এই জাতির গন্তব্য কী অনিশ্চিত?

এই জাতির গন্তব্য কী অনিশ্চিত?

রাহাত শিকদারঃ

প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের আপামর জনতার অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সারা অঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা! স্বাধীনতা উত্তর ধারাবাহিকক্রমে স্বৈরশাসকদের পতনের পর আমরা কী দেখেছি! কি পেয়েছি এই সাধারন নাগরিক জীবনে! একথা অনস্বীকার্য যে আমাদের দৈনন্দিন জীবিকায় কিয়দাংশে অর্থনৈতিক মুক্তি মিলেছে বটে কিন্তু দেখা মেলেনি মানসিক উৎকর্ষতার ও মানবিক স্বাধীনতার, দেখা মেলেনি নাগরিক সভ্যতার।  এই মৌলিক অপ্রাপ্তিতে দায়ী কোন স্বৈরতন্ত্র বা কোন এক ভিন্ন তন্ত্র এই প্রশ্নের তর্কটা বহুদূর গড়াতে পারে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন সুযোগের তাগিদে বিবিধ তন্ত্র মন্ত্রের কাঁধে চেপে চলমান রাজনৈতিক কর্তারা ৯১’ ও ৯১’ পরবর্তী যে সকল বহুমুখি গণতন্ত্রের সূচনা করেছিলেন তা কার্যত দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। কেবলই  অবিশ্বাস আর অসহিষ্ণুতার ভারে ভারাক্রান্ত আজকের এই রাজনীতি নিজেই তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে ধ্বংসের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে এসেছে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যে, ক্ষমতা কুক্ষিগত আর ক্ষমতায় আসীনের লোভ ও তীব্র বাসনাকে লালন করা একটি ফিকে গণতন্ত্রের শ্লোগান তা আজ জাতির কাছে পানির মতন পরিষ্কার হওয়া দরকার। রাজার নীতিতে যদি সকল প্রজার সমূহ আশা, আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা, মৌলিক অধিকার আর চেতনার বাস্তব প্রতিফলন না থাকে তবে সে রাজনীতির অর্থ অনর্থ হয়ে পড়ে।  বিপথগামী হয়ে যাওয়া এক ঝাঁক সম্ভাবনাময় তরুণ গোষ্ঠী আজ অকাতরে ভ্রান্ত একটি চেতনায় প্রান দিতে পিছপা হচ্ছে না কেন? কারন তারা চলমান রাজনৈতিক ধারায় রাজনৈতিক মূল্যবোধের গৌরবান্বিত অধ্যায় এখন আর দেখতে পায়না। সেই সুযোগে মরীচিকা হয়ে তাদের আঁকড়ে ধরে অন্য একটি অন্ধপথ। আপাতদৃষ্টে বর্তমান সকল ছোট বড় রাজনৈতিক দৃশ্যপট যে মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ তা জনমত যাচাই করলে খুব বেশি বলা হবে বলে মনে হয় না। নাট্যঅঙ্কের মাঝে হটাত কোন চরিত্রের হটাত আগমন ঘটলে শুরু আর শেষ অঙ্ক মেলানোটা যেমন দুরূহ তেমনি অসম্ভব। তারপর আবার যদি না থাকে তাল বা লয় এর সুমিশ্রণ, তাহলেতো কথাই নাই। এদেশে পরিবার কেন্দ্রিক যে বর্তমান রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে তা দিয়ে সঠিক গণতন্ত্রের উত্তরণ নিয়ে সংশয় এখন সিংহভাগ মানুষের। একথা বোঝেন আবাল বৃদ্ধ সকলে, এমনকি রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান অনেক ব্যাক্তিগনও একই বিষয় বুঝেও কূলে ঠাই পান নাই তা আমরা দেখেছি বৈ কি।  কেউবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর চাঁদরে, কেউবা অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জিয়াউর রহমানের চাঁদরে, কেউবা ধর্মীয় লেবাছে  এ রাষ্ট্রের জনসেবায় ব্রত হয়েছেন এবং এদেশ গড়ার দায়িত্বভার নিয়েছেন বারংবার। এদের সাথে রয়েছেন সুশীল সমাজ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আর নব নব চেতনার প্রজন্ম, রয়েছেন রাজনীতির বাঘা বাঘা বায়েন। তবে কেন এই উল্টো চিত্রপট একেবারে স্থির হয়ে থমকে দিয়েছে আমাদের নাগরিক জীবনকে। হরতালের হলি খেলা দিয়ে এ দেশে যে নাশকতা আর নৃশংসতার প্রথা চলছে তার বলি হচ্ছে কারা বা কোন গোষ্ঠী এ কথা মুখ্য নয়। ঐ হরতালের বলি বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া হাজার হাজার তাজা তরুণ প্রান এমনকি ছোট্ট  শিশুটিও কোন বিশেষ গোষ্ঠীর বা দলের বা বিপথগামী পথভ্রষ্ট কোন অংশের বা সরকারী কর্তব্যে দায়িত্বরত রাজকর্মচারী বলে যে বাহবা বা ধিক্কার পায় তারা সবাই এদেশের আপামর জনতা, ওরা সবাই বাঙালি। কিন্তু  রাহুগ্রাসের শিকার ঐ অভাগাদের আত্মদানের ফায়দা লুটে নিয়ে স্বদেশে বা বিদেশে বসে আয়েশে মত্ত থাকেন আমাদের সাম্রাজ্যবাদী সদৃশ রাজ পরিবারের সদস্যরা। আর স্বজন হারাবার যন্ত্রণা শেষ করে দেয় অসংখ্য পরিবার পরিজনকে। তবে কোনদিকে এ জাতির ভবিষ্যৎ এসে পৌঁছেছে আর কোথায়ই বা এর গন্তব্য? পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্থান, মায়ানমার, আফগানিস্থান সহ দক্ষিন এশিয় অধিকাংশ রাষ্ট্রের জাতিগত বিভেদ আর সহিংসতার নমুনাকে এদেশে অশুভ আমন্ত্রণ জনাবার প্রয়াশ তবে কোন গোষ্ঠীর নীলনকশা? কারাই বা রেফারী হিসাবে নীতিগত ও কৌশলগত অবস্থান নিয়েছেন এহেনও ঘৃণ্য চক্রান্ত বাস্তবায়নে? এই প্রশ্ন আর প্রশ্নের জবাব দুইই এ জাতির কাছে স্পষ্ট হবার আশু প্রয়োজন আছে বলে মনে হচ্ছে। নচেৎ গভীর সমুদ্রের মাঝপথে গিয়ে আর ফিরে আসার পথ থাকবে না।

