চালিয়ে যশোর থেকে ঢাকায় আসেন। তাঁর কাছে গুলিসহ একটি পিস্তলও পাওয়া গেছে। তবে পিস্তলটি লাইসেন্স করা বলে থানায় সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন জাবেদ ইমাম। জাবেদ ইমাম বলেন, ‘টাকার পাওয়ার শর্তে যশোর থেকে মাইক্রোবাস চালিয়ে ঢাকায় এসেছি। সেখানকার সুমন নামের একজন ঢাকার লিংকন নামের আরেকজনের কাছে এগুলো পৌঁছে দিতে বলেছিল।’

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি যখন এই তখন কি কেউ সত্যিকার অর্থে বুক চিতিয়ে বলতে পারেঃ “এই দেশ আমার অহংকার, আমি জন্মেছি এই দেশে, এই দেশে জন্ম নিতে পেরে আমি গর্বিত, আমি গর্বিত বাংলাদেশী”? বিশ্ব মানবের চোখ চোখ রেখে কেউ কি বলতে পারবে “Im a proud as a Bangladeshi”? জানি অনেকেই পারবেন না, যেমনটি পারেননি আমার এক কানাডা প্রবাসী সিনিয়র বন্ধু, যার নাড়ী পুঁতা আমাদের এই বাংলাদেশে, যিনি প্রমিত বাংলায় গড়গড় করে কথা বলেন, বাংলাতেই কবিতা লেখেন, ঘুমোঘোরেও বাংলায় স্বপ্ন দেখেন। একটা সময় তিনি বাংলাদেশ বিমানের এয়ার হোস্টেজ হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশী হিসেবে গর্ব বোধ করতে না পারলেও একজন কানাডিয়ান হিসাবে ঠিকই গর্ব করতে পেরেছেন যথার্থ কারণেই। তিনি তার ফেসবুকের স্ট্যাটাসে একদিন লিখলেন “Our city mayor ROB FORD has been removed by judges order. It was only 3000 dollar (2 lac 50 thousands bdt ) he transfered to his charity. A small amount. (কত হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করেও কোনো কোনো দেশে জায়েজ হয়ে যায় ) Its CANADA. Truth speaks here. Justice speaks here. I m a proud as a CANADIAN!! LONG LIVE CANADA. তার এই স্ট্যাটাস দেখে প্রথমেই আমি বেশ ধাক্কা খেলাম, কিছুটা প্রতিবাদী হয়ে একটা মন্তব্যও করলাম। তিনিও আমার মন্তব্যের উত্তরে আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও নানান রকম দুর্নীতির উদাহরণ টেনে তারপক্ষে যুক্তি দাঁড় করালেন। সত্যিকার অর্থে আমি তার যুক্তির কাছে দাঁড়াতে পারিনি, তার যুক্তি খন্ডন করার মতো কোন কিছুই যে আমার কাছে নেই। তবুও তাল গাছটা আমার নীতিতে বললাম “আমি গর্বিত বাংলাদেশী” তারপর বাধ্য হয়েই আমাকে চুপ করে থাকতে হলো।

