সময় হয়েছে প্রতিবাদের, সময় এসেছে রুখে দাঁড়ানোর
খুরশীদ শাম্মী: অনেক অল্প বয়স থেকেই সংবাদপত্র পড়তে পছন্দ করি। কোন কারণে কখনও যদি পুরো সংবাদপত্র পড়তে না পারি তবে শিরোনামগুলো পড়তে ভুল হয় না। আমার মনে আছে আমি যখন অষ্টম কি নবম শ্রেণীর ছাত্রী একবার পতিতাদের পুনর্বাসন নিয়ে একটি আন্দোলনের খবর পড়ে আমি আমার বাবাকে প্রশ্ন করেছিলাম, বাবা! পতিতা শব্দের অর্থ কি? পতিতাদের কেন আন্দোলন করতে হচ্ছে? কিন্তু আমার যতদূর মনে হয় ধর্ষণ শব্দটির অর্থ আমাকে কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়নি, বরং সংবাদপত্রই আমাকে ধর্ষণ বিষয়টা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করেছে। হত্যা, নারী লাঞ্ছনা, ধর্ষণ কিংবা মৃত্যুর সংবাদ পড়লে সবসময়ই আমার মন খুব খারাপ হতো এবং এখনও হয়। একজন আশাবাদী মানুষ হওয়ায় সেই ছোটবেলা থেকে আমি মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম, মানুষ দিনে দিনে শিক্ষিত হবে এবং সকল অমানবিক আচরণ দূর হবে। এগুলো নিয়ে কখনো লিখবো বলে ভাবিনি। এখন দেখছি আমার স্বপ্নটা পুরোপুরি সঠিক নয়। হ্যাঁ, মানুষ পুঁথিগত বিদ্যায় বিদ্বান হয়েছে ঠিকই, পাশাপাশি মানুষের নৈতিকতা হ্রাস পেয়ে পেয়ে বিলুপ্ত প্রায়। গত কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশে ধর্ষকেরা প্যাটার্ণ করে মাইক্রোবাস, ট্রাক, নৌকা, চলন্তবাস ব্যবহার করছে, আর কিছু জানোয়ার আছে যারা এগুলো উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করে নারীদের পর্দার প্রয়োজনীয়তার ব্যখ্যা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে যুক্তি করে পূর্ব পরিকল্পিত ছকে আগাচ্ছে এরা। অন্যদিকে সাংবাদিকেরা সংবাদ লিখছেন নারী, মেয়ে, তরুণী, গৃহবধূ ধর্ষিত হয়েছে। এমনভাবে ধর্ষিতার বর্ণনা হচ্ছে সংবাদে যেন সব দেখিয়ে দিচ্ছে। এই মধ্যবয়সে এসে নিজের বোনা স্বপ্নগুলো পুড়ে ছাই হতে দেখে আমার মনে দাউ দাউ করে জ্বলছে কিছু প্রশ্ন। নর এবং নারী দু’জনই যখন মানুষ সেখানে শুধু নারীকে কেন অবহেলা? নারীকে কেন নিজেকে ঢেকে চোরের মতো চলতে হবে? কেন পুরুষেরা পারে না মনের পর্দা টেনে সমাজে চলতে? বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে একজন নারী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী সেও একজন নারী, সেই দেশে কেমন করে নারীরা এত উন্মুক্তভাবে লাঞ্ছিত হয়? কেমন করে নারীরা ধর্ষকদের শিকার হয়? সাংবাদিকদের সংবাদের শিরোনাম কেন এমন হয় না?, “মাইক্রোবাসে পাঁচজন নর ধর্ষকের শিকার একজনমাত্র নারী।”
আমি অতি ক্ষুদ্র সাধারণ একজন মানুষ। জ্ঞানের ছোট একটা প্রদীপের আবছা আলো আমার জীবনে যতটুকুন শিখিয়েছে, “নর এবং নারী দু’জনেই স্রষ্টার সৃষ্টি একই মানুষ! স্রষ্টার কাছে, সমাজের কাছে সকল মানুষের অধিকার, দায়িত্ব এবং কর্তব্য সমান এবং অভিন্ন।” যারা নারী শব্দটি ব্যবহার করে স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরী করে, দায়িত্ব-কর্তব্যের পরিমাণ বাড়িয়ে এবং অধিকারের অংশ কমিয়ে দেয় তারা বিধাতার সৃষ্টি মানুষরূপী অমানুষ! বাংলাদেশে বসবাসরত এই ধরনের অমানুষগুলোকে মানুষ করার জন্য প্রয়োজন দেশের বিচার বিভাগ, প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা বিভাগের সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার ইচ্ছা এবং তা কার্যকরী করা। এছাড়াও সংবাদ মাধ্যমগুলোকে ঘুণেধরা পদ্ধতিগুলো মুছে ফেলে নতুন পদ্ধতিতে অপরাধীদের ফোকাস করে সংবাদ প্রচার করা। তবে নারী শব্দটির অপব্যবহার বন্ধ করতে সবকিছুর উর্ধ্বে খুব দৃঢ়ভাবে যা দরকার তা হচ্ছে, “নারীদের নিজেদেরকে একজন মানুষ হিসেবে দেখার চর্চা এবং তা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করা।” আর নয় লাঞ্ছনা কিংবা ধর্ষণের শিকার! সময় হয়েছে প্রতিবাদের, রুখে দাঁড়াও! নারী নয় মানুষ হয়ে।
[খুরশীদ শাম্মী : প্রবাসী সাংবাদিক।।]
টরন্টো, কানাডা, মে ২৯, ২০১৫।