শাহবাগ আন্দোলনঃ জনতার হৃদয়ের রিদম

শাহবাগ আন্দোলনঃ জনতার হৃদয়ের রিদম

মুনীব রেজওয়ানঃ

============================================================================

তোমার ঘরের চাল উড়ে গেছে ঝড়ে

তোমার জানালা, কপাট নড়বরে

তোমার চোকি ভাঙ্গা—

>>>

তুমি প্রথম কোনটা মেরামত করবে জানিনা—-

আমি সবার আগে  আমার ঘরের চাল মেরামত করব। এই মুহূর্তে আর কিছু বুঝিনা—

রাজাকারের বিচার এবং তার সর্বোচ্চ শাস্তি।

‍‍‍~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

কাদের মোল্লার বিচারের রায় ঘোষিত হবার সাথে সাথেই তরুণ প্রজন্মের মনে অনেক সংশয় জেগে উঠতে শুরু করে। হচ্ছেটা কি? পাঁচ পাঁচটা ভয়ংকর অপারাধ প্রমাণিত হবার পরেও এই কসাইয়ের এতো লঘু শাস্তি হয় কি করে? বিচারক কি কোন চাপের সম্মুখীন? আওয়ামীলীগ কি ভিতরে ভিতরে জামাতিদের সাথে কোন আঁতাত করছে? তরুণ প্রজন্ম, ক্ষমতা বোঝেনা, নোংরা রাজনীতি বোঝেনা। এরা চেনে এদের প্রাণের দাবীটি। এরা দেখছে ৪২ বছর ধরে একটা ভয়ংকর অন্যায় জাতির কপালে কলঙ্ক তিলক হয়ে রয়েছে, এই ইস্যুতে পুরো জাতি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে, এই একটি মাত্র ইস্যুর কারণে আমাদের কোন জাতীয় ঐক্য নেই—তরুণেরা যা ভাবে তা করেও দেখায়। এরা বসে বসে ঝিমায় না! একজন দুজন করে সবাই নেমে আসতে শুরু করল শাহবাগে। ধীরে ধীরে এখন সেটি গণমানুষের আকাঙ্খার পক্ষে প্রতিবাদের মহাজাগরণ তীর্থ। মানুষের মহাসঙ্গম!! এই স্বতস্ফুর্ত গণজাগরণ যুদ্ধাপরাধীদেরদের বিরুদ্ধে, তাদের বিচারের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে মানুষের প্রাণের টানের মহাঐক্য।

শুরুতেই সবাই জানি এর বিরুদ্ধে চরম বিরোধিতায় নামবে জামাত—তারা বেছে বেছে একজন নাস্তিক ব্লগারকে খুন করল যার নাম থাবা বাবা (রাজীব হাসান) এবং পরিকল্পনা মাফিক ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরী করতে পারে এমন কিছু ব্লগ তারা বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় তুলে আনতে শুরু করল যে ব্লগগুলো এক বছর আগে প্রকাশের তারিখ দেখালেও নেটের কোন সার্চ ইঞ্জিণে, কোন আর্কাইভেই পাওয়া গেল না এমন কি একটি লেখাতেও কোন পাঠ প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না, বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয় এসব উদ্দেশ্যমূলক লেখা কেন হঠা প্রচার করা শুরু হল! পরের ঘটনাগুলো আপনারা সবাই জানেন।