আমরা অনেক কিছুতেই চুপ করে থাকলেও বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সরব হয়ে উঠি। আমাদের এই সরবতা উন্নত জীবন যাপনের আশায় দেশ ছেড়ে পালানোর। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়াসহ উন্নত বিশ্বের দরজা যদি আমাদের জন্য মুক্ত হয়ে যেতো তবে আমার মতে আমাদের দেশের দুই তৃতীয়াংশ লোক এই দেশ ছেড়ে চলে যেত। তারপরও যে যেভাবে সুযোগ পাচ্ছে সে-ই দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। কারণ আমরা সবাই জানি আমাদের এই দেশে মানুষের মৌলিক চাহিদার কোন নিশ্চয়তা নেই। এখনো অনাহারে অর্ধাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরছে শত সহস্র বাংলাদেশী; এখনো বস্ত্রের অভাবে লজ্জা ঢাকতে পারছেনা অনেকেই কিংবা শীত বস্ত্রের অভাবে বিভিন্ন স্থানে মৃত্যুর খবর ভেসে আসে পত্রিকার পাতায় কিংবা টেলিভিশনের পর্দায়; এখনো লাখো বাংলাদেশী ফুটপাতে খোলা আকাশের নীচে মানবেতর জীবন যাপন করছেন; আমাদের শিক্ষাঙ্গন আজ কলুষিত, রাজনীতি, সন্ত্রাসী, দখলবাজি, চাঁদাবাজির ও নানান রকম অপরাধের কালো থাবায়, শিক্ষকদের কাছেও আজকাল শিক্ষার্থীরা নিরাপদ নয়, স্বীয় শিক্ষক দ্বারাই আজ শিক্ষার্থীরা ধর্ষিত হচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে, শিক্ষকরাও সমান তালে প্রকাশ্যে নানান অপরাধে নিজেদের জড়াচ্ছে; চিকিৎসকেরাও আজকাল চিকিৎসা সেবাকে মহৎ পেশা হিসেবে দেখছেন না তারাও রাজনীতিবিদ হয়ে উঠছেন, চিকিৎসা সেবার চাইতে তারা দলা-দলি, মিছিল মিটিং, জ্বালাও পোড়াও, ঘেরাও ইত্যাদি কর্মকান্ডতেই নিজেদের বেশি দেখতে চাচ্ছেন। তাই আমাদের সাধারণ মানুষের জীবন যাপনের মান বাড়েনি, এখনো অবর্ণনীয় নিম্ন পর্যায়ে রয়ে গেছে। তবে মান না বাড়লেও সাধারণ মানুষের জীবনের দাম বেড়েছে! আগে কোন দূর্ঘটনায় পতিত হয়ে সাধারণ কেউ মারা গেলে একটা ছাগল দিয়ে নিহত ব্যক্তির জীবনের মূল্য নির্ধারণ করা হতো আজ তা বেড়ে দুই লাখে উন্নীত হয়েছে, ভবিষ্যতেও সাধারণ মানুষের জীবন যাপনের মান বা বেঁচে থাকার নিরাপত্তা না বাড়লেও ধাপে ধাপে নিহত ব্যক্তির দাম বাড়বে এটা বুঝা যায়। দেশের অবস্থা যখন এই তখন কে-ই বা বুক চিতিয়ে বলতে পারবে “আমি জন্মেছি এই দেশে, জন্ম আমার স্বার্থক, আমি স্বার্থক বাংলাদেশী, আমি গর্বিত বাংলাদেশী?”।

তারপরও আমি বাংলাদেশী, জন্মেছি এই বাংলাদেশে। এই দেশের মাটির উপর ভর করেই হাঁটতে শিখেছি, চল্লিশ বছর আগে আমার পূর্বসূরীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল আমার গায়ে না লাগলেও এই দেশের আলো বাতাস গায়ে মেখে বড় হয়েছি। তৃষ্ণায় যখন বুকের ছাতি ফেটে যাবার যোগাড় হয় তখন এই দেশের জল পান করেই তৃষ্ণা নিবারণ করি, এই দেশের মাটি থেকে উৎপাদিত ফল-ফসল খেয়ে এখনো জীবন ধারণ করে আছি, এই ঋণও কখনো শোধিবার নয়। লাখো শহীদের রক্তে, লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমে অর্জিত আমাদের এই প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে পাকিদের ফেলে দেয়া বীর্যের উচ্ছিষ্ট থেকে উৎপাদিত বেজন্মারা যতই গাল মন্দ করুক যতই ভর্ৎসনা করুক, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোরেরা দেশটাকে যতই ধ্বংসের পথে নিয়ে যাক আমরা ততই এই দেশটাকে আগলে রাখতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই দেশটাকে গড়তে চাই, স্বাধীনতা ও বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ সবার ঘরে ঘরে পৌছে দিতে চাই। এবার শুধু আমাদেরকে সুযোগ দাও, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস আমাদের হাতে তুলে দাও, আমরা সঠিক ভাবে দেখতে চাই কিভাবে নিজের জীবন তুচ্ছ করে দেশ মাতৃকার তরে তরতাজা জীবন হাসি মুখে বিলিয়ে দেয়া যায়। গ্রেনেড নয়, বোমা নয়, স্ট্যান গান নয় আমাদের হাতে ন্যায় নীতি আর সততার অস্ত্র তুলে দাও। এই অস্ত্র দিয়ে দেশকে আরো একবার স্বাধীন করতে চাই। পৃথিবীর বুকে এই দেশটাকে সত্যিকার অর্থে একটা বসবাসযোগ্য দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন জন্ম নেয়ার পর পরই বুক ফুলিয়ে বলতে পারে, স্বার্থক জন্ম আমার জন্মেছি এই দেশে। এই দেশ আমার, আমি গর্বিত বাংলাদেশী।

জবরুল আলম সুমনঃ গবেষক ও প্রাবন্ধিক।।

অতিথি লেখক