সর্বক্ষেত্রে আইনের যথার্থ প্রয়োগ আবশ্যক

সর্বক্ষেত্রে আইনের যথার্থ প্রয়োগ আবশ্যক

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ
কলংকিত এক ঘটনাঃ
  গত ১ ডিসেম্বর। ঢাকা ইডেন কলেজের সামনে একটি মাইক্রোবাস থেকে পুলিশ ৩৪২ বোতল ফেনসিডিল ও একটি রিভলবার উদ্ধার করে। ওই গাড়ি থেকে ভোলার জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ জাবেদ ইমামকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় নিউমার্কেট থানার পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে। পরবর্ত্তীতে জামিনের আবেদন নাকচ করে আদালত জাবেদ ইমামকে কারাগারে পাঠান। বিচারক জাভেদকে পুলিশ ফেনসিডিলসহ গ্রেফতার করে যথেষ্ট বিপাকে পড়তে হয়েছে। নিজেদের চাকরী বাঁচানো দায়। বিচারক বলে কথা! কোন আইনের ভিত্তিতে মাদক মামলার আসামি ভোলার জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ জাবেদ ইমামকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হল, তা জানতে চেয়েছেন আদালত। ব্যাখ্যা দিতে ৬ ডিসেম্বর পুলিশের পাঁচ কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির হতে বলা হয়। ৩ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম এম আবদুস সালাম এ নির্দেশ দেন। আদালত বলেছেন, যেভাবে গণমাধ্যমের সামনে বিচারক জাভেদ ইমামকে হাজির করা হয়েছে তা আইনের পরিপন্থী। বিচার বিভাগকে জনগণের সামনে হেয়-প্রতিপন্ন করার জন্য বিচারককে নিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল করা হয়েছে, যা গুরুতর অন্যায়। আদালত আরও বলেছেন, পুলিশ একজন আসামিকে নিয়ে এভাবে মিডিয়া ট্রায়াল করতে পারে না। বিচারের আগেই কাউকে এভাবে হাজির করার বিধান নেই। তাই পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। আদালত আরও বলেছেন, যদি কোনো আসামি দোষ স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে চান, তাকে অবশ্যই নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে। তা না করে পুলিশ আসামিকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে। একজন আসামিকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে তাকে বিচারের আগেই দোষী প্রমাণিত করাও আইনের পরিপন্থী। আদালত বলেছেন, মামলার এজাহার ত্রুটিপূর্ণ এবং আসামিকে রিমান্ডে নেয়ার কোনো আবেদন করা হয়নি। আইন অনুযায়ী গণ্যমান্য স্থানীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে মামলার আলামত জব্দ করা হয়নি। আসামি পরিস্থিতির শিকার।
মনীষী সক্রেটিস বিচারকদের উদ্দেশে বলেছিলেনঃ  যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৩৯৯ বছর আগে এথেন্সে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মহামনীষী সক্রেটিস বিচারকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমি অপরাপর লোকের মতো সাধারণ নির্ঝাট জীবন কাটাইনি। আমি আমার নীতির দৃঢ়তা নিয়ে বেঁচেছিলাম। যে জীবনে আমি নিজের বা অপরের মঙ্গল সাধন করতে পারব না তা গ্রহণ করিনি। আপনাদের সব সময়ই এ কথা বোঝাতে চেয়েছি, ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে নিজের আত্মার উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দেয়াই শ্রেয়। এরূপ জ্ঞানদানের পরও আজ আমি কী পাচ্ছি? এই কি আমার প্রাপ্য ছিল? … আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আপনারা ক্ষণস্থায়ী খ্যাতি হয়তো পাবেন, কিন্তু কিছুদিন পরই জ্ঞানী সক্রেটিসকে হত্যার দায়ে আজকের নিন্দুকরা আপনাদেরই দোষারোপ করবে। … তোমরা যদি ভাব তোমাদের পাপকাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠকে হত্যার মাধ্যমে রুদ্ধ করতে পারবে, তাহলে তা ভুল ধারণা। কারণ অব্যাহতি লাভের এই উপায় সম্ভবত বিশ্বাসযোগ্যও নয়। শ্রেষ্ঠ ও সহজতম উপায় হচ্ছে কাউকে দমিয়ে রাখা নয়, বরং নিজেকে উন্নত মানুষরূপে গড়ে তোলা।’ সক্রেটিসের এই অমোঘবাণী উচ্চারণের কয়েক হাজার বছর পরও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার পদ্ধতি দেখলে সক্রেটিসের অভিযোগের সাথে অনেক ধরনের মিল খুঁজে বের করতে খুব বেগ পোহাতে হয় না। সত্য প্রচারে অকুতোভয় ছিলেন সক্রেটিস। এই অপরাধে তাকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয়েছিল। এখনও (অন্তত বাংলাদেশে এই ধারা অটুট রয়েছে।)

