জনতার সংগ্রাম চলবেই

জনতার সংগ্রাম চলবেই

মীর আব্দুল আলীমঃ দেশের তরুণ প্রজন্ম জেগেছে, গোটা বাংলাদেশ আবার জেগেছে, এ যেন আরেক একাত্তর । যার মোহনা বা কেন্দ্রবিন্দু এখন রাজধানী ঢাকার শাহবাগ। গত এক সপ্তাহ ধরে তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার। তারা সস্নোগানের পর সস্নোগান দিয়ে যাচ্ছে। গান পথনাটক মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র প্রদর্শন, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, নানা পোস্টা-ব্যানার ইত্যাদির মাধ্যমে বার বার জানান দিচ্ছে এ দেশে রাজাকার আল বদর আল শামসদের কোনো স্থান নেই। বিচার তাদের হবেই, ফাঁসিতে তাদের ঝুলতেই হবে। দেশের সর্বস্তরের মানুষ শাহবাগে এসে সংহতি জানিয়েছে তরুণ প্রজন্মের এই গণআন্দোলনের সঙ্গে। এ কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ‘৭১-এ রাজাকাররা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে অপরাধী। ধর্ষণ, হত্যা, লুটপাট- কী করেনি তারা? যুদ্ধাপরাধীরা মানবতাবিরোধী কাজ করেছে। মস্ত অপরাধ করেছে তারা; আর স্বাধীনতার পর ৪২ বছর ধরে আমরা (রাষ্ট্র) ওই রাজাকারদের যতœ করে লালনপালন করে আসছি। আগামী দিনের জন্য রীতিমতো রাষ্ট্রের ক্ষমতায় বসানোর উপযুক্ত করে তুলেছি এই রাজাকার আলবদরের দলকে। যা হচ্ছে; যা দেখছি তাতে মসনদে জামায়াত এই বসলো বলে! তাহলে আমরা অপরাধী নইতো কে অপরাধী? যারা আমাদের স্বজনদের হত্যা করল, যারা আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত লুটে নিল তাদের পালন করেছি ও প্রশ্রয় দিয়েছি আমরা। রাজাকারদের লালনকারী ও প্রশ্রয়দানকারী হিসেবে আমরা কিছুতেই নির্দোষ হতে পারি না। আমরাও একই অপরাধে অপরাধী। আমাদেরও ফাঁসি হওয়া দরকার।
আজকের প্রেক্ষাপটে যদি বলি রাজাকার আলবদরের দল জামায়াত দ্বিতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল! ভুল হবে আমার? কখনই না। মুক্তিযোদ্ধার স্বপক্ষের আওয়ামী লীগ দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল, সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যোগ হলে আওয়ামী লীগকেই এ মুহূর্তে প্রধান বৃহৎ রাজনৈতিক দল বলতে হয়। তাহলে দ্বিতীয় কারা? বিএনপি? না! হাল সময়ে যা দেখছি তাতে জামায়াতকেই তো দ্বিতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল মনে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কিছুটা পিছিয়ে আছে বইকি। যাই হোক কে বড় কে ছোট তা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। জামায়াতকে তো বিএনপিই এ স্থানে আনতে সহযোগিতা করেছে। আওয়ামীপন্থীরা যারা মহাখুশি হয়েছেন দোষটা বিএনপির ওপর চাপিয়ে দিলাম বলে। তাই না? এই রাজাকার আলবদরদের এতটা পথ এগিয়ে দেয়া পেছনে আওয়ামী লীগও কিন্তু কম অপরাধী নয়। যদি বিএনপিকে জামায়াতের সহযোগী বলি তাহলে আওয়ামী লীগকে বলব না কেন? ৪২ বছর আওয়ামী লীগ কী করেছে? তারা দেশকে রাজাকারমুক্ত করতে পারেনি কেন? রাজাকারদের বিচার এত বিলম্ব হলো কেন? ওরা কেন এতটা বছর মুক্ত ছিল? বলতে দ্বিধা নেই, ওদের লালন-পালন আওয়ামী লীগও কম করেনি। তবুও এই রাজাকারদের বিচার শুরু করায় মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপক্ষের দলটিকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। এবার তারা ক্ষমতায় এসে পাপ মোচনের কাজটি হাতে নেয় বেশ শক্ত হাতেই। ভালোই চলছিল এ যাবৎকাল। বাচ্চু রাজাকারের বিচার এবং তার ফাঁসির আদেশে উল¬াসিত হয় দেশবাসী। পক্ষান্তরে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি কুখ্যাত রাজাকার কসাই কাদের মোল¬ার বিচারের রায় হলো, রায়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হলো। এই রায়ে দেশবাসী মোটেও খুশি হতে পারেনি তবে নতুন বাংলাদেশকে দেখার সুযোগ করে দিল এ রায়। রায় ঘোষণার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ফেসবুক স্ট্যাটাসে ক্ষোভ প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলা বস্নগ সাইটগুলোয়ও বস্নগারদের পোস্টগুলো এই রায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকে। মনে হলো ঘুমিয়ে থাকা বাংলাদেশ যেন জেগে উঠেছে, গর্জে উঠেছে বাংলাদেশ। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে দিন দিন আন্দোলনে নতুন নতুন মাত্রা যেমন যুক্ত হচ্ছে, তেমনই বাড়ছে তার পরিধি। এ আন্দোলন শুধু বাঙালিকে প্রাণের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করেনি, উন্নত সংস্কৃতির পতাকাও তুলে ধরেছে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে, ভাড়া করে আনা লোক ছাড়াও হাজারো মানুষ মিছিলে কণ্ঠ মেলাতে পারে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-উঁচু-নিচু সব বিভেদ ভুলে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়া যায়— তা জানিয়ে দিল আরো একবার প্রজন্ম চত্বর। ‘¯ে¬াগান দিতে গিয়ে…নিজের খেয়ে বনের মেষ তাড়ানো’ প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সেই গানের প্রতিচ্ছবি দেখেছি শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনকারীদের চোখেমুখে। রুচিশীল ও উন্নত সংস্কৃতির পুনরুদ্ধারের এ আয়োজনের জন্য তাারুণ্যের প্রতি লাল সালাম; জয়তু যৌবনের ডাক।
