আমিও একজন ব্লগার, আমাকে নিরাপত্তা দিন…

আমিও একজন ব্লগার, আমাকে নিরাপত্তা দিন…

মোমিন মেহেদীঃ আহমেদ রাজীব হায়দার। ব্লগার হিসেবে বাংলাদেশের অনলাইন-এ, ব্লগে যার উপস্থিতি ছিলো বাঘের মত। ক্রমশ সাহসের সাথে যিনি নির্মাণ করেছিলেন সত্যকথার স্যালুলয়েড। সেই সাহসের সূত্রধরকে সরিয়ে দিয়েছে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ইসলাম এবং তাদের সমর্থক গোষ্ঠি ছাত্র শিবিরের হায়েনারা। কেননা, নিরন্তর এগিয়ে আসছিলেন নতুনধারা’র এই ব্লগার। তিনি নিজেকে কখনোই আপোষের রাস্তায় পরিচালনা করেননি। বরং রাত পৌনে ১১টায় তার মৃত্যুর নির্মম খবর প্রকাশ হওয়ার মাত্র আট ঘণ্টা আগেও তিনি  ফেসবুকে ছিলেন। সাহসের সাথে লিখেছিলেন জীবনময় যুদ্ধের কথা। বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া তার সর্বশেষ স্ট্যাটাসটিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘কোথায় কিভাবে বর্জন করতে হবে তার রুপরেখা নির্ধারন করাটা খুব জরুরী। কারন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোথায় নেই তারা…
একটা বাদ দিয়ে অন্যটাতে যাব, সেখানেও তাদের সেবাই নিতে হবে! আজকে যে ইন্টারনেট সেবা নিয়ে আমরা অনলাইনে আন্দোলন করছি তার মধ্যেও তো জামাতি অংশ আছেৃ তার মানে কি সর্ষেতে ভূত নাকি আমরা পয়সা দিয়ে নেটের বাইটস কিনছি বলে সেটা সিদ্ধ! একটু চিন্তা করা দরকার…
একটা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন খুব জরুরি! কারন জামাতি প্রতিষ্ঠান বলে যাদের বয়কট করবো, তার মালিকানা রাতারাতি বদলে যেতে পারে… সিম্পল শেয়ার আদান প্রদানেই মালিকানা বদলে যাবে! তবে আমার জায়গা থেকে একটা জিনিস আমি বলতে পারি, পরিচিত জামাত সংশ্লিষ্ট পন্য ও প্রতিষ্ঠান যার যার জায়গা থেকে বর্জন করুন, যেমন তাদের মূল কাগজ সংগ্রাম বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-কোচিং ও তাদের সাংস্কৃতিক সংগঠন!’
মানুষ কতটা সাহসী হলে বলতে পারে যে, বদলে যেতে পারে মালিকানা! এতটা সাহসী একজন মানুষের নিরাপত্তা দিতে ব্যার্থ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। কেননা, তারা চায় ক্ষমতা; জনতা নয়। যদি জনতা চাইতো, তাহলে জামায়াত-শিবিরের হরতালের পরপরই দেয়া রায়-এ কুখ্যাত কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন হতো না। হতো ফাঁসি। অথচ তা হয়নি। হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদেরকে বাঁচানোর রায়। যা ব্লগাররাই প্রথম মানেনি। রাজপথে নেমেছে জোয়ারের মত। সেই জোয়ারে যোগ হয়েছে দেশের নতুন প্রজন্ম। যাদের চোখ একাত্তর দেখেনি; কিন্তু দেখেছে তেরো, ২০১৩। সেই তেরোতেই আমরা আমাদের একজন নিবেদিত যোদ্ধাকে হারিয়েছি। এই হারানোর মধ্য দিয়ে আমরা একাত্তরে হারানো বুদ্ধিজীবি শহিদুল্লাহ কায়সার-জহির রায়হান-মুনীর চৌধুরী প্রমুখের কথা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি। সেই সাহসী দিনগুলোতে বাংলাদেশ যেভাবে বুদ্ধিজীবি হরিয়েছিলো; ঠিক একইভাবে বর্তমানে হারাতে বসেছি…
আমি ছাত্র রাজনীতি করেছি, শ্রমিক রাজনীতি করেছি, এখন নিবেদিত আছি নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক দল নতুনধারা বাংলাদেশ(এনডিবি)’র সাথে। তবে সবার আগে আমার পরিচয় আমি একজন ব্লগার। পাশাপাশি সাংবাদিক-রাজনীতিক। যেহেতু প্রথম পরিচয় আমার ব্লগার; সেহেতু ব্লগার হিসেবে; সত্য কথা লেখার খেসারত হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক হায়েনা জামায়াত-শিবিরের নেতারা যে কোন সময় আমাকে খুন করতে পারে বলে আমি সন্দিহান। অতএব, আমাকে নিরাপত্তা দেয়ার জোর দাবী জানাচ্ছি-শাহবাগ স্কয়ারের এই গণ আন্দোলনের সাথে লোক দেখানো একাত্মতা পোষনকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। যিনি জনতা নয়; ক্ষমতা পেতে মরিয়া হয়ে উঠছেন ক্রমশ…
