স্বাধীনতা: হিসাবের পাওনা
সাযযাদ কাদির: দেশ স্বাধীন হয়েছে বিয়াল্লিশ বছর, দেশবাসী স্বাধীন হয়েছে কতখানি? বিশ্বজনীন অধিকারগুলো কতখানি কি পেয়েছি আমরা? অল্প কথায় এ দু’টি প্রশ্নের উত্তর দেয়া সহজ নয়। কারণ আমাদের এখানে সবকিছুতে অনেক বিভাজন। প্রধান ভাগ দু’টি- ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন। যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন তাঁরাই সর্বেসর্বা। স্বাধীনতার সর সহ পুরো দুধ খাবেন তাঁরা, অন্যদের জন্য থাকবে চাঁচা হাঁড়ি আর ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা। এ অবস্থার কোনও পরিবর্তন নেই, পরিবর্তনের লক্ষণও নেই। সরকার আসে, যায়। নতুন সরকার গালমন্দ করে অতীত সরকারকে। আগামী সরকারও গালমন্দ করবে এ সরকারকে। তাঁরা সরকারি কাজ বলে যে সব দরকারি কাজ করেন তাতে হেরফের হয় না তেমন কিছু। রঙ বদলায়, চেহারা বদলায়, আওয়াজ বদলায়- এই যা। সেই ষাটের দশক থেকে দেখে আসছি, দেখছি এখনও। নিশ্চিত জানি, আমাদের পরের প্রজন্মগুলোও দেখে যাবে এ সবই। সরকারি দলের প্রথম কাজ দলীয়করণ। দলের লোক ছাড়া তাঁদের আদর্শ উদ্দেশ্য লক্ষ্য কর্মসূচি অঙ্গীকার বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলেই এটা খুব জরুরি। তবে বিরোধী দলে থাকাকালে প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা, বিচার, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিভাগে নিরপেক্ষতা এবং বেতার-টিভি, একাডেমি, ইনস্টিটিউট প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে স্বায়ত্তশাসন দাবি করলেও সরকার গঠনের পর ওগুলোতেই শুরু হয় সবচেয়ে বেশি হস্তক্ষেপ। দেয়া হয় দলীয় ও অন্যবিধ বিবেচনায় নিয়োগ। যাচাই হয় না প্রকৃত দক্ষতা ও যোগ্যতা। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন সুপরিচিত ও মেধাবী ব্যক্তি। সেখানে প্রধান বিবেচ্য হয়ে ওঠে আনুগত্য, তদবির, কানেকশন ও অন্যান্য লেনদেন। এ সব কারণে সরকারি বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম কিভাবে কি চলছে তা জানেন সবাই। ‘সরকারি মাল দরিয়া মে ডাল’ কথাটা তো সেই আদিকাল থেকেই চালু। এমন বেপরোয়া দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থার কারণে প্রতিদিনই বেড়ে চলে সরকারের বিপুল সুখ্যাতি। বেতার-টিভি ও অন্যান্য প্রচার-প্রকাশ প্রতিষ্ঠানে দলের লোকজন দু’ হাত খুলে লেখে, গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, দিন-রাত বক-বক করে- কেউ শোনে না, দেখে না, পড়ে না ও সব, বিশ্বাসও করে না। বরং ভাবে, সরকারের কি লাভ এ সব করে? বলা হয়, বিচারক শিক্ষক শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক পুলিশ প্রশাসন দলীয় হয়ে গেলে দেশের মানুষের দাঁড়াবার জায়গা থাকে না আর। সব দলই বলে এ কথা। সরকারে যাওয়ার পরেও বলে। কিন্তু করে কি কাজটা?