সাংবাদিকতায় সাধু সাবধানঃ  সংবাদপত্রের পাতা খুললে আর টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোতে প্রতিনিয়িত হাজারো জাবেদকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির হতে দেখা যায়। তখনতো কোন আদালত এ বিষয়ে কিছু জানতে চান না। শুধু জাভেদ ইমামের বিষয়েই কেন ব্যতিক্রম ঘটলো? উনি প্রভাবশালী বলে? যেসব সাংবাদিক বিচারক জাভেদ ইমামের সংবাদ কাভারেজ করেছিলেন,তাদের দফায় দফায় নাজেহাল হতে হয়েছে। কেন? তাহলে সাংবাদিকতার নীতি কী পাল্টে যাচ্ছে? অনেকেই সহজ সমাধান দিয়ে দেন। সাংবাদিকরা যেনো ‘সাধু সাবধান’ হয়ে যান। নতুবা সক্রেটিসের মতো ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হতে পারে!

একজন বিচারক রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশঃ  ২০০৭ সালে মহামান্য হাইকোর্ট আদালত অবমাননা আইনের মামলায় রায় প্রদানকালে বলেন, প্রতিটি চিকিৎসক জীবন্ত মানুষের হৃদয়ে, মস্তকে বা শরীরের অন্যান্য বিশেষ অপরিহার্য ও সংবেদনশীল অঙ্গে অপারেশন করার সময় তার সম্পূর্ণ মনোযোগ শুধু অপারেশনে নিয়োজিত করে থাকেন। কেননা তিনি জানেন তার মনোযোগের সমান্যতম বিঘ্ন ঘটলে রোগীর প্রাণহানি ঘটতে পারে। যদি কোনো কারণে সে চিকিৎসক সমালোচনার সম্মুখীন হন কিংবা ভীত হয়ে যান তবে তার পক্ষে যেমন অপারেশন করা দুরূহ হয়ে পড়বে ঠিক তেমনি বিজ্ঞ বিচারকরা যদি বিচার বিভাগ স্বাধীনতার নামে উদাসীন হয়ে পড়েন তা হলে বিচারকার্য অবিচারে পর্যবসিত হতে পারে। ফলাফল হিসেবে বিচারক সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও সুদূর প্রসারিভাবে রাষ্ট্রের আপামর জনসাধারণ অপরিসীম ক্ষতির শিকার হতে পারেন। সে দিক বিবেচনায় কোনো বিচারক সম্পর্কে কোনো প্রকারের অভিযোগ সৃষ্টি হলে প্রথমে তাকে সে অভিযোগ সম্পর্কে জ্ঞাত করা অপরিহার্য। পরবর্তী সময়ে তার ঊর্ধ্বতন নিয়ন্ত্রণকারী মহামান্য বিচারক মহোদয়কে বিষয়টি জ্ঞাত করা দরকার। যদি প্রয়োজন হয় তবে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতির গোচরীভূত করা যেতে পারে। কারণ, কোনো অসৎ বিচারককে কোনো পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগে নিয়োজিত রাখা উচিত নয়।
আমাদের অধিকার এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাঃ  ১৯৮৫ সালে হাইকোর্ট অব কেরেলা বনাম প্রিতিশ নন্দি (ক্রিলজা-১০৬৩) মামলায় মহামান্য বিচারপতি বলেন, বিচারকের বদান্যতা এতখানি পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে না যে, সে কথা ও কার্যকে উৎসাহিত করবে যা জনসাধারণের বিচার প্রণালীর প্রতি আস্থা নষ্ট করবে, কোনো রকমের অনুগ্রহ বা ভীতি ছাড়া তাদের দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে। মুক্ত সমালোচনায় সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও অর্পিত ভূমিকা রাষ্ট্রের স্বীকার করে নিতে হবে। মন্তব্য, সমালোচনা, তদন্ত ও গ্রহণের যুগে বিচার বিভাগ যৌক্তিক ও অনিষ্টবিহীন সমালোচনার হাত থেকে নিরঙ্কুশভাবে অব্যাহতি দাবি করতে পারে না। কিন্তু সমালোচনাটি শোভন ভাষায় নিরপেক্ষ, অনুভূতিপূর্ণ, সঠিক ও যথাযথ হতে হবে। রাষ্ট্রের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে আদালতের রায়ের গঠনমূলক সমালোচনা করার। রায়ের সমালোচনা হতে কোনো দোষ নেই কিন্তু যে বিচারক সে রায় প্রদান করেছেন তাকে তার রায়ের জন্য ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনা বা কোনো প্রকারের আক্রমণ করা যাবে না। যদি কোনো রাষ্ট্রে সে রকমটা হতে থাকে তবে সে রাষ্ট্রের বিচার প্রতিষ্ঠান চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে ও গণতান্ত্রিক ধারা হুমকির মুখে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বিচারকরা যে সমালোচনার ঊর্ধ্বে তা কখনও নয় তবে তার দায়বদ্ধতা বা সে সব সমালোচনার ধরন ও প্রকৃতিতে রয়েছে ভিন্নতা। বিচারকের রায়ে যদি কোনো ব্যক্তি সন্তুষ্ট না হয় এবং সে যদি মনে করে তবে সে ন্যায়বিচারের প্রাপ্তির জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবে। কাজেই আমাদের উচিত আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ভুলে গেলে চলবে না একজন বিচারক যদি তার বিচারিক কার্যক্রম সম্পর্কে নির্ভীক না হতে পারেন ও প্রদত্ত রায় সম্পর্কে যদি উদ্বিগ্ন থাকেন বা প্রচারিত কোনো সংবাদ সম্পর্কে ভীত হয়ে যান তাহলে তিনি ন্যায়বিচার কিংবা স্বাধীনভাবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কুণ্ঠাবোধ করতে পারেন। যদি সে রকমটা হতে থাকে তবে পরিশেষে বিচার প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্থ হবে। ফলে দেশবাসী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বিচারপতিদের সাহস থাকতে হবে, তবেই আমাদের দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পাবে। পাশাপাশি ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ আরোপ সাপেক্ষে সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু ক্ষমতাশীলরা কখনই ‘যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধের ধার ধারে না। নিজেদের পছন্দের ব্যত্যয় ঘটলেই বেআইনি বল প্রয়োগ করে কিংবা প্রি-সেন্সরশিপ করে কিংবা টকশোর অতিথি কারা হবে তাদের নামের ফর্দ ঝুলিয়ে দেয়; আর দোহাই টানে ৩৯ অনুচ্ছেদের ব্যতিক্রমের। কিন্তু কখনই সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে না যে, খবরটি দ্বারা রাষ্ট্র কিভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলো।