এখন একটা বিষয় আরো স্পষ্ট করে বলি, কথাটি হলো- আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে সাড়ে ৪ বছর। ক্ষমতার ৪ বছর তারা বারবার চেষ্টা করেছে জামায়াতকে মহাজোটে আনার জন্য। আর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে যুদ্ধাপরাধী-জামায়াতের নেতাদেরকে। কিন্তু জামায়াত-শিবির আসেনি জোটে। যে কারনে একান্তই নিরুপায় হয়ে এখন রায়-এর পথে অগ্রসর হয়। যখন রায় হতে থাকে, তখন জামায়াত-শিবির পাগলা কুকুরের মত নেমে যায় আমাদের রাজপথে-আমাদের রঙিন সকালে অন্ধকারের কালো নিয়ে। এসব দেখে ভয়ে ভীত আওয়ামী লীগ ট্রাইবুনালকে প্রভাবিত করে বিচারের রায়কে প্রভাবিত করে। যে কারনে দেড় শতাধিক খুন-ধর্ষণের আসামী কসাই কাদেরের মত জঘণ্য পশুর বিচারের রায় হয় যাবজ্জীবন। এরপর যখন ব্লগাররা রাজপথে নামে রায়ের বিরুদ্ধে-ফাঁসির জন্য। ঠিক তখন সেই সুযোগটাও লুফে নেয় আওয়ামী লীগ। তবে বদলে নেয় কৌশল। ব্লগাররা হয়ে যায় চেতনার ঘুড়ি। লাটাই থেকে যায় আওয়ামী লীগ পরিচালিত মহাজোট সরকারের-ই হাতে। যে কারনে নতুন প্রজন্ম প্রত্যয়ের সাথে পথ হাঁটলেও প্রত্যাশা পুরনে ঘটছে বিলম্ব। অথচ হওয়া উচিৎ ছিলো- ট্রাইবুনাল সংশোধন করে সাথে সাথে ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন। কিন্তু না, তা হচ্ছে না। যা হচ্ছে, তা হলো আঁতাত। আমি এর আগেও একটি লেখায় বলেছিলাম যে, আওয়ামী লীগ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের আদর্শ থেকে সরে ক্ষমতার রাজনীতি এবং আদর্শে দাড়িয়েছে। যে কারনে নিতান্তই ক্ষমতার জন্য আঁতাত করছে দেশ বিরোধীচক্র-যুদ্ধাপরাধী –জামায়াত-শিবিরের সাথে। যদি তাই না হবে বাংলাদেশে কেন এখনো ইসলামী ব্যাংক-এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ হচ্ছে না; পাশে আবারো বিশ্বকাপসহ বিভিন্ন বড় বড় আয়োজনে ইসলামী ব্যাংকে মুুনাফা(চড়া সুদের)র টাকা থেকে উত্তোলিত অংশ স্পন্সর হিসেবে নেবে বলে বলে? কেন ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল-ইবনে সিনা হাসপাতাল বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে না; এসব হাসপাতালে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-সেচ্ছাসেবক লীগ ঠিকাদারি করে বলে? কেন আল মানারাত-বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়-ইসলামী ব্যাংক স্কুল এন্ড কলেজ বন্ধ হচ্ছে না; আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এখান থেকে উৎকচ পায় বলে? কেন রেটিনা-ফোকাসসহ শতাধিক শিবির পরিচালিত কোচিং এখনো সচল রয়েছে; ছাত্রলীগ মোটা অংকের চাঁদা পায় বলে? কেন এখনো আধুনিক-পাঞ্জেরী-সিদ্দিকীয়া-প্রীতি-আমীর-মদীনা-ঐতিহ্য-পাঞ্জেরীসহ শতাধিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নিষদ্ধ করা হচ্ছে না; আওয়ামী লীগের অনেক নেতার বই এরা প্রকাশ করে বলে? কেন মিশন- কেয়ারী সান- রোজ সিটি- নাসিম সিটি-আল ফালাহ সিটি-আদর্শ সিটি-সুরমা সিটি নিষিদ্ধ হচ্ছে না; আওয়ামী লীগ নেতারা এইসকল জামায়াতি ডেভলপার ও জমির কোম্পানী থেকে প্লট ও ফ্ল্যাট পাচ্ছে বলে? কেন দিগন্ত টিভি-ইসলামী টিভি বন্ধ হচ্ছে না; আওয়ামী লীগের বড় বড় রাঘব বোয়ালরা এই টিভিতে শেয়ার আছে বলে? কেন নয়া দিগন্ত-সংগ্রাম-সোনার বাংলা- সত্যের আলো-নতুন কিশোর কন্ঠ-ছাত্র সংবাদ-কানামাছি-সংস্কার-নতুন কলম-ফুলকুঁড়ি-ডাকপিয়ন-লাটাই-ফররুখ একাডেমী পত্রিকা, লাল সবুজের দেশ-টিনএটটিন নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না; আওয়ামী লীগ নেতাদের কাভারেজ বন্ধ হবে বলে? যদি তাই হয়; তাহলে আর এত নাটক করার কি প্রয়োজন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে পরিবর্তন করে বাংলাদেশ জামায়াত লীগ বানিয়ে নিলেই পারে। তাতে করে প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের দখলে থাকলো; সাথে সাথে শিবির-জামায়াতের হায়েনারা থাকলো ফ্রী…