জানা কথাই– এই আন্দোলনের তাপে পুড়তে থাকবে রাজাকারদের রাজনৈতিক মিত্র বিশেষত বাংলাদেশ জাতিয়তাবাদী দল। হলোও তাই—প্রথম দিকে এই গণজাগরণে যারা নিজের দল পরিচয় ভুলে একাত্ম হয়েছিল তাদের একটি অংশ ভেতরে ভেতরে  উপলব্ধি করতে শুরু করল–হায় হায়! আমার দল তো বিপদে পরে যাবে—এই অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের তারাই মন্ত্রী বানিয়েছিল, তাদেরই দলের প্রধান, দেশনেত্রী নিজেই তো কাদের মোল্লা, নিজামী, সাঈদি, কামরুজ্জামান–এদের নাম ধরে ধরে বলেছিলেন এরা যুদ্ধাপরাধী নয়—এদের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য। তাহলে উপায়?—শুরু হল বিএনপি থেকে সকাল বিকাল এলোমেলো বক্তব্য দেয়া আর বিভ্রান্ত হতে থাকল তাদের অনুগামী কিছু তরুণ যারা এসব ভাবনা শুরুতে মাথায় নেয় নি, প্রাণের টানে যোগ দিয়েছিল এই সমাবেশে—যদিও কাল দেখলাম বিএনপির অনুগামী কিছু তরুণ তারা রাজনৈতিক ভিন্নমত ভুলে গিয়ে এখনো এই প্রজন্ম জাগরণে একাত্ম, এদের একজন দেখলাম ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখেছে—সে বিএনপির রাজনীতিই ছেড়ে দিয়েছে আন্দোলন নিয়ে দলীয় ভূমিকা মেনে নিতে না পারায়-

সাইবার যুদ্ধ! ঘরে বসেই এই যুদ্ধে অনেকটা অংশগ্রহন সম্ভব। এবার সেই জাতীয়তাবাদী  তরুণেরা  অবলম্বন করতে শুরু করল সংশয় প্রকাশের নানাবিধ কৌশল—তাদের পক্ষে এই কাজটা করা সহজ হল এই জন্য যে শুরুতে না বুঝেই তারা এই আন্দোলনের একটা অংশ হয়ে গিয়েছিল—-তারা বুঝল —“প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনটিকে এখন আওয়ামীলীগের আন্দোলন” —এই রঙটা মেখে দিতে পারলেই কম্মটি সারা হয়।

শাহবাগের আন্দোলনে সংশয় তৈরীর কাজ শুরু হয়েছিল এর সুচনা লগ্নেই তবে খুব কায়দা করে। কারা করছিল? আপনিও জানেন রাজাকার এবং তাদের রাজনোইতিক মিত্রশক্তির ভীত নাড়ানো এই আন্দোলনে কেবল তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল—কাজে কাজেই জামাত এবং বিএনপিই এই আন্দোলনের বিপক্ষে থাকবে এই কথা একটি কোলের অবোধ শিশুও বোঝে। আপনারা সেই আলামত দেখতে শুরু করেছেন গত কিছুদিন ধরে। যারা অতি প্রগতিশীল, চোখ কান খোলা, মন খোলা মানুষ হিসেবে আপনাদের আশে পাশেই ছিলেন তাদের খোলা চোখ হঠাত করে ঘোলা হয়ে যেতে শুরু করল এবং রাজাকারের মিত্রশক্তি, দোসররা সরাসরি এবার এই সুযোগে এই আন্দোলনের বিরুদ্ধ শক্তির সকল ক্রিয়াকর্মে সমর্থন দেয়া (কদিন নীরব থাকার পর) শুরু করে দিল। সবচে খারাপ যে কাজটি করল এই অপশক্তি—-আমাদের জাতীয় পতাকা ছিঁড়ল, পোড়ালো, বিভিন্ন স্থানে আমাদের অস্তিত্বের শেকড় আমাদের শহীদ মিনার ভাঙ্গা শুরু করল। ভেবে পাইনা বিএনপি এদের সংগ কেন ছাড়তে পারল না? তারাও তো স্বাধীনতার পক্ষশক্তি হিসেবে নিজেদের দাবী করে । কেন পারল না এই আন্দোলনে একাত্ম হতে?

সে যাই হোক! আন্দোলন সংগ্রামে প্রতপক্ষের চেহারা স্পষ্ট থাকাই ভাল। আমরা আগেও জানতাম, এখনো জানি এই আন্দোলনের শত্রু কারা!

