বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে হলে সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব নির্মূল করতে হবে
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটি কয়েকবছর ধরে বাংলাদেশে একটি বহুল আলোচিত শব্দ। বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতি নিয়ে যখনই মিডিয়ায় লেখালেখি হয় কিংবা জনসমাজে কথা ওঠে, তখনই ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটি সঙ্গত কারণেই প্রাধান্য পায়। সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলের তরফে ‘সিন্ডিকেট’-এর অস্তিত্ব সম্পর্কে অতীতে প্রত্যক্ষ আপত্তি জানানো হয়েছিল। কিন্তু ‘সিন্ডিকেট’ অর্থাৎ এই অদৃশ্য হাতের কারসাজিতেই বাজার বারবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে এই সত্যও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু বিলম্বে হলেও সরকার বিষয়টি আমলে নিতে বাধ্য হয় এবং প্রত্যক্ষভাবে অদৃশ্য হাতের কারসাজি স্বীকারও করছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার সবরকম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে কারসাজি নিয়ন্ত্রণে ‘প্রতিযোগিতা আইন ২০১২’ বিল হিসেবে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করে। ৭ মার্চ ২০১২ বাণিজ্যমন্ত্রী গোলাম কাদের (জিএম কাদের) বিলটি জাতীয় সংসদে উত্থাপনের পর তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয় এবং পরে তা সংসদে আলোচনা হয়। তখন বাণিজ্যমন্ত্রী বিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, ‘উদার বাণিজ্য ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বাজারের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করছে। ফলে একদিকে ভোক্তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।’ পূর্বতন বাণিজ্যমন্ত্রী, যিনি এখন বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বাজার নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যত নানারকম পদক্ষেপ কিংবা উদ্যোগ-আয়োজনের ব্যবস্থা নিলেও বিস্ময়করভাবে লক্ষ্য করা গেছে, যখনই তিনি এ বিষয়ে কথা বলেছেন, এর পর পরই বাজারে আরেক দফা উত্তাপ ছড়াত অর্থাৎ পণ্যমূল্য লাফ দিয়ে আরো একধাপ বাড়ত। দুর্মুখেরা এ নিয়ে নানারকম কথা বলেছেন, কিন্তু এটা তো সত্য, বিদায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যর্থতার স্বাক্ষর রেখেই এ মন্ত্রণালয় ত্যাগ করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী কি এক্ষেত্রে সফল ?
গত কয়েকদিন আগে ব্যবসায়ী মহলের তরফে জানানো হয়েছে এবার রমজানে পণ্যমূল্য বাড়বে না। এরকম প্রতিশ্রূতি তারা আগেও বহুবার দিয়েছেন। বেশ কিছু ক্ষেত্রে মহাজোট সরকারের সাফল্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেও বাজার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দাগটি মোটা। নিকট-অতীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে পণ্যমূল্যের ক্রম ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে সিন্ডিকেটে সমন্বিত অনুসন্ধান চালানোর সুপারিশ করা হয়েছিল। বাজারদরের ঊর্ধ্বমুখী চাপে এমনিতেই জনজীবনে বিরাজ করছে চরম অস্বস্তি। এর মধ্যে দফায় দফায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিও এ ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, যা গোদের ওপর বিষফোঁড়ার শামিল। নানামহল থেকে বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সরকারের নজরদারি কঠোর করার তাগিদ এসেছে বারবার এবং এখনো এই তাগিদ রয়েছে। এদেশে বিগত এক দশকে কৃত্রিমভাবে পণ্য সংকট সৃষ্টি করে দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে এ অভিযোগও উঠেছে বহুবার। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা শুধু তত্ত্ব কথা আউড়িয়েই সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছেন। মাঝেমধ্যে ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠকে বসেছেন, নানারকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, উভয় তরফ থেকে প্রতিশ্রূতি-অঙ্গীকারও কম ব্যক্ত হয়নি। কিন্তু কার্যত ফল শূন্যই থেকে গেছে। দৃশ্যত বাজার নিয়ন্ত্রণে এসব পদক্ষেপ কিংবা আয়োজন প্রশ্নের পর প্রশ্নও দাঁড় করিয়েছে এবং দায়িত্বশীলদের ভূমিকাও বিস্ময়কর ঠেকেছে। একদিকে কৃষক তার উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না, অন্যদিকে তাকে ক্রমেই উচ্চ মূল্যে নিত্যপণ্য ক্রয় করতে হচ্ছে। ফলে জীবনযাত্রা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়েছে। এমন চিত্র তো বহুবারই দেখা গেছে যে, আমদানি করতে হয় না, এ ধরনের পণ্যদ্রব্যের দামও যখন-তখন স্বেচ্ছাচারি অসাধু ব্যবসায়ী, মজুতদাররা বাড়িয়ে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বগতির দোহাই দিয়ে! সিন্ডিকেটের কবলে যে শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যই রয়েছে তা-ই নয়, জীবনরক্ষাকারী ওষুধের বাজারও তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে। বিগত ছয় মাসে ওষুধের মূল্য ক্রমেই বাড়ছে, যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই। এক্ষেত্রেও সরকারের সব কিছু ছাপিয়ে অদৃশ্য হাতের কারসাজি যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য, চার বছর ধরে অকার্যকর হয়ে রয়েছে বাজার উপদেষ্টা কমিটি। ২০০৮ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ২১ সদস্যের বাজার উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই কমিটির কোনো কার্যক্রমই নেই। নামকাওয়াস্তে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর ও বিএসটিআই মাঝেমধ্যে বাজারে অভিযান চালালেও এর কোনো দৃশ্যমান ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায় না। মূলত বাজার নামক অত্যন্ত স্পর্শকাতর ক্ষেত্রটি কতিপয় অসাধুর মুঠোবন্দি রয়েছে এবং কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই তারা তাদের আখের গোছাচ্ছে। ইতোমধ্যে বহুবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নেতৃত্বে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে ভোজ্যতেলসহ কোনো কোনো পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে বটে, কিন্তু এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি; বরং বাজার চলেছে ওই অসাধুদের কিংবা অদৃশ্য হাতের কারসাজিতেই। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কার ক্ষমতা বেশি সরকার, না স্বেচ্ছাচারি অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের । সরকার কেন তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, কেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না এর পেছনে রহস্য কি?
বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ‘কঠোর আইন’ প্রণয়নের কথা বহুবার বলা হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপের অবকাশ অনেকটা কম এটি সত্য বটে কিন্তু এর সুযোগ নিয়ে যারা নিজেদের আখের গোছাচ্ছে তাদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধাটা কি তাছাড়া আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, আইনের যথাযথ প্রয়োগই হলো মূল কথা। বাংলাদেশে আইনের কোনো অভাব নেই; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অনেক ক্ষেত্রেই আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনের কোনো কার্যকারিতাই নেই! মহাজোট সরকারের অন্যতম প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রূতি ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা এবং তা সাধারণ মানুষের নাগালে রাখা। তারা ক্ষমতা নেয়ার পর বাজার কিছুটা (উল্লেখ্য, বিগত প্রায় এক দশক ধরে বাজার চিত্র স্বাভাবিক সংজ্ঞার মধ্যে নেই) নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এলেও বেশিদিন তা রক্ষা করা যায়নি। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটের কাছে প্রায় নতিস্বীকার করতে হয়েছে বিদ্যমান বাস্তবতা তো তাই বলে। রমজানকে সামনে রেখে কোনো কোনো পণ্যদ্রব্যের মূল্য এরই মধ্যে এক লাফ দিয়েছে। মোদ্দা কথা, সিন্ডিকেটের দখলে রয়েছে বাজার। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং দুর্বিষহ জীবনযাত্রার ভারে সাধারণ মানুষ নুইয়ে পড়ছে। শুধু বাজার নয়, বিরূপ ধাক্কা লেগেছে অন্য খাতেও, যে খাতগুলো সাধারণ মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এককালে টিসিবি নামক যে প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের ব্যাপক কল্যাণ সাধন করেছিল, বাজারে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠানটি কোন অশুভ শক্তির স্বার্থ হাসিলে প্রায় অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার দায়ও সরকারেরই। ইতোমধ্যে নানা মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে টিসিবিকে দৃশ্যত কার্যকর ও গতিশীল করার কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বটে, কিন্তু তা-ও প্রশ্নমুক্ত নয়। অদূরদর্শী এসব পদক্ষেপের কোনোই সুফল মেলেনি এবং টিসিবির গৌরব পুনরূদ্ধার করে ভোক্তাদের কল্যাণে কাজে লাগানো যায়নি। এদেশে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা ভালো না করে অবস্থা ভালোর যে প্রত্যাশা করা হয়, তা খুব হাস্যকর-যুগপৎ বিস্ময়করও।
সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য কিংবা সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব নির্মূল করার জন্য ইতিপূর্বে আদালত থেকে নির্দেশনা এসেছিল। আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক বাজার তদারকি করতে মাঠে নামানো হয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ উৎসাহিত করা এবং ষড়যন্ত্রমূলক যোজসাজশ, মনোপলি, কিছুসংখ্যক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট কিংবা জোটবদ্ধ হয়ে কোনো পণ্য বা বাজার নিয়ন্ত্রণ রোধ করার প্রচেষ্টা দৃশ্যত কম না হলেও ফল আশানুরূপ নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, রোগটা চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও যথোপযুক্ত দাওয়াই দিতে এতদিন ধরে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে কেন ‘সিন্ডিকেট’ নামক চক্রটি কিংবা অদৃশ্য হাত কি এতই শক্তিশালী যে, এদের কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস কিংবা ক্ষমতা সরকারের নেই নাকি এখানে অন্য কোনো ‘কিন্তু’ আছে, যে ‘কিন্তু’ ক্ষমতাবান স্বেচ্ছাচারীদের উদর ভরতে ভূমিকা রাখছে সাধারণ মানুষের পকেট কেটে একদিকে সরকার বলছে তাদের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই, অন্যদিকে অশুভ শক্তির দাপাদাপিতে সমাজদেহ থরথর করছে। এমন বিপরীত চিত্র জিইয়ে থাকার দায় নেবে কে আমরা বিশ্বাস করতে চাই, সিন্ডিকেট কিংবা অদৃশ্য হাত যতই শক্তিশালী হোক কিংবা তাদের কর্মকান্ড যতই বিস্তৃত হোক, এর কোনোটিই সরকারের চেয়ে বলবান নয়। প্রচলিত আইনেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অবকাশ আছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এসব ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিলেই মঙ্গল। এদেশে ‘সাঁড়াশি অভিযান’, ‘চিরুনি অভিযান’ এই শব্দ যুগলগুলো আমাদের কাছে খুব পরিচিত। অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এর অস্তিত্বও লক্ষ্য করেছি। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের ক্ষেত্রে নব্বইয়ের দশকে এবং এরপরও এমন অভিযান চালানো হয়েছে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ হাসিলে। প্রশ্ন হচ্ছে, জনস্বার্থ হাসিলে ওই রকম অভিযান চালাতে সরকারের অনীহা কেন ?
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।