দুর্মুখেরা বলে, সরকারি দল যত ভাল কথা বলে তত খারাপ কাজ করে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিকতা নিয়ে চাপাবাজি করে শত মুখে, কিন্তু তাদের দলেই নেই গণতন্ত্র। ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বসে থাকে, কিন্তু ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না কোথাও। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কথায় মুখে ফেনা উঠে যায় নেতাদের, কিন্তু সরকারের প্রেসনোট, বিবরণী, বিবৃতি, বিজ্ঞপ্তি, ভাষ্য ইত্যাদিতে বিশ্বাস করার মতো থাকে না কিছু। মিথ্যাচার, ধামাচাপা, আড়াল করা, এড়িয়ে যাওয়া- এসব কিছুতেই বরং সেগুলোর জুড়ি মেলা ভার। চাঁদাবাজি, লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুনোখুনি ইত্যাদিতে দলের লোক জড়িত থাকলে সরকার মুখ দিয়ে কি সব কথা বেড়ায় তা সবারই প্রায় মুখস্থ। টেলিভিশনে সে সব গৎবাঁধা কথার সঙ্গে মিলিয়ে কথা বলতে পারেন দর্শকেরা। অনেক দর্শক পারেন আগে-আগে বলতে। প্রথমত বলা হবে, ‘এখনও জানি না, জেনে বলবো।’ এরপর বলা হবে, ‘রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে, রিপোর্ট আসে নি এখনও।’ পরে বলা হবে, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন কিছু বলা যাবে না, এতে তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে। তাই বলে বলা-কওয়া থামবে না একটুও। পুলিশ বলবে, দুষ্কর্মের জন্য কারা দায়ী জানা যায় নি তা। প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশেরা বলবে, চিনতে পারি নি দুর্বৃত্তদের। মামলা হবে আসামিদের অজ্ঞাত উল্লেখ করে। ফরেনসিক ডাক্তার বলবেন, হত্যা নয় আত্মহত্যা বা অন্য কিছু। মন্ত্রী বলবেন, আমাদের দলের কেউ নয় ওরা। অনুপ্রবেশকারী। নাশকতাবাদী। ওদিকে মিডিয়ায় জানাজানি হয়ে গেছে সব। ভিডিও ফুটেজে, ছবিতে শনাক্ত হয়েছে অপরাধীদের নাম ধাম পরিচয়। কিন্তু সরকারের কাছে তারা অনুপ্রবেশকারী এজেন্ট। কিন্তু কোন দলে ‘কনভার্ট’ নেই? ‘স্টলওয়ার্ট’দেরই বরং খোঁজ মেলে না বড়-বড় দলে। প্রায়ই তো অমুক দলের অত জনের অমুক দলে যোগদানের সচিত্র খবর পড়ি পত্রিকায়। সেখানে একটি বিচিত্র ব্যাপার দেখতে পাই প্রায়ই। যোগদানকারীদের যেখানে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়ার কথা, সেখানে তারাই ফুলের বিশাল তোড়া-গুচ্ছ নিয়ে এসে তুলে দেন নেতা-নেত্রীদের হাতে। সরকারের চিরশত্রু মিডিয়া। আর বিরোধীরা তো আছেই। তাদের বিরোধিতা সরকারের কাছে সরকার-বিরোধিতা, দেশ জাতি সমাজের বিরোধিতা। এমনকি দেশদ্রোহ, রাষ্ট্রদ্রোহ পর্যায়েও পড়ে! তবে অনুগত বিরোধীও আছে। প্রয়োজনে তাদের মাঠে নামায় সরকার। নানা কর্মসূচি পালন করায় নানা উদ্দেশ্য হাসিলের মতলবে। তাদের সহযোগিতা সহায়তা পৃষ্ঠপোষকতা করে সর্বতোভাবে। নিজেদের কোলে ঝোল টানার জন্য এ রকম আরও অনেক কাজ সরকারি দলগুলো করে আসছে জেনেশুনেই। কিন্তু পাবলিক সবজান্তা হলেও যে প্রশ্নের উত্তর জানে না তা হলো, ‘এ সব হাবিজাবি করে লাভ কি সরকারের?’বিভাজনের কথা বলছিলাম। সে বিভাজন এখন যেমন তীক্ষ্ণ তেমন তীব্র। সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে দু’টি পক্ষে। আমার পক্ষে থাকলে ভাল, বিপক্ষে থাকলে মরতে হবে ধনে-প্রাণে। এখন কেউ যেন মানুষ নয়, পক্ষবিশেষ মাত্র। এবং বধযোগ্য।