দেশের বৃহৎ দুইটি রাজনৈতিক দলের কর্ণধরদ্বয় যখন থেকে তথাকথিত গণতন্ত্রের শুভযাত্রা করেছিলেন ঠিক সেঅব্দি  আজ পর্যন্ত আমরা দেখতে পেয়েছি যে, তারা এ দেশের জাতীয় উন্নয়ন ও নীতির প্রশ্নে কোনক্রমেই ঐকমত হতে পারেন নাই। এমনকি এক মুহূর্তের জন্য ব্যাক্তিগত ভাব বিনিময় করতেও ঈর্ষায় কাতর হয়ে পড়েছেন। তবে তারা এদেশের জনগনের ভাগ্য উন্নয়ন আর শান্তির সেতুবন্ধন কিভাবে করবেন? এই ব্যর্থতা আমাদের অসহায় নিপীড়িত জনতার নাকি আমাদের পরম ভালোবাসার নেত্রীবৃন্দের। এই জাতির বিভেদ হয়ে যাওয়া এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীকে সহ্য করতে পারেনা তাই আমাদের নেত্রীবৃন্দরাও সৌহার্দ তথা রাজনৈতিক শিষ্টাচার থেকে দূরে বসে থাকেন। নাকি আমাদের মহান নেতৃবৃন্দ জাতীয় ঐক্যে বা রাজনৈতিক সৌজন্য চর্চা থেকে নিজেদের দূরত্ব সমান্তরালে রাখেন তাই আমরা অভাগা জাতিরাও ব্যাক্তিগত থেকে পারিবারিক এমনকি সামজিক জীবনের একাত্মতাকে সমূলে দূরে ঠেলে দিয়েছি। এসবের মূলে রয়েছে ক্ষমতালিপ্সু অভিলাষী রাজনৈতিক মনন ও রাজনৈতিক দূরবৃত্তায়ন।  আর এই অসহ ধারার পরাগায়ন ঘটিয়েছেন এ দেশের গৌরবান্বিত রাজনীতিতে অনুপ্রবেশকারী একশ্রেণীর অসাধু ব্যাবসায়ি ও আমলা গোষ্ঠী যারা তাদের স্বীয় স্বার্থ কায়েমে চরিতার্থ করেন রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও সন্ত্রাস। তাই প্রকৃতঅর্থে রাজনৈতিক শিক্ষা ও দীক্ষায় মহিমান্বিত ব্যাক্তিদেরকে রাজনৈতিক হাল ধরা ছাড়া এই বেহাল দশার উত্তরণ সম্ভব নয় তা সময়ের রুঢ় বাস্তব।

আসুন আর সমালোচনা, পর্যালোচনা বা দূরে সরে থাকা নয় বরং এগিয়ে আসি দেশ ও দশের তথা নিজের ঘর গোছাবার সেবায়। কোন নতুন ধাঁরা বা পুরাতন ধারার মূলোৎপাটন না চেয়ে স্ব স্ব অবস্থানে থেকে সঠিক বিবেকের রায় দেই। তবেই মুখ থুবড়ে পড়বে চলমান অসহ ধাঁরা আরে জয় হবে নির্মল নাগরিক সভ্যতার। প্রতিষ্ঠা পাবে গণমানুষের দাবী আর স্বপ্ন।

লেখকঃ রাহাত শিকদার,গবেষক, সাংবাদিক এবং আফগানিস্থান সরকারের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বরত।।

rahat0481@yahoo.co.uk

অতিথি লেখক