রাজধানীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আশঙ্কা জনকঃ ভেঙে পড়ছে পুলিশের টহল ও চেকপোস্ট-ব্যবস্থা
সৌরভ চৌধুরী,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ রাজধানীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আশঙ্কা জনক। প্রায় প্রতিদিনই পড়ছে লাশ। হচ্ছে অপহরণ। নিজ বাসা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি শত শত মানুষের সামনেই অহরহ ঘটছে খুনের ঘটনা। দুর্বৃত্তরা একের পর এক হত্যাকান্ড ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাচ্ছে। গত ১৬ এপ্রিল (বুধবার) পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলা’র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী এবি সিদ্দিক অপহৃত হন। অপহরণের প্রায় ৩৫ ঘন্টা পর বৃহস্পতিবার উদ্ধার হয় এবি সিদ্দিক। সম্প্রতি গুলিস্থানে দিনে-দুপুরে ককটেল ফাটিয়ে এক ব্যবসায়ীর সোয়া লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। রাজধানীর মগবাজারে অস্ত্রধারীরা গুলি করে হত্যা করে আবদুল আলীম নামে এক আনসার সদস্যকে। টিঅ্যান্ডটি কলোনির গেটের কাছে এ ঘটনা ঘটিয়ে অস্ত্রধারীদের সবাই পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। তুরাগ এলাকায় উদ্ধার হয় গুলিবিদ্ধ এক যুবকের লাশ। উত্তরায় এক রাতে চার বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। অস্ত্রের মুখে ডাকাতরা লুটে নেয় কয়েক লাখ টাকার মালামাল। পুলিশ তাদের ধরতে পারছে না। ছিনতাই, ডাকাতি ও চুরির ঘটনা অস্বাভাবিক হারে বেড়েই চলছে। চলছে নীরব, সরব আর টেলিফোনে চাঁদাবাজি। এ অবস্থায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। সর্বশেষ চাঁদাবাজরা গুলি করে হত্যা করেছে আনিসুর রহমান নামে এক ব্যবসায়ীকে। এ ছাড়া গত তিন মাসে গাড়ি চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা আগের সব ঘটনার রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, গত তিন মাসে রাজধানীতে খুনের ঘটনা ঘটে ৬০টি। এসব ঘটনায় জড়িত খুনিদের অধিকাংশই লাপাত্তা। এ ছাড়া একই সময়ে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে সহস্রাধীক। অর্ধশতাধিক অপহরণের ঘটনাও ঘটেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশের টহল ও চেকপোস্ট-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় জামিনে মুক্তি পাওয়া দাগি অপরাধী ও ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়েছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ চেকপোস্ট থাকার কথা থাকলেও তা খুব একটা কাজে আসছে না। বেশিরভাগ সময় জামিনে মুক্তি পাওয়া সন্ত্রাসীদের তথ্যও পৌঁছে না সংশ্লিষ্ট থানা পর্যন্ত। এসব কারণে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থামানো সম্ভব হচ্ছে না। টার্গেট করে খুন করে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই খুনিরা পালিয়ে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পেছনে পুলিশকেই দায়ী করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটলেও পুলিশ খুনিদের গ্রেফতার করতে পারছে না। এতে অপরাধীরা আসকারা পেয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে ভয়ভীতি কাজ করছে কম। এ ছাড়া পুলিশের মধ্যে জবাবদিহিতা কমে গেছে। প্রতি মাসে ডিএমপির অপরাধ পর্যালোচনা সভা না হওয়ায় ডিএমপির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা থাকছে না। চাঁদাবাজির বহু ঘটনা ঘটলেও সব ঘটনায় মামলা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ ঝামেলা এড়াতে কোনো কোনোটি আবার জিডি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। আবার মামলা হলেও ভুক্তভোগীরা ভয়ে অনেক সময় স্যা দিতে যান না। এসব কারণে আসামিরা ছাড়া পেয়ে যায়। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রশ্রয় বন্ধ না হলে এ অপরাধ কমবে না বলে আনেকেরই মনে ধারণা। রাজধানীর অপরাধ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রায় এলাকায় চাঁদাবাজরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চাঁদা না পেলেই তারা অ্যাকশনে যাচ্ছে। গুলি চালাচ্ছে। হামলা করছে। এমনকি পরিবারের সদস্যদেরও তারা টার্গেট করছে। গত কয়েক দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজদের হাতে অন্তত ১৫ জন গুরুতর জখম হয়। চাঁদা না পাওয়ায় দুর্বৃত্তরা গুলি করে আর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করেছে তাদের। চিকিৎসক, শিক, ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও রাজনৈতিক নেতাদের টার্গেট করে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। এছাড়া খেটে খাওয়া মানুষও চাঁদাবাজদের হুমকি-ধমকিতে আতঙ্কিত। ডিএমপির কোনো না কোনো থানায় প্রায় প্রতিতদিনই এ সংক্রান্ত জিডি হচ্ছে। সব মিলিয়ে চাঁদাবাজদের ভয়ে চরম অস্থিরতার মধ্যে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। সূত্র জানায়, জেল থেকে জামিনে ছাড়া পাচ্ছে দাগি অপরাধীরা। তারাই এখন প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছে। অস্ত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কিংবা বাসাবাড়িতে। এ ছাড়া কারাগারে আটক ও বাইরে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামেও চলছে ভয়ানক চাঁদাবাজি। পুলিশ ও র্যাব সূত্র জানায়, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় বিগত তিন মাসে চাঁদা দাবির অভিযোগে আড়াই শতাধিক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। ব্যবসায়ী, সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এসব ডায়েরি করেছেন। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ ও র্যাব শতাধিক চাঁদাবাজকে গ্রেফতারও করেছে।
জানা গেছে, গত মাসে ২০ লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায় মগবাজার এলাকার একটি সিএনজি স্টেশনের মালিক মোস্তাফিজুল হক মিলনকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। একই কারণে আশকোনায় বাড়ি নির্মাণের সময় চাঁদাবাজরা বাড়ির মালিকসহ তিনজনকে গুলি করে আহত করে। বাড্ডায় জয়নাল আবেদীন নামে এক দোকান ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা করে চাঁদাবাজরা। মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের কো-অপারেটিভ মার্কেটের এক কাপড় ব্যবসায়ীর কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ওই রাতেই মল্লিকা হাউজিং এলাকায় তার বাসায় মিষ্টির প্যাকেটে কাফনের কাপড়, ককটেল ও হাতবোমা পাঠিয়ে হুমকি দেয়া হয়। ওই ব্যবসায়ী এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি করেন। মিরপুর শাহআলী মার্কেটের এক ওষুধ ব্যবসায়ী জানান, ‘শাহাদাত বাহিনীর’ সদস্য পরিচয়ে তার কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে। টাকা না দিলে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয় সন্ত্রাসীরা। এ ব্যাপারে আইজি হাসান মাহমুদ এর কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, রাজধানীসহ সারা দেশের আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী র্যাব পুলিশসহ সকল বাহিনী সকল সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধে সদা তৎপর রয়েছে। তারপরও কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। আমরা এই অপকর্মে বন্ধে দ্রুত পদপে নিচ্ছি।