সাভার গণহত্যা: অসংখ্য প্রশ্ন, সামান্য উত্তর

সাভার গণহত্যা: অসংখ্য প্রশ্ন, সামান্য উত্তর

সৈকত রুশদীঃ

অভিবাদন মৃত্যুঞ্জয়ী এজাজ । নিজেদের জীবন বিপন্ন করে বিপন্ন মানবতার সাহায্যে যাঁরা ঝুঁকি নিয়েছিলেন আহতদের উদ্ধারে, বাঁচিয়েছেন অগণন প্রাণ, সেই বীরদের একজন এজাজ চলে গেলেন চিরকালের জন্য । রেখে গেলেন স্ত্রী ও সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যত, আর জাতির সামনে অসংখ্য প্রশ্ন ।

কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই বহুতল ভবন কেন ধ্বসে পড়বে, কেনই বা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে শিল্প-কারখানা চলতে দেওয়া হবে, ঝুঁকি চিহ্নিত হওয়ার পরও সেখানে কেন হাজার হাজার শ্রমিককে অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করতে ঠেলে দেওয়া হবে, আর কেন ধ্বংসস্তুপ থেকে আহত মানুষ উদ্ধারে যথোপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবেনা ! আর কেনই বা এই দুর্ঘটনা ও উদ্ধারকাজ নিয়ে জননিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রীর বক্তব্য (স্তম্ভ ও গেট ধরে নাড়াচাড়া; A good job) মানুষের কাছে পাগলের প্রলাপের সমার্থক মনে হবে !

এই সকল প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করতে হবে আমাদেরকেই । উদ্ধারকর্মী এজাজের মৃত্যু ও দুর্ঘটনায় নিহতদের জন্য কেবলমাত্র শোক প্রকাশ করলে কোন প্রতিকার হবেনা । আমরা যদি একই রকম আরেকটি দুর্ঘটনা এবং তার ফলে অকালে একটি মানুষেরও প্রাণ হারানো দেখতে না চাই, তবে এই সকল প্রশ্নের উত্তর থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং তা কাজ লাগাতে হবে অনতিবিলম্বে । ক্ষমতায় যে সরকারই থাকুক না কেন, তাকে বাধ্য করতে হবে ভবন নির্মাণ, কারখানা স্থাপন, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক ও কর্মীদের নিরাপত্তা, কারখানায় অগ্নিকান্ড রোধ, নির্বাপন ও আপত্কালীন নির্গমন পথ রাখা ও নিয়মিত মহড়া দেওয়া, দুর্ঘটনায় মানুষ উদ্ধার ও চিকিত্সার সর্বাধুনিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষিত কর্মীর ব্যবস্থা এবং কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার ও ওপর সকল ক্ষতিগ্রস্তের এককালীন অর্থ সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মান সম্মত আইন ও বিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ।

কর্মক্ষেত্রে সকল শ্রমিক ও কর্মীদের নিরাপত্তা বিধান এবং প্রয়োজনীয় চিকিত্সা ও ক্ষতিপূরণ প্রদান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও ‘শ্রমিক-কর্মচারী নিরাপত্তা ও বীমা বোর্ড’ (Workers Safety and Insurance Board বা WSIB) নামের একটি সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে যা কেবলমাত্র জাতীয় সংসদের শ্রম মন্ত্রনালয় বিষয়ক কমিটির কাছে জবাবদিহি করবে । বাংলাদেশ সরকার আইএলও-র পরামর্শে এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর অর্থ সহায়তায় এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলতে পারে । কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন, WSIB; Workers Compensation Board) নিয়মিত শিল্প-কারখানা, অফিস ও মাঠ পর্যায়ের কর্মক্ষেত্র পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত পরিদর্শকই পাঠায়না, সেই পরিদর্শক ও প্রতিষ্ঠানের লিখিত পরামর্শ দেওয়া ছাড়া বিধি-বিধানের ব্যত্যয় ঘটলে জরিমানা করে, এমনকী ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে কোন স্থাপনা বা কাজ বিবেচিত হলে প্রতিষ্ঠান যত বড়ই হোক না কেন, কাজ বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে । যদি কোন দুঘটনা ঘটে তবে এই প্রতিষ্ঠান সেটা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে তদন্ত করে এবং দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে আদালতের মাধ্যমে জেল, বড় ক্ষতিপূরণ ও জরিমানার ব্যবস্থা পর্যন্ত করে । এছাড়াও যেকোন কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও আঘাতজনিত কারণে আহত হলে সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের যথোপযুক্ত চিকিত্সা, ক্ষতিপূরণ, নিয়মিত ভাতা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে ।

আমরা যদি এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দাবিতে দেশব্যাপী জনমত গড়ে তুলতে পারি এবং ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও হতাহত হওয়া রোধ করতে ও হতাহতদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে এই বোর্ডকে অর্থবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজে লাগাতে পারি, তবেই প্রয়াত এজাজ এবং ভবন ধ্বসে নিহতদের প্রতি, কর্মক্ষেত্রে নিহত ও আহত প্রতিটি কর্মীর প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে পারবো । আমাদের মনে রাখতে হবে, যে জাতি তার বীরদের সম্মান জানাতে পারেনা, সেই জাতিতে বীরদের জন্ম হয়না । ক্ষণজন্মা বীর এজাজ চিরজীবি হোন !

[সৈকত রুশদীঃ কানাডার টরন্টো বসবাসকারী রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সম্পাদক, বেতার-টিভি ভাষ্যকার ও লেখক ।]
টরন্টো, ৫ মে, ২০১৩।।

অতিথি লেখক