কেউ কেউ বেশ মজার তত্ত্বও নিয়ে হাজির হচ্ছেন–জামাতিদের নিষিদ্ধ করলে নাকি আওয়ামিলীগের ভোট কমে যাবে। এরচে হাস্যকর তত্ত্ব আর কিছু কি আছে??? হাসব নাকি কাঁদব বুঝতে পারছি না। এখানে আমরা বিচার চাইতে এসেছি নাকি কার ভোট বাড়ল কমল সেই ক্ষতিয়ান করতে এসেছি?

আমরা আওয়ামীলীগের ভাল মন্দ চিন্তা করতে এই যুদ্ধে শরীক হইনি তবে এই আন্দোলনে জামাত, বিএনপি এবং কিছু তথাকথিত ইসলামের সওদাগর এই সংহতি প্রকাশ তো দূরে থাকুক–সরাসরি বিরোধিতায় নেমেছে–এবং এটাই হবার কথা ছিল। সেই সাথে শংসয় প্রকাশ করে সরে যেতে শুরু করেছে এদের অনুগামীরা। আপনারা গত ক’দিন ধরে যাদেরকে খুব কনফিউজড দেখছেন ওরাই তারা —-

এখানে এখন যে কাজটি এরা করতে চাইছে এবং চাইবে সেটি হল এটি আওয়ামীলীগের একটি অংশের আন্দোলন—কারণ হিসেবে কি দাঁড় করাবে? এই মঞ্চে আওয়ামীলীগের লোকজন সব উঠে এসে বক্তৃতা কওরে, সব আওয়ামীলীগের অংগ সংগঠনের লোক! বাহ! তোমাদেরকে কেউ কি মানা করেছিল এই আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ কর না? রাজাকারদের হাত ছেড়ে উঠে আসো এই মঞ্চে–কেউ বারণ করেছিল? তোমরা পারো না এই আন্দোলনের বিরোধিতা না করে কারণ জামাতিদের সাথে তোমাদের নিকাহ হয়েছে—যদি একবার সংহতি প্রকাশ করো তাহলে জামাতিরা তোমাদের তালাক দেবে–তাই—যত রকমের খেলা আছে খেলছো তোমাদের প্রাণের অধিক জামাতিদের বাঁচাতে—-

লাভ নেই! কাল ওদের সহিংস হরতালে তোমাদের প্রত্যক্ষ্য সমর্থন কাজে আসে নি—প্রজন্ম চত্বর খানিক বিরতিতে আবারও সেই আগের অবস্থায় –এমন কি আরো উজ্জিবীত। আগেও বলেছি মনে রাখা দরকার–দেরীতে হলেও রাজাকারের বিচারের প্রতিশ্রুতী দিয়েছিল আওয়ামীলীগ—নতুন প্রজন্ম আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় এনেছিল–বিচারের রায়ে যখন তাদের মনে হয়েছে আওয়ামীলীগের অধীনে বিচার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করেছে তখনই তারা মাঠে নেমেছে—এটা আওয়ামিলীগকে সমর্থন নয়–চাপে রেখে দাবী আদায় করার জন্যই। দাবিটি তো রাজনৈতিক ভাবে আওয়ামিলীগের অনুকুলেই তাই তারাও সুর না মিলিয়ে পারছে না—যদি মনের মধ্যে কোন কোন দূরভিসন্ধিও থাকে বর্তমান সরকারের–তাতেও লাভ হচ্ছে না—কারণ জনতার হৃদয়ের রিদম—-প্রতিপক্ষ ছাড়া কোন রাজনৈতিক দলের না বোঝার কথা নয়।

লেখকঃ জার্মান প্রবাসী কলামিষ্ট।।

বিঃদ্রঃ লেখাটিতে লেখকের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ পেয়েছে। এর সাথে এসবিডি নিউজ কর্তৃপক্ষ বা সম্পাদক এর সংশ্লিষ্টতা নেই।।

অতিথি লেখক