গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ:

মূল পটভূমিঃ স্বাধীন,বহুমুখী ধারণাপ্রসূত সংবাদ উন্নয়ন এবং সাংবাদিকদের অধিকার সচেতনার লক্ষ্যে সারা বিশ্বে প্রতিবছর ইউনেক্সোর উদ্যোগে ৩ মে বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস পালিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এবারও দিবসটি পলিত হচ্ছে। ১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সভার ৪৮/৪৩২ সূত্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মে মাসের ৩ তারিখকে মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস ঘোষণা করা হয়। বিশ্বব্যাপী সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উন্নয়ন সংক্রান্ত ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় স্বাধীন,মুক্ত ও বহুমুখী ধারণাপ্রসূত সাংবাদিকতা দিবস ঘোষণার বিষয়টি ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে প্রস্তাব আকারে গৃহীত হয়। ১৯৯১ সালের ৩ মে নামিবিয়ায় স্বাধীন ও বহুমতভিত্তিক সংবাদপত্র উন্নয়ন বিষয়ক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘ এবং ইউনেস্কো এই সেমিনারের আয়োজন করে। সে বছরই আফ্রিকায় স্বাধীন ও বহুমতভিত্তিক প্রেস উন্নয়নের জন্য এই সেমিনারে উইনঢক ঘোষণা গৃহীত হয়। এই ঘোষণার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ মে মাসের ৩ তারিখকে মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস ঘোষণা করে। ঘোষণাপত্রের ১৮ ধারায় বলা হয় প্রত্যেকেরই চিন্তা,বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার আছে। নিজ ধর্ম অথবা ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তনের স্বাধীনতাও বিশ্বের প্রতিটি জনগণের আছে। একইভাবে ১৯ ধারায় বলা হয়- প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত ধারণা পোষণ করা ও মতামত প্রকাশের অধিকার সুসংরক্ষিত। রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপহীন মতামত পোষণ এবং যে কোনোভাবে রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে তথ্য ও মতামত সন্ধান করা,গ্রহণ করা বা জানানোর স্বাধীনতা মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা অনুযায়ী জাতিসংঘ মুক্ত,স্বাধীন মতামতভিত্তিক সংবাদ প্রকাশ নিশ্চিত করার জন্য ইউনেস্কো বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায়। যদিও ইউনেস্কোর এই আহ্বান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য বিশেষভাবে কোনো সুসংবাদ বয়ে আনতে পারেনি। তাই মত প্রকাশের মৌলিক স্বাধীনতা আজও সর্বত্র বিপর্যস্ত। সেন্সর প্রথা,কারাদণ্ড প্রদান এবং কখনো কখনো মৃত্যুদণ্ড প্রদানের মাধ্যমে মুক্ত সংবাদ পরিবেশনের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। জাতিসংঘ মনে করে, মুক্ত সাংবাদিকতার মাধ্যমেই জনগণের অধিকার জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব। আর সাংবাদিকই পারে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে। এই সাহসী কাজের জন্য রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের জনগণের সহযোগিতার প্রয়োজন। প্রয়োজন সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে সাংবাদিককে রক্ষা করা এবং সর্বশক্তি ও সম্পদ দিয়ে তাদেরকে সমর্থন যোগানো।