পৃথিবীর বহু দেশে যুদ্ধ ও সহিংসতায় নিত্য ঘটছে মানুষকে এমন বধযোগ্য ভাবার নানা মর্মান্তিক ঘটনা। আমাদের দেশে, এ অঞ্চলেও দেখা দিচ্ছে তেমন অনেক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি। গত বছর প্রতিবেশী মিয়ানমারে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গারা শিকার হয় জাতিগত নিপীড়নের। ওই দেশের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত থাকায় বাইরের জগতে সামান্যই এসেছে সেখানকার হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের খবর। তারপর যেটুকু তথ্য ও দৃশ্য দেশী-বিদেশী মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে তা রীতিমতো গা শিউরানো ভয়াবহতায় বীভৎস। ওই সময় শ’-শ’ রোহিঙ্গা নরনারীশিশু প্রাণভয়ে পালিয়েছে ভিটামাটি ছেড়ে। ট্রলারে, নৌকায় চেপে ভেসে পড়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। তাদের অনেকেরই সলিল সমাধি ঘটেছে সাগরের বুকে, অনেকে আশ্রয় নিতে ছুটে গেছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারতে। অনেকে এসেছে আমাদের দেশে। কিন্তু আগে থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থীতে প্রপীড়িত আমরা, তাই নতুন করে শরণার্থী গ্রহণে অনিচ্ছা দেখিয়েছে সরকার। এ অবস্থায় এক ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডি আমরা দেখতে পাই দেশের উপকূল অঞ্চলে। অসহায় আশ্রয় প্রার্থীদের তাড়িয়ে দেয়ার সে দৃশ্য নাড়া দেয় বিশ্ববিবেককে। তাই জাতিসংঘ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা অনুরোধ জানিয়েছে বিতাড়ন বন্ধ করে মানবিক সাহায্য দেয়ার। কিন্তু সরকার অনড়। আরও অনড় সরকার-সমর্থকরা। তাদের অনেকে ওই সময় শুরু করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা-অভিযান। বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গারা কত বিপজ্জনক, কত সমস্যার কারণ তা শতমুখে প্রচার করতে থাকে তারা। তাদের কথা, রোহিঙ্গারা একটি অপরাধী সম্প্রদায়। তারা অস্ত্র, মাদক, নারী ব্যবসা সহ যাবতীয় দুষ্কর্মে জড়িত। দেশের সব কিছু ধ্বংস করছে তারা। বাংলাদেশী সেজে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে। সেখানে তারা সব ধরনের জঘন্য কুকর্মে লিপ্ত। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জামায়াত-শিবির সমর্থক হিসেবেও প্রচার চালানো হয়। ফলে যারা বলতে গিয়েছেন- ওরাও মানুষ, ওদেরও বাঁচার অধিকার আছে, তাদের গালমন্দ করা হয়েছে জঘন্য কটু ভাষায়। ‘রাজাকার’ হিসেবে পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে। তখন নজরুলের মতো “অসহায় জাতি মারছে ডুবিয়া সন্তান মোর মা’র” বলার মতো দৃপ্ত মানুষ দেখেছি খুবই কম। এরপর একই রকম ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডি ঘটে আসামের কোকড়াঝাড়-এ। সেখানকার বোড়োদের হামলার শিকার হয় বাংলাভাষী মুসলমানেরা। তাদের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী অভিহিত করে চলে নিধনযজ্ঞ। সেই সঙ্গে লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ। এ সময় প্রায় সবাই ছিলেন নীরব। গণমাধ্যমে সে রক্তপাতময় দাঙ্গা ও প্রাণহানির খবর ছিল না তেমন। ভারতের ‘আউটলুক’ পত্রিকা গুরুত্ব দিয়ে কিছু সচিত্র প্রতিবেদন ছেপেছিল। এছাড়া আর কোনও পত্রিকায় সেভাবে স্থান পায় নি ওই মানবিক বিপর্যয়ের খবর। তখনও দেখা গেছে মহল বিশেষকে কোকড়াঝাড়ের খবর চেপে রাখার জন্য বিশেষভাবে তৎপর। কিছুদিন আগে আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের মঠ-ঘরবাড়ি, সমপ্রতি হিন্দু সমপ্রদায়ের মন্দির-ঘরবাড়ি শিকার হয়েছে হামলার, আবারও রোহিঙ্গা নিধন শুরু হয়েছে মিয়ানমারে। অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করা হচ্ছে বহু নিরীহ নিরপরাধ পরিবারের আশ্রয়স্থল। এখনও দেখছি কিছু মানুষ ভাল চোখে দেখছে না এসব ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ। তাদের ভেতরে-ভেতরে যেন চাপা উল্লাস। ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল’ কাকে না বিচলিত করে? কিন্তু দেখছি, সবাইকে করে না। রোহিঙ্গা, বাংলাভাষী অসমিয়া, বাঙালি বৌদ্ধ-হিন্দু তবে কি কারও-কারও চোখে আক্রমণযোগ্য? বধযোগ্য? সামপ্রতিক সরকারবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিবর্ষণে হতাহত হয়েছে বহু মানুষ। এভাবে হত্যা কি সমর্থনযোগ্য? কিন্তু এর প্রতিবাদ করা অনেকের কাছে অপরাধতুল্য। নাস্তিক মুরতাদ বা ইসলামিরা এখন বধযোগ্য হয়ে উঠছে কোনও-কোনও পক্ষের কাছে। এ অবস্থায় মনে পড়ে, হিটলারও ইহুদিদের মানুষ মনে করতেন না। ভাবতেন, তাদের হত্যা করলে কিছু আসে যায় না। আমরা কি সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিশাপে আক্রান্ত হয়েছি? কিন্তু এসব প্রশ্ন তোলা-ও তো বিপজ্জনক। বললেই শুনতে হবে সেই অমোঘ গালি- হয় নাস্তিক নয় রাজাকার!
স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পর বিভাজন গ্রাস করেছে সব সত্যকে, সবচেয়ে বেশি গ্রাস করেছে সত্যের চক্ষু পরিচয়ের দাবিদার আমাদের মিডিয়াকে। পক্ষপাতিত্বের ক্ষেত্রে তার ক্ষমতা তাই অপরিসীম। ‘তিনি চেনালে লেখক। তিনি চাইলে প্রচার। তিনি দিলেই প্রাইজ।’ অর্থাৎ আপনার কাজকর্মের স্বীকৃতি, প্রসার, সম্মাননা- সব নির্ভর করে তার ওপর। তিনি ইচ্ছা করলে আপনি উঠবেন উপরে, নিত্য ঝলমল করবেন খবরে, ঘটনায়, যাবতীয় অনুষ্ঠানে আয়োজনে, পাবেন পদ পদক পুরস্কার পারিতোষিক- দেশ-বিদেশে পাবেন সম্মান সংবর্ধনা। না হলে থাকতে হবে যে আঁধারে সে আঁধারেই। আপনি যত জ্ঞানী গুণী বিজ্ঞ বিশারদ যা-ই হোন কেন, তিনি না চাইলে আপনার সমাদর হবে না, মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠা কিছুই হবে না।
আশা করি বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে পাঠকদের কাছে। আর খোলাসা করে কিছু বলতে হবে না আপনাদের। এই গোষ্ঠীপ্রীতি, দলবাজি, গ্রুপিং নতুন কিছু নয় এ দেশে। আগে সরকারি মিডিয়াতেই ছিল এ ব্যাপারগুলো। সেখানে থাকে অলিখিত অঘোষিত কালো তালিকা। বরাবরই থাকে, আছে এখনও। কিন্তু এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি মিডিয়াতেও। আর সে ছড়িয়ে পড়া যেন সরকারি মিডিয়ার চেয়েও বেশি। কারণ, প্রচার প্রসার প্রভাব এখন তাদেরই বেশি। এ ক্ষমতা তার উত্তরোত্তর বেড়েছে ’৯০-পরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক’ যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে।
তবে পর্বতের চূড়ায় আরোহণের পর সেখানে বেশিক্ষণ থাকা যায় না, আবার নেমে আসতে হয়। কারণ, জায়গাটি ছোট। আমাদের মিডিয়ারও ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণের পর এবার বুঝি শুরু হয়েছে নিচে নামার পর্ব। তার সামপ্রতিক ভূমিকায় এমন আশঙ্কাই দেখা দিয়েছে। দেশ এখন চরম সন্ধিক্ষণে। অস্থির উত্তেজনা ক্রমে-ক্রমে গ্রাস করেছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। দ্বন্দ্ব সংঘাত সহিংসতা সর্বত্র। রাজনৈতিক বিবাদ বিরোধ ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে পাড়ায়-পাড়ায় ঘরে-ঘরে। মৃত্যু উপত্যকা হয়ে উঠেছে দেশ। ক্ষমতার লড়াইয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিযোগী পক্ষগুলো। এক পক্ষের মানুষের রক্ত ঝরছে, অন্যপক্ষে চলছে আনন্দ উল্লাস। যেন যে আমার পক্ষে নয় তাকে বধ করা চলে। সে যেন মানুষ নয়, তাই তাকে মেরে ফেললে কিছু হয় না। ‘মুর্দাবাদ’, ‘নিপাত যাক’, ‘খতম করো’, ‘জবাই করো’ ইত্যাদি স্লোগান যেন মূর্তিমান রূপ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে জীবনের ওপর। এ মৃত্যুর জন্য দুঃখও করা যাবে না, মানবতার পক্ষেও কথা বলা যাবে না- তাহলেও আপনাকে চিহ্নিত করা হবে কোনও পক্ষের লোক হিসেবে। তারপর আপনাকে চিহ্নিত করা হবে বিশেষ নামে, আপনার ওপর লাগিয়ে দেয়া হবে বিশেষ তকমা। এ এক অভাবনীয় পরিস্থিতি। যেন পালটে গেছে মানবতার সংজ্ঞা, দেশপ্রেমের অর্থ। আগেও বলেছি, মানুষ যেন এখন মানুষ নয়, পক্ষ মাত্র। বিশেষ পরিচয় মাত্র। এমন এক জটিল মানবিক ও জাতীয় বিপর্যয়কালীন পরিস্থিতিতে কি ভূমিকা হবে মিডিয়ার? যুদ্ধবাজ দুই পক্ষের একটিকে বেছে নেয়া, না সাধারণ মানুষের পক্ষ হয়ে পরিস্থিতির ভেতর বাইরের সামগ্রিক দিক নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক ভাবে তুলে ধরা? দুঃখের বিষয়, গভীর হতাশার বিষয়, আমাদের প্রতাপশালী প্রভাবশালী মিডিয়া ঝুঁকে পড়েছে পক্ষপাতের পাঁকে। নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক খবরের আদর্শ ভুলে নিজেও হয়ে উঠেছে যুযুধান। পত্রিকায় মতামত প্রকাশের জন্য সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, কলাম, মন্তব্য প্রতিবেদন অনেক বিভাগ রয়েছে, টিভি চ্যানেলগুলোতে রয়েছে টক শো, সাক্ষাৎকার প্রভৃতি। কিন্তু এখন কি হচ্ছে? একজন প্রবীণ সাংবাদিক লিখেছেন, ‘আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এবং সংবাদপত্রে রিপোর্টার মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করছেন।’ মনের মতো করে সাজিয়ে দিচ্ছেন ঘটনা, বানিয়ে দিচ্ছেন ভিলেন। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতার গিন্নির কথা- যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, ‘কেষ্টা বেটাই চোর।’ আমাদের চারপাশে এখন সেই মুখরা গিন্নি। তিনি চোর বলতে বুঝছেন কেবল কেষ্টাকেই। তাহলে স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছরে এ-ই আমাদের হিসাবের পাওনা!
সাযযাদ কাদির: সিনিয়র সাংবাদিক।।