গণজাগরণঃ এক বহুমাত্রিক প্রতিবাদ

গণজাগরণঃ এক বহুমাত্রিক প্রতিবাদ

সৈকত রুশদীঃ একটি জাতির বিয়াল্লিশ বছরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ও বেদনার এই স্বতস্ফূর্ত বহি:প্রকাশ এক কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সূচিত হলেও, আমাদের উত্তর প্রজন্মের নেতৃত্বে এই অভূতপূর্ব গণজাগরণ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিকামী বাঙালিদের ওপর হত্যা, ধর্ষণ, অত্যাচার, লুন্ঠন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক সামগ্রিক প্রতিবাদ । বহুমাত্রিক এই প্রতিবাদ পাকিস্তানী, অবাঙালি ও বাঙালি যুদ্ধ অপরাধীদের এতোদিন বিচার না করা এবং তাদেরকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসনে রাখা ভূমিকার বিরুদ্ধেও । এই গণ জাগরণ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণ আদালতে যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের ধারাবাহিকতায়, সেই গণ আন্দোলনকে ছাপিয়ে আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গেছে । হৃদয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে ধারণ করা বাঙালি আছেন পৃথিবীর যে প্রান্তেই, সেখানেই পৌঁছে গেছে শাহবাগ স্কোয়ার বা প্রজন্ম চত্বরের গর্জন। তিন মিনিটের নীরবতার মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম গোটা দেশকে স্তব্ধ রেখে যে মৌলিক অহিংস বার্তা পৌঁছে দিয়েছে যুদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে, তা বিশ্বকে বিমূঢ় করেছে সন্দেহ নেই । ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারী থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে গণ অভ্যুত্থানকে প্রত্যক্ষ করেছিলাম বালক বয়সে, সুদূর টরন্টো থেকেও আমার মনে হচ্ছে এবারের গণজাগরণ তার চেয়েও সুসংহত ও উদ্দীপনাময় অথচ শান্তিপূর্ণ। ব্যক্তিগতভাবে আমি কৃতজ্ঞতা বোধ করছি সেই সব তরুণদের প্রতি যাঁরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে প্রথম উদ্যোগ নিয়েছেন এই গণ জাগরণের সূচনার, বিগত আট দিন ধরে অব্যাহত রেখেছেন আমাদের চেতনার জাগরণ এবং আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন শাহবাগে এই সমাবেশের নির্দলীয় চারিত্র্য ধরে রাখার জন্য । সর্বোপরি, হৃদয়ে বাংলাদেশের প্রতি মমত্ব এবং যুদ্ধ অপরাধীদের প্রতি ঘৃণা ধারণ করে রাখা আমার মতো জেগে জেগে ঘুমানো পূর্বসুরী বাংলাদেশের কয়েক প্রজন্মের ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য। এখন ঘুম ভাঙ্গছে জেগে জেগে ঘুমানো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও সাংসদদের, যুদ্ধ অপরাধীদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী বিএনপি নেতৃত্বের, প্রতিটি শ্রেণী ও পেশার মানুষের, এমনকী অন্তরালবাসিনী জননী ও জায়াদেরও ! নতুন দীক্ষায় উদ্দীপিত হয়ে উঠছে কিশোর-কিশোরী, বালক-বালিকা ও শিশু, যেভাবে উদ্দীপিত হয়েছিলাম ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।

এই গণজাগরণের প্রাথমিকসাফল্যের অর্জন দীর্ঘস্থায়ী করা তখনই সম্ভব হবে যখন বর্তমান ও আগামী সকল সরকারকে বাধ্য করা যাবে একটি গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে দল ও অবস্থান নির্বিশেষে সকল যুদ্ধ অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করা । যে বিচারের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের প্রচেষ্টা থাকবেনা এবং বিচার পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে না । যেখানে রাজনৈতিক কারণে দেশপ্রেমিক ও রাষ্ট্র দ্রোহীর সংজ্ঞা বদলের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না। জেগে ওঠা মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় আগামীর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই গণ জাগরণ যেন এক স্থায়ী চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে সেই প্রত্যাশায় থাকবো।

সৈকত রুশদীঃ সাংবাদিক, বেতার ও টেলিভিশন ভাষ্যকার, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কবি ও পুরষ্কারে ভূষিত লেখক। বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মিডিয়া ইনটেলিজেন্স প্রতিষ্ঠান সিশন-এ ইভ্যালুয়েশন এডিটর (মূল্যায়ন সম্পাদক) হিসাবে কর্মরত আছেন কানাডার টরন্টো নগরীতে ।

[লেখাটি এই দেশ ব্লগ থেকে সংগৃহীত]

অতিথি লেখক