সাংবাদিকতা পেশায় সততার সর্বতোমুখী স্বাক্ষর সুনীল ব্যানার্জি
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র ও অবহেলিত আমাদের এই দেশে সর্বগুণে গুণান্বিত প্রতিভা সত্যিই বিরল। তবুও এ দেশে মাঝে মাঝে এমন দু-একজন প্রতিভাবান জন্ম নেন,যাদের জ্ঞান-গরিমা,চিন্তা-ভাবনা,প্রজ্ঞা অল্প সময়ের জন্য হলেও আমাদের পারিপার্শ্বিকতাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায়। দেশ-কালের সীমাবদ্ধ গণ্ডি ছাড়িয়ে তাদের প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্বে। আমাদের দুর্ভাগ্য,চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী এরাও একদিন বিদায় নেন আমাদের মাঝ থেকে,রেখে যান তাদের কর্ম,তাদের অনন্য প্রতিভা- যা শুধু স্মৃতি হয়েই ধরা দেয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রথিতযশা সাংবাদিক ও লেখক সুনীল ব্যানার্জির ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী ২৮ আগস্ট। ২০০৬ সালের ২৮ আগস্ট তিনি জগত সংসারের সকল মায়ার-বন্ধন ত্যাগ করেন।
সৎ সাংবাদিকতায় সমর্পিত এক ব্যক্তি-নামের আড়ালে বাংলাদেশে সাংবাদিকতাক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। তাই তাঁর কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন পড়ে না। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে প্রয়াত সুনীল ব্যানার্জির অসাধারণ ও অনবদ্য অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে অনাদিকাল। সত্যের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল তাঁর পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের কর্মকাণ্ড। সাংবাদিকতা পেশায় সততার সর্বতোমুখী স্বাক্ষর সুনীল ব্যানার্জি স্বয়ং। প্রবীণ সাংবাদিক ওবায়েদ উল হকের ভাষায়,‘তাঁর মৃত্যু নেই। তাঁকে বরণ করে মৃত্যুও ধন্য।’সুনীল ব্যানার্জির জীবনাচরণ সৎ মানুষের পরম প্রত্যয়ের প্রতিচ্ছবি। সারল্যের আভিজাত্য প্রকাশ পেত তাঁর কথায়,তাঁর লেখায়,তাঁর চলাফেরায়,তাঁর আচার-আচরণে,তাঁর রুচিবোধে। হয়তো,সাংবাদিকতা,সাহিত্য ও ইতিহাস একই বিষয়। দেশের সমসাময়িক ঘটনাবলিসংক্রান্ত তাঁর কলামগুলো পড়ার সময় প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক জেমস রেস্টনের একটি উক্তি প্রায়ই মনে পড়ে। নিউ ইয়র্ক টাইমসে ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে রেস্টন বলেছিলেন,’If it is far away it is news, but if it is close at home, it is sociology।’ সুনীল ব্যানার্জির বিবিধ লেখায় আমরা বারবার সমাজকেই পেয়েছি,সমাজমুক্তির প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের সূত্র পেয়েছি। তাঁর রিপোর্টে,কলামে বিশদভাবে সমাজচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন,The truth shall make us free। সমসাময়িক তথ্যের নির্ভুল উপস্থাপনা,ইতিহাসের নিরিখে তাঁর নির্মোহ বিশ্লেষণ এবং নীতি-নৈতিকতার কষ্টিপাথরে তাঁর নিখুঁত যাচাই-বাছাই যেভাবে অনিরুদ্ধ করে গেছেন জীবনভর,তা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক পরম সম্পদ।
তথ্যসমৃদ্ধ ও যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি সমস্যাগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। সুনীল ব্যানার্জির মৃত্যুর পর প্রবীণ সাংবাদিক নির্মল সেন লিখেছেন,‘সব দিক থেকে সুনীল ছিলো একজন বড়মাপের মানুষ। নিজের ঢাক নিজে পেটানোর মানসিকতা তাঁর ছিল না। সে ছিলো নিভৃতচারী এক জ্ঞানসাধক। পড়া ও লেখা_এই দুই-ই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। যা বিশ্বাস করতেন,তা লেখার মতো সৎ সাহস তাঁর ছিল। কারো চোখরাঙানি বা চাওয়া-পাওয়া তাঁর বিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারেনি। আজ সুনীল আমাদের মাঝে নেই। তবে তা দৈহিক অর্থে। মানুষকে ভালোবেসে,মানুষের ভালোবাসা নিয়ে যাঁর মৃত্যু,তিনি বেঁচে থাকেন তাঁর কর্ম ও কীর্তির মধ্যে।’
বাংলাদেশে পত্রিকায় রিপোর্টিং ভিত্তিক আধুনিকতার প্রবর্তক,স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতা জগতে একটি বিদ্রোহী নাম ছিলেন সুনীল ব্যানার্জি। অন্যায়ের সাথে আপস না করে যিনি হয়ে উঠেছিলেন দ্রোহের ফুল। আজকের সময়ের অনেক আলোচিত সাংবাদিকদের হাতেখড়ি হয়েছিল সুনীল ব্যানার্জির মাধ্যমে। অনেক তুখোড় সাংবাদিকেরই সংবাদ জগতের গুরু ছিলেন তিনি। সততা,প্রতিভা,সময়,শ্রম,অভিজ্ঞতা ও মেধা তিনি নিঃস্বার্থভাবে বিনিয়োগ করে গেছেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতায়। সাংবাদিকতাকে তিনি জীবন হিসেবে দেখেছিলেন;জীবিকা হিসেবে নয়। তাঁর জীবনের মূল উপজীব্য ছিল চিন্তা ও কর্মের সততা। মানুষের সব সদ্গুণের মাঝে সততাই সর্বোৎকৃষ্ট গুণ। সাংবাদিকতায় প্রবেশকালে তিনি সততাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন এবং সারা জীবন সাংবাদিকতায় সততা সনি্নবিষ্ট করেছেন,সৎ সাংবাদিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন,সাংবাদিকতার মাধ্যমে সততার বিস্তৃতি ঘটানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন অবিরাম। এই মহান ব্যক্তি আমার পিতা। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। যার অনুপস্থিতি আমার প্রতিটি অসহায় মুর্হূতের নীরব স্বাক্ষী। সুনীল ব্যানার্জির মতো মানুষকে নিয়ে আলোচনা সভা করা যায়,সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-ওয়ার্কশপ করা যায়,কিন্তু স্মরণসভা বা শোকসভা করা যায় না। কারণ সুনীল ব্যানার্জির মতো মানুষেরা নিজ কর্মের মাধ্যমে সর্বদাই জীবিত। তাঁর স্মৃতি ও জীবনাদর্শ আমাদের পথনির্দেশনা।
[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রয়াত সুনীল ব্যানার্জির পুত্র।।]
jsb.shuvo@gmail.com