জাতিসংঘের তথ্যঃ জাতিসংঘের প্রদত্ত তথ্য মতে ১৯৯৮ সালে মুক্ত সাংবাদিকতার অধিকার সবচেয়ে বেশি লংঘিত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই বছর ৫০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে এবং এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে। সাংবাদিকরাই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অপপ্রয়াসের প্রধান ল্যবস্তুতে পরিণত হয়। সরকারের ছত্রছায়ায় সংঘবদ্ধ অপরাধচক্র এবং সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বাড়তে থাকে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ মুক্ত সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। সঙ্গত কারণেই ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে মত প্রকাশের অধিকার। বিপর্যস্ত হচ্ছে মানবাধিকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত এবং নিহত হচ্ছে অনেকেই।

ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইন্সটিটিউটের তথ্যঃ ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইন্সটিটিউটের সূত্র মতে, ১৯৯৯ সালে সংবাদ সংগ্রহ এবং পরিবেশনার কাজে নিহত হয়েছে ৮৭ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মী। সাম্প্রতিক সময়কে সাংবাদিকদের জন্য অন্যতম প্রাণঘাতী সময় হিসেবে ধারণা করা হয়। ইন্সটিটিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী দেশের তালিকায় যুগোস্লাভিয়ার অবস্থান শীর্ষে। ১৯৯৯ সালে সেখানে ২৫ জন সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়। এদের মধ্যে ১৬ জন নিহত হয় রাষ্ট্রীয় বেতার এবং টেলিভিশনের ওপর বোমা হামলার কারণে। কর্তৃপক্ষ দেশটির স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর বিধি-নিষেধ, জরিমানা ও নিপীড়ন অব্যাহত রাখে। লাতিন আমেরিকায় ১৯৯৯ সালে নিহত হয় ৭ জন সাংবাদিক এবং একই বছরে মিয়ানমারে কারারুদ্ধ করা হয় ১৩ জন সাংবাদিককে। ৯ জন সাংবাদিকের আটকের ঘটনা ঘটে চীনে। ইরাকে আমেরিকান সেনাবাহিনীর হামলায় নিহত এবং আহত হয় অনেক মিডিয়াকর্মী।

বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনঃ বাংলাদেশে মুক্ত সাংবাদিকতার চিত্র সুদৃশ্য নয়। এখানে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে সাংবাদিকরা পুলিশ বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছে বারবার। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা প্রকৃতঅর্থে কতটুকু বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারছেন? পত্রিকার প্রকাশক,মালিক পক্ষ এবং অনেকক্ষেত্রে স্বার্থান্বেষী কিছু সম্পাদককেও সরকারি এবং বেসরকারি মাধ্যম থেকে নানান সুবিধা প্রাপ্তির কারণে জনগণ কিছু সংবাদপত্রকে সরকারের মিডিয়া পার্টনার হিসেবে বিবেচনা করতে বাধ্য হয়। সংবাদপত্র প্রকাশের ইতিহাস সমৃদ্ধ হলেও মত প্রকাশের মৌলিক স্বাধীনতা আজো সর্বত্র বিপর্যস্ত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর অব্যাহত হস্তপে বিশেষভাবে লণীয়। সেন্সর প্রথা,কারাদণ্ড প্রদান এবং কখনো কখনো মৃত্যুদণ্ড প্রদানের মাধ্যমে মুক্ত সংবাদ পরিবেশনের অধিকার খর্ব করা হয়। ২০০৬ সালের ২৯ মে। কুষ্টিয়ায় তৎকালীন সরকার দলীয় সেখানকার সংসদ সদস্য সাংবাদিকদের ওপর লেলিয়ে দেয় সন্ত্রাসী। সেই ক্যাডার বাহিনী হামলা করে সাংবাদিকদের সমাবেশে। নির্যাতনবিরোধী ওই সমাবেশে হামলায় গুরুতর আহত হন বিশিষ্ট সাংবাদিক বাংলাদেশ অবজারভার সম্পাদক জনাব ইকবাল সোবহান চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। আমাদের স্মৃতিতে আজও সেই রক্তাক্ত ইকবাল সোবহান চৌধুরীর ছবি ভেসে ওঠে। সন্ত্রাসী ক্যাডারদের কোন শাস্তি হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ফরিদপুরে প্রবীর শিকদারের ওপর স্বাধীনতাবিরোধীদের হামলার ঘটনারও কোন বিচার হয়নি। ফেনীতে সাংবাদিক টিপু সুলতানের ওরপর আক্রমণের ঘটনায়তো সারাবিশ্বেই হৈ-চৈ হয়েছিল। সাপ্তাহিক বিচিন্তার সাড়া জাগানো সম্পাদক মিনার মাহমুদ সম্প্রতি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। এই মেধাবি সাংবাদিককে কেউ চাকরি দেয়নি। মঈন উ আহমদ ও ফখরুদ্দীনের আমলে জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিকউল্যাহ খান মাসুদ, সিলেটে আহমেদ নূর, ঢাকায় তাসনীম খলিল, রাজশাহীতে জাহাঙ্গীর আলম আকাশ, প্রথাবিরোধী বিশিষ্ট নাট্যকার-অভিনেতা, কলামিষ্ট মলয় ভৌমিক, কার্টুনিষ্ট আরিফুর রহমান নির্যাতনের শিকার হন। আজ পর্যন্ত নির্যাতনকারি কারও শাস্তি হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে খুলনায় এএফএম রাজ্জাক, ঢাকায় এফএম মাসুমের ওপর নির্যাতন করা হয়। রাজধানীতে ঢাকাতেই দেশটিভির সাংবাদিক গিয়াস আহমদ এর ওপর পুলিশ নির্যাতন করে। দোষিদের শাস্তি হয়নি। রাজনৈতিক মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হয়েছেন বিবিসি, নিউ এইজ ও দৈনিক সংবাদের খুলনা প্রতিনিধি বিশিষ্ট সাংবাদিক দেশপ্রেমিক মানিক সাহা (বোমা হামলায়, ১৫ জানুয়ারি ২০০৪), একই শহরে দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক হুমায়ুন কবির বালু (বোমা হামলায় ২৭ জুন ২০০৫), খুলনাতেই দৈনিক সংগ্রামের শেখ বেলালউদ্দিন (বোমা হামলায় ১১ ফেব্রুয়ারি ২০০৫), দৈনিক অনির্বাণের নহর আলী (২০০১ সালের ২১ এপ্রিল),দৈনিক পূর্বাঞ্চলের হারুন অর রশিদ খোকন (২ মার্চ ২০০২)। তথ্য ভান্ডার বলে পরিচিত খ্যাতিমান সাংবাদিক দৈনিক জনকন্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি শামছুর রহমান কেবল (১৬ জুলাই ২০০০) নিজ অফিসে গুলিতে মারা যান। নিহত অন্য সাংবাদিকরা হলেন দৈনিক রানারের সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল (৩০ আগস্ট ১৯৯৮), খুলনার দৈনিক লোকসমাজের রফিকুল ইসলাম, বগুড়ার দৈনিক দুর্জয় বাংলার র্নিবাহী সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তী (২ অক্টোবর ২০০৪),দৈনিক সমকালের ফরিদপুর সংবাদদাতা গৌতম দাস (১৭ নভেম্বর ২০০৫), সাতক্ষীরার স.ম. আলাউদ্দিন (১৯ জুন ১৯৯৬), ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের সারওয়ারুল আলম নোমান, যশোরের দৈনিক রানার রিপোর্টার ফারুক হোসেন (১৯৯৪), ঝিনাইদহের দৈনিক বীরদর্পণ পত্রিকার সম্পাদক মীর ইলিয়াস হোসেন দিলীপ (১৫ জানুয়ারি ২০০০), খুলনার দৈনিক অনির্বাণের শুকুর হুসেন (৫ জুলাই ২০০২)। ২০০৫ সালের ২৯ মে দিবাগত মধ্য রাতে কুমিল্লায় দৈনিক কুমিল্লা মুক্তকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক মুহাম্মদ গোলাম মাহফুজ (৩৮) নিহত হন। তাকে জবাই করে হত্যা করে সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্তরা। আরও নিহত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জের আহসান আলী (২০ জুলাই ২০০১), নীলফামারীর সাপ্তাহিক নীল সাগরের মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬), দৈনিক পূবালীবার্তার মৌলভীবাজার প্রতিনিধি সৈয়দ ফারুক আহম্মদ (৩ আগস্ট ২০০৩), চুয়াডাঙ্গার নিখোঁজ সাংবাদিক বজলুর রহমান,খাগড়াছড়ির আজকের কাগজ প্রতিনিধি কামাল হোসেন (২১ আগস্ট ২০০৪), রাঙামাটির জামালউদ্দীন (৫ মার্চ ২০০৭), নাবিল আবদুল লতিফ, আনোয়ার অ্যাপোলো, ঢাকার উত্তরার কমিউনিটি সাংবাদিক নুরুল ইসলাম রানা (৩ জুলাই ২০০৯), এমএম আহসান বারী (২৬ আগস্ট ২০০৯), ও রেজাউল করিম রেজা, যশোরের আবদুল গফফার চৌধুরী, ডেমরার আবদুল হান্নান, সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি ফতেহ ওসমানি ও দৈনিক জনতার যুগ্ম-সম্পাদক ফরহাদ খাঁ (তিনি তার স্ত্রীসহ নিহত হন সন্ত্রাসীদের হাতে)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রথাবিরোধী লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ছুরিকাহত হন সন্ত্রাসীদের হাতে। পরবর্তীতে তিনি জার্মানিতে থাকাকালে মারা যান। ২০১১ সালের  ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ কুকরাইল এলাকায় গলা কেটে হত্যা করা হয় দৈনিক ভোরের ডাকের গোবিন্দগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রঞ্জুকে। ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের পোর্টকলোনি এলাকায় দৈনিক আজকের প্রত্যাশা, সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র ও আজকের সূর্যোদোয় পত্রিকার সাংবাদিক মাহবুব টুটুলকে এবং উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কে ১০ নম্বর বাসার বাসিন্দা সাপ্তাহিক বজ্রকন্ঠের সাংবাদিক আলতাফ হোসেনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২০১০ সালের ৯ মে গুপ্তহত্যার শিকার হন বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার সিনিয়র ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম টুটুল। একই সালের ২৮ এপ্রিল খুন হন বিশিষ্ট সাংবাদিক সাপ্তাহিক ২০০০ এর সিলেট প্রতিনিধি ফতেহ ওসমানী। ২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে দিবালোকে খুন হন বরিশালের মুলাদী প্রেসক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ী। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকায় খুন হন এনটিভির ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক, একই সালের ৩ জুলাই ঢাকার পাক্ষিক মুক্তমনের স্টাফ রিপোর্টার নুরুল ইসলাম ওরফে রানা খুন হন। ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে গাজীপুরে ঢাকার সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক সময় এর নির্বাহী সম্পাদক এমএম আহসান হাবিব বারি ও একই সালের ডিসেম্বরে রূপগঞ্জে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার সংবাদদাতা ও রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সহসভাপতি আবুল হাসান আসিফ মার্ডার হন। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি ও মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার। নিহত এই সাংবাদিকযুগল স্বামী-স্ত্রী। ছয়বছর বয়সী একমাত্র শিশুপুত্র মাহির সরোয়ার মেঘের সম্মুখে এই সাংবাদিক দম্পত্তি খুন হয়েছেন। কিন্তু আজও খুনিদের ধরেনি সরকার।

মানবাধিকার ঘোষণাপত্রঃ মুক্ত সাংবাদিকতায় বাংলাদেশের অবস্থান যথেষ্ট নাজুক। বর্তমান অবস্থান- ১৬৭টি দেশের মধ্যে ১৫১তম। আন্তর্জাতিক প্রেস ইন্সটিটিউটের প্রতিবেদনে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা লংঘনের ভয়াবহতা উল্লেখ করে বাক-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সনদের প্রতি সম্মান দেখাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। আন্তর্জাতিক প্রেস ইন্সটিটিউটের প্রতিবেদনে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা লংঘনের ভয়াবহতা উল্লেখ করে বাক-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সনদের প্রতি সম্মান দেখাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। মুক্ত সাংবাদিকতার প্রতিকূল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে রাষ্ট্র জনগণকে সচেতন করে দেয়ার জন্য দায়বদ্ধ বলে উল্লেখ করা হয়। ফলে এই দিবসে জাতিসংঘ পেশাভিত্তিক সংস্থা,সরকার ও সাধারণ জনগণসহ সব সাংবাদিককে কারাদণ্ড প্রদান,শারীরিক হুমকি,সন্ত্রাসী এবং গণমাধ্যমসহ সব ধরনের আঘাতের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। বাংলাদেশ সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দিবসটি পালনে যত আন্তরিক; মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ নিশ্চিত করতে ততটাই বেহাল। মানবাধিকার সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে,প্রত্যেকেরই চিন্তা, বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার রয়েছে। নিজ ধর্ম অথবা বিশ্বাস পরিবর্তনের স্বাধীনতাও রয়েছে প্রত্যেকের। একইভাবে ১৯ ধারায় বলা হয়েছে,প্রত্যেকেরই মতামত পোষণ ও প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে। বিনা হস্তক্ষেপে মতামত পোষণ করা এবং যেকোনো উপায়ে রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে তথ্য ও মতামত সন্ধান করা, গ্রহণ করা বা জানানোর স্বাধীনতা এই অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা অনুযায়ী জাতিসংঘ মুক্ত স্বাধীন মতামতভিত্তিক সাংবাদিকতা নিশ্চিত করার জন্য সব রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায়। কিন্তু মৌলিক স্বাধীনতা সর্বত্র বিপর্যস্ত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় অব্যাহতভাবে চলে সেন্সর প্রথা_কারাদণ্ড প্রদান এবং কখনো কখনো মৃত্যুদণ্ড প্রদানের মাধ্যমে। জাতিসংঘ মনে করে,মুক্ত সাংবাদিকতার প্রাণ হচ্ছে সাংবাদিক।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকতা দিবসঃ পৃথিবীর দেশে এই দিবসটি সাংবাদিকরা পালন করবেন নানা কর্মসুচির মাধ্যমে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই দিনটি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করে ‘বাংলাদেশ সাংবাদিক অধিকার ফোরাম’। গত ১৭ বছর ধরে সাংবাদিকদের পেশাগত অধিকার ও মুক্ত সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে এই দিনটি পালন হয়ে আসলেও,বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখনও সাংবাদিকরা হামলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পেশাগত অধিকার ও নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। প্রতি নিয়ত বাংলাদেশে হামলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন সাংবাদিক। পেশাগত দায়িত্ব পালন কালে আহত হচ্ছেন। গত ৫ বছরে ১৬ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। মামলা হয়েছে ২৫০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এবং ৩৮ জন সাংবাদিক কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। এছাড়া ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ৫ জন সাংবাদিক নিহত হন এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে ১০ জন সম্পাদক ও সাংবাদিককে হত্যার পাশাপাশি দু‘শতাধিক সাংবাদিককে আহত করা হয়। ২০০২ ও ২০০৩ সালের মধ্যে ১৫৮ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এছাড়া চলিত বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩৮ জন এবং গত বছর বিভিন্ন দেশে ৯৫ জন সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মী নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনের সূত্র অনুযায়ি চলিত বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আফ্রিকায় ৫ জন, এশিয়ায় ৯ জন, ইউরোপে ২ জন, আমেরিকাতে ৪ জন এবং মধ্যপ্রাচ্যে ৫ জন সাংবাদিক নিহত হন।

শেষ কথাঃ গণমাধ্যম হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। গণমাধ্যম স্বাধীন হলেই তার সুফল সরকার তথা জনগণ পায়। আশঙ্কার বিষয়,সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগেরই বিচার হয় না। খোঁজ মেলে না খুনিদের। সাংবাদিক সাগর-রুনি দম্পতি হত্যাকাণ্ড নিয়েও চলছে নানা টালবাহানা। এসব একেবারে অপ্রত্যাশিত। গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস,আস্থা ও চর্চা থাকলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় কেউ কখনও হস্তক্ষেপ করতে পারে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা,সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইলে সাংবাদিক সমাজকে রাজনৈতিক মত ও পথ ভুলে গিয়ে পেশাগত দৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। আমরা আশা করবো সকল সাংবাদিকের হত্যা-নির্যাতনের বিচার হবে। আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাংবাদিকদের পেশাগত ঐক্যের কোন বিকল্প নেই।

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।

প্রধান সম্পাদক