৪১ বছর ধরে দেশের শুভাকাঙ্খী ও আপামর মুক্তিকামী মানুষ যে জাগরণ চেয়েছিলেন তা যেন একটা নতুন সূর্যের প্রভাতের মতোই জেগে উঠল এ দেশে। এ গণজোয়ার এখন কেউ রোধ করতে পারবে না। আওয়ামী লীগও না। কোনো রাজনৈতিক সমর্থন, নেতৃত্ব বা দলপতি ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লাখ লাখ মানুষের রাজধানীর শাহবাগে মহাসমুদ্র রচনা করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে । এই কৃতিত্বের অধিকারী একাত্তরের চেতনায় জাগ্রত দেশের তরুণ সমাজ। তাদেরকে আমার অভিবাদন। পাল্টে দিয়েছে রাজনীতির সব হিসাব-নিকাশ। মহাসমুদ্রের মহাগর্জন প্রত্যক্ষ করার পর বাঙালির কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত কবিতার পঙ্ক্তিখানি- ‘এই যৌবনজলতরঙ্গ, রুধিবি কী দিয়া বালির বাঁধ’? হুমকি-ধমকি, জ্বালাও-পোড়াও হরতাল-অবরোধ কিছুতেই যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্যেও ব্যাঘাত ঘটাতে পারবে না, তা দেশেবাসী বুঝে গেছে। তাদের বিচারকার্য বন্ধ হওয়া মানেই যে আবারো একটা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। শুধু রাজধানীই নয়, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া- সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মুখেই একটি নাম- সারাদেশকে কাঁপিয়ে তোলা স্বাধীনতা প্রজন্ম চত্বর। কেউ কেউ বিলম্ব বিচারের প্রশ্ন তুলে বলছেন, ‘এতটা বছর পার হয়ে গেল; কী হবে আর বিচার-টিচার করে।’ তাদের উদ্দেশ্য করে বলব বিলম্ব বিচার কোনো বিষয় নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনো চলছে। তাই বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদেরও অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে অনেক আগে থেকেই চলছিল দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করতে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে স্বাধীনতাবিরোধীরা ছিটিয়েছে শত শত কোটি টাকা। দেশের রাজপথে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবিরের সহিংস তান্ডব, পুলিশের ওপর হামলা, পুলিশ হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও প্রত্যক্ষ করে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল দেশের মানুষ। স্বাধীনতাবিরোধীরা ভেবেছিল সহিংস পথেই তারা যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করবে। কিন্তু মৃত্যুদন্ড না দিয়ে একাত্তরের কুখ্যাত ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল¬ার যাবজ্জীবন দন্ডের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা নতুন প্রজন্মের দ্রোহের আগুনে পাল্টে গেছে সেই পরিস্থিতি। এমন রায়ে গোটা দেশবাসী মর্মাহত, ব্যথিত ও লজ্জিত।
সবার একটাই দাবি- যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই। নতুন প্রজন্মের এই আন্দোলনে রাজনীতি না থাকলেও তাদের বুকে জ্বলে ওঠা আগুন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠেছে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের হাইকমান্ডে। কোটি টাকা খরচ আর ক্লান্তিহীন প্রচার চালিয়েও তারা নিজেদের দলীয় কর্মসূচিতে নামাতে পারেনি জনতার ঢেউ। অথচ বিনা খরচে, প্রচার ছাড়াই জনসমুদ্রের মহাগর্জন দেখে স্বস্তিতে নেই দেশের তারকা রাজনীতিকরা। মুক্তিযুদ্ধ মানুষের মুক্তির চেতনা সার্বজনীন এবং বিশ্বজনীন। ইতিহাসে যুগে যুগে আমরা তা দেখেছি। মুক্তির সংগ্রাম বা যুদ্ধের স্বরূপ তাই দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে যাবেই। সহজবোধ্য কারণেই প্রতিটি জাতির মুক্তিসংগ্রামের কাহিনীই সেই জাতির ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু। সেটাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় প্রতিটি জাতি। তাই জাতির স্বার্থেই; ইতিহাসের স্বার্থেই দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে। যে কোনো মূল্যে রাজাকার মুক্ত করতে হবে দেশ। আমার বিবেক বারবার বলছে, ‘যাও প্রমাণ করে দাও, অন্যায়কারী যেই হোক, সময় যতই গড়িয়ে যাক, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। ১৬ কোটি শান্তিকামী মানুষের দেশে রাজাকারের ঠাঁই নাই, ক্ষমা নাই।’ দেশের ইজ্জত বাঁচাতে ওদের বিচার করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আসুন সবাই রাজপথে নামি। প্রয়োজনে আরো একটি যুদ্ধে শামিল হই আমরা। জয় হোক তারুণ্যের।
(লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সম্পাদক- নিউজ-বাংলাদেশ ডটকম।)
e-mail-newsstore09@gmail.com

অতিথি লেখক