মনীষীদের কথাঃ  আঠারো শতকের প্রথম ভাগে মহামান্য বিচারপতি Lord Robertson বলেছিলেন in the absence of immunity, no man but a beggar or a fool would be a judge. সুতরাং কোনো সন্দেহ নেই রাষ্ট্রের আদালত ও বিচার বিভাগ সম্পর্কে আমাদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন। তবে বিচারকদের মনে রাখতে হবে, তাঁদের দায়িত্ব কোনো মামুলি দায়িত্ব নয় বরং গুরু দায়িত্ব। বিচারকের কাজের সঙ্গে চিকিৎসকের কাজের তুলনা করলে ভুল হবে না। আরো রয়েছে একদিকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অন্যদিকে আদালত অবমাননার খড়গ।

ধোঁয়াশা আইনের প্রয়োগ এবং বাধাগ্রস্থ সাংবাদিকতাঃ  বর্তমান সময়ে সংবাদকর্মীদের জন্য সবচেয়ে ভীতিকর হলো আদালত সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা বা সংবাদ প্রচার করা। কারণ কী করলে আদালত অবমাননা হয় আর কী করলে হয় না, তা একমাত্র আদালত ছাড়া আর কেউ জানে না। ১৯২৬ সালের অপূর্ণ আইন দিয়ে বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আদালত অবমাননা এক ধোঁয়াশা। আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো সরকারি ও বিরোধী উভয় দলের রোষানলেই মাঝে মধ্যে পড়ে, যদি তাদের স্বার্থহানিকর (অথচ নিরেট সত্য ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট) কোনোকিছু প্রকাশিত হয়। সংবাদমাধ্যম তখন তাদের শত্রু হয়ে ওঠে এবং নানা পন্থায় তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। সামরিক শক্তিও কখনো কখনো (বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়) এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সত্য সংবাদ প্রকাশ করে বিপাকে পড়তে হয় একজন সাংবাদিককে। কখনও বা পুরো প্রতিষ্ঠান-ই বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়ে। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকার ফলে এই ধরণের জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে। অবিলম্বে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া আবশ্যক। অন্যথায়,জাতির জন্য অপেক্ষা করছে এক জঘণ্য কালো অধ্যায়।

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।

প্রধান সম্পাদক