এত দুঃখ, এত কষ্ট, সে কেবল আওয়ামী লীগের কারনেই ঝুলে আছে বাংলাদেশের কপালে-বাংলাদেশের মানুষের কপালে। প্রশ্ন আসতে পারে কিভাবে? উত্তরে বলবো সব ভাবেই। যেমন- একাত্তরের পর ক্ষমার রাজনীতি, পঁচাত্তরের পর ভয়ের রাজনীতি, আশির পর আপোশের রাজনীতি, ছিয়াশির পর মোহের রাজনীতি, নব্বইয়ের পর দূর্নীতির রাজনীতি এবং এরপর থেকে বর্তমান পর্যন্ত কেবলমাত্র ক্ষমতার রাজনীতি। না জনতার, না কল্যাণের; কেবলমাত্র খাই খাই, দাও দাও করতে করতে তৈরি হয়েছে আওয়ামী অন্যরকম হায়েনার দল হিসেবে। যাদের মিশন টাকা-ভীশন ক্ষমতা। আর এ কারনেই আজ জন্ম নিয়েছে শাহবাগ স্কয়ার; জেগেছে জনতা-তারুণ্য-নতুনধারা… এই জাগরনের প্রথম শহীদ আহমেদ রাজীব হায়দার। আমি মনে করি অনলাইনে যে যুদ্ধ চলছে; সে যুদ্ধে অন্যতম এই যোদ্ধার জীবন কেড়ে নেয়ার পর আর কারো বসে থাকার সুযোগ নেই। নামতে হবে বাংলাদেশের প্রতিটি তরুণকে। যাদের ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব থাকলেও। সরকার সেই দায়িত্ব থেকে সরে এখন নিজেদের রাজনীতি আর ক্ষমতার তপস্যায় নিয়োজিত হয়েছে। এই কারনে অবশ্য সমস্যার রাস্তায়ও এগিয়েছে আওয়ামী লীগ। আজ দেশের মূল স্থানটি বন্ধ করে যুদ্ধাপরাধী-জামায়াত নেতাদের ফাঁসির সাথে সাথে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা বন্ধের দাবীতে আন্দোলন চলছে; কাল হয়তো তৈরি হবে বাংলাদেশ বাঁচানোর আন্দোলন; সেই আন্দোলন আওয়ামী লীগের পতনও নিয়ে আসবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমি দেখেছি , ব্লগার বন্ধুর নৃশংসভাবে খুনের খবর ছড়িয়ে পড়ালে মধ্যরাতেই উত্তাল হয়ে উঠে শাহবাগ স্কয়ার শ্লেগান ধরা হয়, ‘খুন হয়েছে আমার ভাই, জামায়াত-শিবির রক্ষা নাই’, খুন হয়েছে আমার ভাই, খুনি তোদের রক্ষা নাই’। মঞ্চ থেকে খুনিদের গ্রেফতারে আল্টিমেটাম ঘোষণা করা হয়। এদিকে তার মৃত্যুতে প্রজন্ম চত্বরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাত ১১টা ২২ মিনিটে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। খুনিরা এতটাই পরিকল্পিতভাবে ঘটনাটা ঘটিয়েছে যে, জীবনের একটি টার্নিং পয়েন্টে থাকা রাজিবকে কোন সুযোগ-ই দেয়নি বেঁচে থাকার। স্থপতি ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট রাজিবকে প্রথম থেকেই শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গণআন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকতে দেখেছি। সেই সাহসী তরুণের লাশ বাসার কাছেই পলাশনগর প্রধান সড়কের পাশে পড়ে ছিল। পাশে পড়ে ছিল তার ল্যাপটপ। তাঁর মাথা আলাদা, দেহ আলাদা করা লাশটি যতবার দেখেছি মনে হয়েছে সবটুকু সাহস সঞ্চয় করে বলি- ‘আমাদের একজন ব্লগার রাজিবকে খুন করা হয়েছে। কী করে জামায়াত-শিবির এতো সাহস পায়। আমরা মরি আর বাঁচি রাজপথ ছাড়বো না। আমরা গত ১১ দিন থেকে এখানে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা কোনো বিপ্লব চাই না। আমরা আমাদের দাবি পূরণ করেই বাড়ি ফিরবো। নয় মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হয়েছে, প্রয়োজন হলে নয় মাস কেনো নয় বছর রাস্তায় থাকবো। দরকার হলে রাস্তায় মরে যাবো। কিন্তু দাবি আদায় না করে রাজপথ ছাড়বো না। আমাদের আন্দোলন চলতেই থাকবে…

মোমিন মেহেদী : কলামিস্ট ও আহবায়ক, নতুনধারা বাংলাদেশ।।
Website: www.mominmahadi.com

অতিথি লেখক